ব্র্যান্ড মোদি আকার পেয়েছিল নরেন্দ্র মোদির পেশিবহুল নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতিকে কোনওভাবেই তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। অথচ, কর্ণাটকের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার দুর্নীতির অভিযোগে যখন বেহাল, তখনও বস্তুত নীরব থেকেছিল কেন্দ্র। আর, কন্নড় মহিলাদের অসন্তোষও বিরুদ্ধে গেল বিজেপির। এবং অবশ্যই গরিব মানুষের ক্ষোভ। বিশ্লেষণে রাজদীপ সরদেশাই
‘আপনি শিওর এবার আমরা সহজেই জিতছি?’ মাঝরাতে ফোনের ওপারে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতার রীতিমতো চিন্তিত স্বর, সঙ্গতে এই প্রশ্ন। কর্ণাটকে ভোটগণনার আগের রাত, আর ‘ইন্ডিয়া টুডে’-র তরফে ‘অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া’ একজিট পোল জানাচ্ছে- কংগ্রেস বড় মার্জিনে জিততে চলেছে। তা সেই নেতাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত চিন্তা করছেন কেন?’
কী বলি, আশ্বাস দেওয়ার পরেও তাঁর হা-হুতাশ থামে না। “তুমি জানো, প্রচারের শেষ ক’টা দিন মোদি কী পরিমাণে ক্যাম্পেন করে গিয়েছেন, আমার তো মনে হচ্ছে, পুরো বাজিটা মেরে দিয়ে গেলেন উনি!” এই প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অজেয় ভাবমূর্তি কতটা গভীরে শিকড় ছড়িয়েছে, যার অন্যতম প্রতিফলন সম্ভবত, ২০১৯-এ সামাজিক মাধ্যমে বিজেপির স্লোগান ‘আয়েগা তো মোদি হি!’ (মোদি ছাড়া আসবে কে!) কিন্তু, কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন ২০২৩-এর ফলাফল মোদি-পরিচালিত বিজেপির অপরাজেয়তার সেই ধারণায় একেবারে কোপ মারল। ঠিক যেভাবে ১৯৮৩-র বিশ্বকাপে ভারত কোপ মেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ক্লাইভ লয়েডের অধিনায়কত্বে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ‘অপরাজেয়’ মনে করা হত।
যদিও এমনটা নয় যে, মোদি থাকাকালীন বিজেপি কোনও নির্বাচন হারেনি। ২০১৮-র ডিসেম্বর মনে করে দেখুন, তিনটে রাজ্যে কংগ্রেস শেষবারের মতো বিজেপিকে ডাহা হারিয়েছিল। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান আর ছত্তিশগড়ে। এরপর কংগ্রেসের মধ্যে এই উত্তেজনার পারদ চড়েছিল যে, হিন্দুময় ভূখণ্ডে বিজেপির একাধিপত্য বুঝি ঝরে পড়ল। কিন্তু, আগামী ছ’মাসের মধ্যে, সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের এই স্বপ্নের বেলুন পাংচার হয়ে যায়। এই রাজ্যগুলোয় বিজেপি একেবারে ধুনে দেয় ঠিক উত্তর এবং মধ্য ভারতের নির্বাচনের মতোই। এবং ২০১৯-এর এই সাধারণ নির্বাচনে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে প্রেসিডেন্ট-সুলভ অর্থাৎ, সেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর মুখই ছিল মূল বিষয়। তাহলে, ২০২৩-এর মে মাস পৃথক হল কোথা থেকে, বিশেষ করে কর্ণাটকে যেখানে বিধানসভা এবং সাধারণ নির্বাচনে ভোটের ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা?
নিঃসন্দেহে, কর্ণাটক সেই জনবহুল রাজ্য, যে-রাজ্যের মানুষজনের কাছে ‘জয় বজরংবলী’ ধ্বনির তুলনায় গ্যাস সিলিন্ডারের দাম অধিক গুরুত্ববহ। কিন্তু, পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, কর্ণাটক ভোটফল সম্পর্কে ভাবতে গেলে বিজেপির যেগুলি ভাবা প্রয়োজন।
প্রথমত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই রাজ্যের নির্বাচনে নিজের অনেকখানি সঁপে দিয়েছিলেন: প্রচারাভিযানের শেষ সপ্তাহে ১৯টা র্যালি এবং ৬টা রোড শো রীতিমতো জাঁকজমকপূর্ণ হয়েছিল, যা থেকে আন্দাজ করাই যায়- বিজেপির রাজনৈতিক কূটের মধ্যে ব্র্যান্ড মোদি-ই ছিল শীর্ষে। গত কয়েক মাসে, প্রায় প্রতি হপ্তায় প্রধানমন্ত্রী কর্ণাটকে থেকেছেন। হয় বিমানবন্দর উদ্বোধন করছেন, বা জাতীয় সড়ক প্রকল্পের শিলান্যাস করছেন, এমনকী, রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধনও করেছেন। ভোটের দিন, কন্নড় ভাষার বেশিরভাগ সংবাদপত্রেই বিজেপির বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল প্রায় পাতা জুড়ে। দেখা গিয়েছিল নরেন্দ্র মোদির পেল্লায় ছবি, আর তা তেমনই পেল্লায় পদ্মচিহ্ন থেকে উদ্ভাসিত। রাজ্যের অন্যান্য বিজেপি নেতা, এমনকী, মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! অনেকটা সিনেমার পোস্টারের মতো, যেখানে মূল ফোকাস মেগা স্টারের উপর, আর বাকি চরিত্রগুলি নিমিত্ত মাত্র। ব্যাপারটা গিয়ে দাঁড়ায় এমন, কর্ণাটকের এই বহুল জনপ্রিয় ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের চালক আদপে একজনই। স্বয়ং মোদিজি!
মনে করুন, ‘ব্র্যান্ড মোদি’ আকার পেয়েছিল তাঁর পেশিবহুল নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতিকে কোনওভাবেই তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। তবুও, কর্ণাটকে, ‘৪০ পার্সেন্ট কমিশন খাওয়া সরকার’ সংক্রান্ত অভিযোগের ছর্রা ফুটছিল যখন, কেন্দ্রের তরফে কোনওরকম ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ইনি, প্রধানমন্ত্রীও টুঁ শব্দটি করেননি। এবং শেষমেশ এই দুর্নীতিকে স্বাভাবিক ও মানুষের মনে গা-সওয়া করে তুলেছিল বিজেপি-চালিত রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি যেখানে বিরোধী-চালিত রাজ্যগুলিতে ছিল ভয়ংকরভাবে তৎপর, সেখানে কর্ণাটকে তাদের টিকিটিও দেখা যাচ্ছিল না। এখন, বিজেপি সরকারও যদি অতীতের কংগ্রেস সরকারের মতোই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে ব্র্যান্ড মোদির জৌলুস ও স্বাতন্ত্র্য উবে যাওয়ারই তো কথা।
দ্বিতীয়ত, ‘অ্যাক্সিস একজিট পোল’ চূড়ান্ত সঠিক অনুমান দেখাচ্ছে, কর্নাটকের মহিলারা বিজেপির তুলনায় কংগ্রেসকে অনেক, অনেক বেশি ভোট দিয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রধান দুই পার্টির মধ্যে যেখানে ভোটদানের ফারাক মাত্র ৫ শতাংশ, সেখানে মহিলাদের ক্ষেত্রে ফারাক ১১ শতাংশ। এরকম দুই সংখ্যার শতকরা হারের ব্যবধান যদি মহিলাদের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়, তাহলে বিজেপিকে অবশ্যই এটা নিয়ে ভাবতে হবে। গত দশক জুড়ে মহিলারাই নরেন্দ্র মোদির ভোটব্যাংকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। শেষ যে রাজে্য বিজেপির বিরুদ্ধে মহিলা ভোট পড়েছিল, সেটা ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গের ভোটে। সেখানে মমতা বন্দ্যাোপাধ্যায় একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কারণে অনেকটা ফারাক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর কর্নাটকে মোদির বিরুদ্ধে মহিলাদের চলে যাওয়ার নেপথ্য কারণ হয়ে দাঁড়াল গৃহস্থালির দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি।
তৃতীয়ত, কর্ণাটকের ফলাফলের নকশায় দেখা যাচ্ছে যে, তুলনামূলক অনগ্রসর এলাকায়, যেখানে মাথাপিছু আয় কম, সেখানে বিজেপিকে হারাতে সক্ষম হয়েছে কংগ্রেস। একজিট পোল নিশ্চিত করেছে যে, যাদের পারিবারিক মাসিক আয় ১০,০০০-এর কম, তারাই কংগ্রেসকে বিজেপির তুলনায় ১১ শতাংশ ভোটে এগিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, গেরুয়া দল ভোট কুড়িয়েছে উচ্চবিত্ত গোষ্ঠী থেকে। বিজেপি কর্নাটকের ১৫টি তফসিলি উপজাতি সংরক্ষিত আসনের একটিও জেতেনি এবং ৩৬টি তফসিলি জনজাতি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে মাত্র ১২টি জিতেছে, কংগ্রেস উভয় ব্লকেই আধিপত্য বিস্তার করছে। এ তো সাম্প্রতিক প্রবণতার বিপরীতে, যেখানে ‘গরিব-দলিত-আদিবাসী’ ভোটাররা বিজেপির সুবিধাভোগী নির্বাচনী ভোটব্যাংকের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে বলে মনে করা হত। যখন গরিব মানুষেরা কোনও এক দলকে ব্যাপকভাবে ত্যাগ করে, তখন কিন্তু বিপদের দুন্দুভি বেজে ওঠে, সেটা আর অস্বীকার করা যায় না।
চতুর্থত, ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দিয়েছে কর্ণাটক। সেই ২০২২ সাল থেকে, কর্ণাটক বিজেপি সচেতনভাবে হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছিল: হিজাব, হালাল এবং আজান নিয়ে বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে মুসলমানদের নিয়মিতভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছিল। টিপু সুলতান সম্পর্কে নানারকম কটূক্তি করে, ও সাভারকরকে পুজো করে সেখানে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ঘটাতে চাইছিল। এমনকী, খ্রিস্টানদেরও ছেড়ে কথা বলেনি। ধর্মান্তর-বিরোধী আইনের লক্ষ্যই ছিল খ্রিস্টান মিশনারি। এইসব প্রচার শুধু সংখ্যালঘু ভোটকেই একত্রিত করেনি, অসংখ্য হিন্দু ভোটারকেও বিচ্ছিন্ন করেছে, যারা সংহতিপূর্ণ সমাজের আশা করে, ভেদাভেদ চায় না। ভোটারদের উদ্দেশ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর হুঁশিয়ারি- কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কর্ণাটক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে আক্রান্ত হবে- আসলেই বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ হয়ে দাঁড়াল বিজেপির কাছে।
শেষত, কর্ণাটকের রায় বিজেপির ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করেছে: ‘বিজেপি-মুক্ত দক্ষিণ ভারত’ এখন এমন একটি বাস্তবতা, যা আবারও ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর সংকীর্ণতাকে উন্মোচিত করে। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার মানচিত্রে এখন দেখা যাবে, বিজেপি এখন অ-বিজেপি দলগুলির তুলনায় কম এলাকা এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। একটি দলের যদি সর্বত্র মাপসই হয়ে ওঠার নেপথ্যে নির্বাচনী কৌশল কাজ করে, সেখানে আঞ্চলিক আবেগ এবং স্থানীয় সংবেদকে ধরতে না পারলে, তার পক্ষে সাংস্কৃতিকভাবে অধিকতর পরিচয়বাহী রাজ্যগুলিতে পা রাখা মুশকিলের।
সে-কারণে বিজেপির নেতৃত্বকে ২০২৪ সালের মধ্যে নানা গলদ শুধরোতে হবে।মোদি-নেতৃত্বাধীন বিজেপি এখনও জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য অপ্রতিরোধ্য, তবে ‘মোদি ছাড়া আবার কে’- ধ্বনিটি বড্ড বেশি উচ্চকিত শোনায়, এই তীব্রতা এবার অন্তত কমুক। জীবন এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে এই প্রবাদ কিন্তু এখনও সত্য- অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই পতনের মূল। লয়েডের ওই সর্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল কিন্তু শেষমেশ হেরেছিল। ১৯৮৩-তে কপিল দেবের দলে কিন্তু তেমন কোনও র্যাঙ্কধারী খেলোয়াড় তখনও ছিলেন না।
পুনশ্চ এই লেখাটা যেহেতু শুরু করেছিলাম এক কংগ্রেসি নেতার ফোন কলের উল্লেখ দিয়ে। লেখাটা শেষ করছি অন্য একটা ফোন কলের কথা লিখে। এক সিনিয়র বিজেপি নেতা আমাকে ফোন করে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া সেলের প্রধান অমিত মালব্য আমাকে টিভিতে সম্প্রচারকালে কংগ্রেসের ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ বলেছিলেন, এবং বলেছিলেন- আমি যেন দ্রুতই অবসর গ্রহণ করি। এই কথার জন্য তিনি ক্ষমা চেয়ে বলেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত তাঁর (অমিত মালব্য) এই মন্তব্যের জন্য। আমাদের আরও সুন্দরভাবে হার মেনে নেওয়া শিখতে হবে।’ স্বীকার করেছিলেন বিজেপির এই নেতা। আহা!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.