যে দামে একটি ইংরেজি বই কিনতে আমরা দু’বার ভাবি না, সেই একই পৃষ্ঠাসংখ্যা ও সমান গুরুত্বের বাংলা বইয়ের দাম তার অর্ধেক হলেও অনেকেরই চোখ কপালে ওঠে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা প্রকাশনা নিয়ে আমাদের বিবিধ হাহাকারের শেষ নেই। উচিত মূল্য না থাকলে যোগ্য মানুষ আর উপযুক্ত মানটিই বা আসবে কোথা থেকে? লিখলেন সুস্নাত চৌধুরী
‘বইটা চমৎকার, কিন্তু দাম বেশি!’ কলেজ স্ট্রিট হোক বা ফেসবুকে বইপত্রের গ্রুপ– কান পাতলে এই অভিযোগ কোনও কোনও বই নিয়ে অনেক সময়ই শুনতে পাওয়া যায়। উক্ত বইয়ের প্রকাশক চাইলে বলতেই পারেন যে, এই বক্তব্যের মধ্যেই তার কার্য-কারণ সম্পর্কটি লুকিয়ে আছে। কিন্তু বইটি চমৎকার বলেই যে তার দাম বেশি, এই যুক্তি কি বাংলা বইয়ের ক্রেতারা সবসময় মানতে প্রস্তুত?
বাজারের আর পঁাচটা পণ্যের মতো ‘সস্তার তিন অবস্থা’ নীতিটি বই নামক পণ্যের ক্ষেত্রে মেনে নিতে আমাদের মন সায় দেয় না। মুড়ি এবং মিছরি একই দরে পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস ও অভ্যাস করতে চাই আমরা। সে কারণে ব্র্যান্ডেড জামা-জুতো বা মোবাইল ফোন কিনতে, আইনক্সে গিয়ে ছবি দেখতে, রেস্তরঁা ও পানশালায় কার্ডে পে করতে আমাদের সমস্যা হয় না মোটে। অথচ, বই কেনার প্রশ্ন উঠলেই পকেটে টান– আরও বেশি ছাড়, আরও সস্তায় তা পাওয়ার জন্য মন আকুল হয়ে ওঠে।
তা-ও আবার এসব কেবল বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রেই। যে-দামে একটি ইংরেজি বই কিনতে আমরা দু’বার ভাবি না, সেই একই পৃষ্ঠাসংখ্যা ও সমান গুরুত্বের বাংলা বইয়ের দাম তার অর্ধেক হলেও অনেকেরই চোখ কপালে ওঠে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা প্রকাশনা কেন আন্তর্জাতিক মানের বই তৈরি করতে পারে না, কেন সেখানে ঠিকঠাক বানান-জানা প্রুফ রিডারের এত অভাব, কেন নেই যথাযথ সম্পাদনার ছাপ– এসব হাহাকার বাতাসে ঘুরে ফেরে। উচিত মূল্য না থাকলে যোগ্য মানুষ আর উপযুক্ত মানটিই বা আসবে কোথা থেকে– সেই প্রশ্নের মুখোমুখি কি আমরা আদৌ হতে চাই?
বইয়ের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে থাকা উচিত, এমন একটা চালু ধারণা আছে। যদিও ‘মানুষের নাগাল’ বিষয়টি অনির্দিষ্ট। সকলের পক্ষে সব বই কেনা কখনওই সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও তা পড়ার জন্য ‘গ্রন্থাগার’ নামক একটি ব্যবস্থা বহু যুগ ধরে সারা দুনিয়ায় প্রচলিত। সমস্যা হল যে, সেই পথটি গত দু’-এক দশকে আমরা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছি। সরকারি গাফিলতি যেমন আছে, ভোক্তার তরফে দায়ও কম নেই। কিন্তু নাগালের ওই অনির্দিষ্টতা শুধু আমাদের ক্রয়ক্ষমতার উপরে নির্ভরশীল নয়। প্রবণতার উপরেও দাঁড়িয়ে। দু’-এক ঘণ্টার ফুর্তির জন্যও যে টাকা আমরা অনেকে অনায়াসে ব্যয় করতে প্রস্তুত, একটি বই সেই মূল্যে কিনতে হলে আমরা থমকে যাই। অথচ সেই বইটি হতে পারত আমাদের সারা জীবনের সঙ্গী।
তাহলে কেবল বইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের এমন মনে হয় কেন? বাংলা বাজারে কোনও বইয়ের ‘ঠিকঠাক’ দাম রাখার কথা কেন ভাবতে পারেন না একজন প্রকাশক? এর সঙ্গে অনেকগুলো কারণ জড়িয়ে। তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি সমাজে সামগ্রিক বাংলা ভাষার অস্তিত্বই ক্রমশ হীনতা ও দীনতার সমার্থক হয়ে পড়া যেমন বাংলা বইকেও হীনজ্ঞান করার একটা কারণ, তেমনই শুনতে খারাপ লাগলেও এ কথা মেনে নেওয়াই ভাল যে, গড় বাঙালির সংস্কৃতিতে বিদ্যায়তনিক পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ‘বই’ বস্তুটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে পড়ে না। কেউ যদি নিয়মিত বই না পড়েন কিংবা বহুশ্রুত সেই চুটকিটির মতো, সত্যিই কেউ যদি বাড়িতে ‘একটা’ বই আছে বলে ‘আর একটা’ বই কিনতে না চান, তঁাকে দোষ দেওয়া চলে না। এতে তঁার অন্তত প্রত্যক্ষ কোনও ক্ষতিও হয় না। বাস্তবিকই পড়ার বইয়ের বাইরে পড়া এবং বই কেনার সঙ্গে যে অধিকসংখ্যক বঙ্গবাসীর আজ যোগ নেই, তা বোঝার জন্য কলেজ স্ট্রিটে বা জেলার মেলায় সমীক্ষা চালানোর দরকার পড়ে না। নিজের কিংবা পড়শির ঘরে নজর করে দেখলেই হয়। হয়তো এই কারণেই কোভিডের প্রথম লকডাউনে কেরল ভাবতে পেরেছিল ওষুধ দোকানের পাশাপাশি বইয়ের দোকানও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খুলে রাখতে পারার কথা, আমরা পারিনি।
এসবের প্রভাব পড়ে বইয়ের মুদ্রণসংখ্যা বা প্রিন্ট-রানে। তা নইলে গুরুত্বপূর্ণ কোনও কবির একটি কবিতার বই তিনশো কপি কিংবা উৎকৃষ্ট একটি প্রবন্ধের বইয়ের পঁাচশোটি কপি ছাপতে গেলেও কোনও প্রকাশককে এত ভাবতে হত না। বরং প্রিন্ট-রান আরও বাড়ানো গেলে দাম খানিক কমানোর কথাও হয়তো বিবেচনা করা যেত। তার বদলে বাংলা বই বাজারের বড় একটা অংশকেই আজ দঁাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’ (POD)-এর পঞ্চাশ-একশো কপির ছোট ছোট মুদ্রণে নির্ভর করে। বাংলা বই যে কেউ কেনেন না, কেউ পড়েন না, তা মোটেই নয়। কিন্তু নিয়মিত পাঠক বা ক্রেতার সংখ্যা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তামাম বাঙালির মোট সংখ্যার তুলনায় আণুবীক্ষণিক। কাজেই আপামর বাঙালির শীতকালীন বইমেলা-প্রীতি আর বই-প্রীতিকে এক সূচকে মাপতে না চাওয়াই শ্রেয়।
কোনও বইয়ের দাম বেশি না কম, তা কীসের ভিত্তিতে একজন সাধারণ পাঠক বা ক্রেতা অনুমান করেন? উত্তরটা সহজ, সম মানের আর পঁাচটা বইয়ের নিরিখে। কিন্তু বইয়ের ক্ষেত্রে এই ‘সম মান’ বিষয়টি ভীষণরকম আপেক্ষিক। লেখার মান কেমন কিংবা ছাপার ভুল আছে কি না, তা না হয় নজর করলে শিক্ষিত ও দীক্ষিত পাঠকের পক্ষে খালি চোখে বোঝা সম্ভব। কিন্তু কে অত্যাধুনিক সিটিপি (কম্পিউটার টু প্লেট) পদ্ধতিতে বই ছেপেছে আর কে সস্তার ট্রেসিংয়ে– সেই আন্দাজ সহজে মেলা মুশকিল। কিংবা কে ব্যবহার করেছে বাজার চলতি কম দামি বোর্ড, আর কার বই বঁাধানো হয়েছে বিদেশি বোর্ডে– ঝলমলে মলাট ভেদ করে বাইরে থেকে তা বোঝা সাধারণ ক্রেতার পক্ষে প্রায় অসম্ভবই। অথচ আপাত-অকিঞ্চিৎকর এসব পরিবর্তনের জন্যই একটি বইয়ের দাম এক-দেড়শো টাকা বেড়ে যাওয়া আশ্চর্যের নয়। আবার এসব নিরিখে একইরকম হওয়ার পরও হয়তো দেখা যেতে পারে দু’টি বইয়ে দামের বিস্তর ফারাক। কেন? কারণ বাংলা বাজারে অনেক বই-ই হয় লেখকের আংশিক বা সম্পূর্ণ অর্থানুকূল্যে। সেক্ষেত্রে বই বেচে লগ্নি তোলার দায়ও আর থাকে না প্রকাশকের, লেখকও চান বেশি মানুষের হাতে তঁার ‘অমূল্য’ গ্রন্থটি সহজে পৌঁছক। ফলে ধার্য মূল্য রাখাই হয় কম। তার পাশে পুরোদস্তুর পেশাদার ভঙ্গিতে করা বইয়ের দাম খানিক বেশি তো লাগবেই।
লেখকের কাছ থেকে প্রকাশকের হাতে পাণ্ডুলিপি পৌঁছনো আর বিক্রেতার হাত থেকে ক্রেতার হাতে মুদ্রিত বইটি উঠে আসা– এর মাঝে অনেকগুলি ধাপ থাকে, যা পেরিয়ে আসতে হয়। লেখা কম্পোজ করা, সম্পাদনা করা, প্রুফ দেখা, লে-আউট করা, প্রচ্ছদ ডিজাইন করা, ডামি কপি তৈরি, ছাপা, বঁাধাই, দোকানে পাঠানো ইত্যাদি। কাগজের দাম, লেখকের রয়্যালটি– এসব তো আছেই। ‘দানছত্র’, ‘দেশোদ্ধার’, ‘বন্ধুকৃত্য’ কিংবা “দু’-নম্বরি” না করে উক্ত খাতের প্রতিটিতে যদি বাজারের বাকি পেশার ন্যায় সম্মানজনক হারে যোগ্যজনকে যথাযথ মূল্য দিতে হয়, তাহলে বাংলা বইয়ের দাম যেখানে পৌঁছবে, তার কাছে আজকের নিরিখে তথাকথিত ‘দামি’ বইগুলিও তুশ্চু! এসবের সঙ্গে হিসাবে রাখতে হবে বিক্রেতা কিংবা পরিবেশককে দেওয়া ছাড়– মুদ্রিত মূল্যের উপরে যা গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ! সব পাটিগণিত নিয়ম মেনে কষা হয় না বলেই তবু বইয়ের দাম আজও অন্তত কিছুটা আমাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা ইতিবাচক না নেতিবাচক, বলতে পারি না।
তবে কিনা, বাংলা বইয়ের দাম কিছুটা বাড়লেই ক্রেতার মধ্যে যে অস্বস্তি জন্ম নেয়, তাকে পুরোপুরি অমূলক বলাও অন্যায় হবে। গড় বাংলা বইয়ে সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্লেষণের অভাব, প্রামাণ্য হয়ে উঠতে না-পারা, বিষয়বস্তুকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বঁাধতে পারার ব্যর্থতা তাকে আজও ঢের পিছিয়ে রেখেছে। অভিনব বা ব্যতিক্রমী বলে এখানে যেসব বিষয় পরিবেশন করা হয়, আন্তর্জাতিক প্রকাশনার নিরিখে তার মধ্যে ক’টা প্রকৃত অর্থেই অভিনব কিংবা ব্যতিক্রমী? এসবের সামগ্রিক এবং ধারাবাহিক প্রভাবে পাঠক বিভ্রান্ত হচ্ছে। চারপাশে যতই বিজ্ঞাপনী ফানুস উড়ুক, সে নির্দ্বিধায় বইটি হাতে তুলে নিতে ভরসা পাচ্ছে না; অথচ এর চেয়ে ঢের বেশি দ্বিধাহীনভাবে সে একটি ইংরেজি প্রকাশনার বইয়ের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। ফলে নিজেদের নিজেরাই ‘ভাল’ বলে প্রচার করে এক প্রকার আত্মতুষ্টি হয়তো লাভ করা যাচ্ছে, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের দেখা মিলছে না– ভাল জিনিসের মতো তার দামটি ফেলতে গেলেই হাত কেঁপে উঠছে। এই মানসিকতা ও প্রবণতা ঝেড়ে ফেলা জরুরি বলেই মনে হয়।
বাজারের সব ‘ভাল’ জিনিসের দাম বাড়লে ‘ভাল’ বইয়ের দামও বাড়বে। কারণ এর অন্যথা করতে হলে যা করতে হবে, তা হল গুণগত মানের সঙ্গে আপস। পাঠ্যবস্তুর আপস, নির্মাণগত আপস। সামগ্রিক প্রকাশনা পরিমণ্ডলের জন্য তা যেমন স্বাস্থ্যকর নয়, দিনান্তে পাঠকের জন্যও খুব উপকারী কি? দেড় শতকেরও বেশি আগে এক বাঙালি প্রকাশক এই সারকথাটি বুঝেছিলেন। গল্প-কবিতার বই নয়, খাস পাঠ্যপুস্তকের দামই তিনি যা ধার্য করেছিলেন, তাতে শিক্ষা অধিকর্তা ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’-র অভিযোগের ভিত্তিতে ১৮৫৬ সালে এক লম্বা চিঠিতে তঁাকে লেখেন, যেভাবে ক্রমাগত তঁার প্রকাশনীর বাংলা বইয়ের দাম বাড়ছে, তাতে গরিব লোকজনের পক্ষে আর পড়াশোনা চালানো সম্ভব নয়। তঁাকে দাম কমানোর জন্য প্রায় হুমকিই দেওয়া হয়। ওই প্রকাশক রাজি হননি। তিনি পালটা জানান, অনেক ভেবেচিন্তেই এই দাম ধার্য হয়েছে, তা কমানো সম্ভব নয়; এতে তঁার বই বাতিল করা হলেও তিনি অনন্যোপায়। প্রকাশকের নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.