সংঘমিত্রা কাঞ্জিলাল ভাদুড়ী, সুচেতা সরদার: ২৪ মার্চ, ২০২০। থিতু হওয়ার নামমাত্র সময় দিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশজুড়ে লকডাউন জারি করে। লক্ষ্য: ‘কোভিড ১৯’-এর সংক্রমণে লাগাম আনা। কিন্তু ফলাফলে ঘটল আরও কিছু। ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ (সিএমআইই) নামের একটি স্বাধীন সংস্থা, যারা অর্থনৈতিক সূচকের পরিমাপ-পরিস্থিতি নিয়ে মাথা ঘামায়, তাদেরই একটি সমীক্ষা থেকে আমরা জানতে পারছি- এই লকডাউনের অভিঘাতে দেশজুড়ে প্রায় ১২.২ কোটি মানুষ অর্থাৎ ৩০.৫ শতাংশ চাকরিজীবী জীবিকা হারান ২০২০-র এপ্রিলে। শুধুমাত্র ওই মাসে দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা হয় ৫ কোটি ২৫ লক্ষ। ২০২০-র এপ্রিল-মে মাসে বেকারত্বের হার বিগত মাসের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বাড়ে। অর্থাৎ ৭ শতাংশ থেকে তা পৌঁছয় ২৩ শতাংশে। ২০২০-র ২২ মার্চ দেশে চাকরি পাওয়ার হার ছিল ৩৯.১ শতাংশ। যা ৩ মে তারিখে ২৬.৪ শতাংশে মুখ থুবড়ে পড়ল। সেখান থেকে আবার জুন মাসের ২১ তারিখে দেখা গেল সংখ্যাটা বেড়ে ৩৭.৮ শতাংশ হয়েছে (দেব ও সেনগুপ্ত, ২০২০)। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের কালে ৫৭ শতাংশ গ্রামীণ শ্রমিক ও ৮০ শতাংশ শহরের শ্রমিক কাজ হারিয়েছিলেন। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক গ্রামে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। আমরা দেখি, সেই শ্রমিকরা দিনের পর দিন হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরে আসতে কত উন্মুখ। এই চরম অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা আমরা দেখলাম লকডাউন জারি হওয়ার প্রথম সপ্তাহের পর থেকেই। যা প্রমাণ করে, এই মানুষগুলোর জীবন কতখানি অনিশ্চয়তায় ভরা। লকডাউন-পরবর্তী চাকরি চলে যাওয়ার ঘটনায় সামাজিক বৈষম্য হাতেনাতে ধরা পড়েছে। লকডাউন থিতু হওয়ার ফলে এই বৈষম্য খানিকটা কেটেছে বটে, কিন্তু আজও চাকরির হার এবং পারিশ্রমিক লকডাউন-পূর্ব সময়ের তুলনায় যথেষ্ট কম।
‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ভারত জুড়ে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে সবরকম জাতির মানুষই লকডাউনের প্রথম দফায় কাজ হারালেও, তফসিলি জাতি বা এসসি-ভুক্ত মানুষরা চাকরি খুইয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এর ব্যাখ্যা বিশিষ্ট অধ্যাপক অশ্বিনী দেশপান্ডের বক্তব্যেই ধরা পড়বে। তঁার একটি গবেষণাপত্রে তিনি লিখছেন, বৈষম্যজনিত প্রভাবের সূত্রপাত ঘটে নিচু শ্রেণির মনুষ্যবর্গ থেকে, যেখানে মানব-পুঁজি বা ‘হিউম্যান ক্যাপিটাল’ সবচেয়ে কম। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করানোর ক্ষেত্রে নিচু জাতের মানুষকেই সবচেয়ে বেশি ভিড়িয়ে দেওয়া হয়। (দেশপান্ডে ও রামচন্দ্রন, জুলাই ২০২০ গবেষণাপত্র)। ভারতে জাতিভেদের এই তীব্র উপস্থিতি জাতিভিত্তিক বৈষম্যকেই পুষ্ট করে। সঙ্গে আছে অত্যাচার। বাবাসাহেব আম্বেদকরের কথা ধার নিয়ে বলা যায়, এই জাতিমগ্ন সমাজে মানুষ জন্মায়ই ‘অসম’ বা ‘আন-ইকুয়াল’ হয়ে এবং তাকে সেভাবেই রেখে দেওয়া হয়। এ হল শ্রেণিবিভক্ত সমাজের মূলগত সমস্যা। যেখানে, আরোপিত কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণি বা জাতির মানুষ অন্য মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করবে। এই শ্রেণিসংবলিত সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের অধিকার হরণ করা প্রাথমিক অস্ত্র।
‘লেবার ব্যুরো’-র তরফে ‘ফিফথ অ্যানুয়াল এমপ্লয়মেন্ট সার্ভে অফ ২০১৫-২০১৬’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট তৈরি হয়। সেই নথিতে ‘ইউজুয়াল প্রিন্সিপাল স্টেটাস’ অনুযায়ী, শ্রমিক-জনসংখ্যার অনুপাত তফসিলি জাতির ক্ষেত্রে ৫০.৬ শতাংশ। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ক্ষেত্রে ৪৭.৮ শতাংশ এবং তফসিলি আদিবাসী শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে ৫৪.২ শতাংশ। যদিও প্রায় তফসিলি-ভুক্ত অর্ধেক মানুষই কাজের সঙ্গে যুক্ত, তবু সেই শ্রেণির মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ দৈনিক কাজের সুবিধা পান, যে-কাজ চুক্তিভিত্তিক, অস্থায়ী এবং সুরক্ষা ও নিশ্চয়তাহীন। এই বৈষম্যকে ব্যাখ্যা করা যাবে ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ প্রদত্ত সমীক্ষা থেকে। দেখা যাবে, ১২ বছরের বেশি স্কুলে পড়ার সুবিধা উচ্চ জাতের মানুষের ক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশ, সেখানে তফসিলি জাতির ক্ষেত্রে মাত্র ১৭ শতাংশ। উঁচু জাতের সন্তানের ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষালাভের সুযোগ-সুবিধা বেশি, ফলে, একটা চাকরি জুটিয়ে সুরক্ষিত জীবন বঁাচার, অর্থনৈতিক বিপন্নতার সময় কোনওক্রমে টিকে যাওয়ার সুযোগও এই উঁচু জাতের ক্ষেত্রে অনেক বেশি। ঠিক একইরকমভাবে লকডাউনের সময়ও এই উঁচু জাতের মানুষ পার পেয়ে গিয়েছেন যে কোনও প্রকারে। এই অতিমারী আবার প্রমাণ করে দিল যে শ্রেণি ও জাতিবৈষম্য কতখানি তীব্র আজও। দেখিয়ে দিল, এই সময়টায় সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছেন এই অনগ্রসর শ্রেণির মানুষরাই। চাকরি খোয়ানোর ঘটনায় লকডাউন-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত উঁচু জাতের মানুষরাই। ক্রমশ তা তফসিলি উপজাতি (এসটি), তারপর অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি)-র দিকে ঝুঁকেছে এবং শেষে সর্বাপেক্ষা বিপর্যস্ত করেছে, দেখা যায়, তফসিলি জাতি (এসসি)-কে। এই বিপর্যয়ের নিরিখ ২০১৯-এর একই সময়ে চাকরির হাল-হকিকতের সঙ্গে তুলনা করে। বেকার হিসাবে উঁচু জাতের মানুষের সংখ্যা এই সময় জুড়ে যেমন ছিল, তেমনই থেকেছে প্রায়। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নিচু জাতের মানুষরাই। ২০১৯ সালের জুন-আগস্ট জুড়ে উঁচু শ্রেণির বেকারত্বের হার ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি, যা ২০২০-র ওই একই সময়ে বেড়ে হয় ১৩ শতাংশ। সেখানে ওবিসি-র বেকারত্ব এই এক বছরের হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় তিনগুণ। ৬.৭ শতাংশ থেকে ১৭.২ শতাংশ! এসসি জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এর বৃদ্ধি প্রায় ৪ গুণ। ৬.২ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ! আর, এসটি-ভুক্ত মানুষদের ক্ষেত্রেও কিছু কম নয়, ৫.২ শতাংশ থেকে ১৬.৩ শতাংশ!
শহরাঞ্চলে গড়পড়তা ও নিম্ন-পারিশ্রমিকের কাজের সঙ্গে এসসি-রা যুক্তি বেশি করে। জাতপাতের বৈষম্য, অত্যাচার ও দারিদ্র থেকে মুক্তি পেতে তঁারা শহরাঞ্চলে পালিয়ে আসেন। ঘটনাচক্রে, অতিমারীর প্রভাব শহরাঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি পড়ল গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায়। কিন্তু এসবের মধ্যেও শহর হোক বা গ্রামে, উঁচু জাতের লোকজন সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। দুই জায়গাতেই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন নিচু জাতের মানুষরাই। লকডাউন চলাকালীন এমন বহু চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে বরখাস্ত করা হয়েছে। অনেকেই প্রধানমন্ত্রী রিলিফ প্যাকেজ পাননি। যেহেতু, শহরাঞ্চলে চলে আসার বিষয়ে আলাদা করে তঁাদের নাম নথিবদ্ধ করা নেই। ২০২০-র অক্টোবরে করা পাঞ্জাবের একটি গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, মূলত শহুরে পাঞ্জাব এলাকায়, লকডাউনের বিভিন্ন স্তরে পারিশ্রমিক ও চাকরির গতিপ্রকৃতি কীভাবে বদলে বদলে গিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, এসসি ও ওবিসি-ভুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক হ্রাস ও চাকরি খোয়ানোর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ফলে, সাধারণ শ্রমিক পরিবারগুলি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল। ‘সেন্টার ফর ইকোনমিক পারফরম্যান্স’-এর তরফে ২০২০-র মে ও জুলাই মাসে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল দেশের শহরাঞ্চলের ৮৫০০ শ্রমিকদের মধ্যে– যঁাদের বয়স ১৮-৪০। অতিমারীর কালে তঁাদের কাজ করার অভিজ্ঞতা জানা-ই ছিল এই সমীক্ষার লক্ষ্য। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৫.৫ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষকে পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করে যেতে হয়েছিল বা বসে থাকতে হয়েছিল। কোনওরকম আর্থিক সাহায্য তঁারা পাননি। শহরাঞ্চলের শ্রমিকদের ৭০ শতাংশের ন্যূনতম কাজের দিনের কোনও ঠিক-ঠিকানাই ছিল না বছর জুড়ে। ‘কোভিড ১৯’ এসে দেশের শ্রমিকের বেতন বৈষম্য আরও বর্ধিত করল। কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় যেখানে উচ্চ শ্রেণির চাকুরের ১৬ শতাংশ আয়বৃদ্ধি হল তিনমাসের মধ্যে, উল্টোদিকে নিচু শ্রেণির কর্মীদের ক্ষেত্রে বেতন হ্রাস পেল প্রায় ৪৮ শতাংশ। ২০২০-র জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির নিরিখে ঠিক এমন হিসাবই মিলবে।
বৈষম্যের এই অবাধ গতি রুখতে ‘ন্যাশনাল পলিসি কমিটমেন্ট’ গঠন করা খুব জরুরি, যেখানে এই আয়-হ্রাস কীভাবে রোখা যেতে পারে, তা নিয়ে ভাবা হবে। যাতে এই শ্রমিক শ্রেণির মানুষ চরম দারিদ্র ও অনির্দিষ্টকালীন বেকারত্ব থেকে মুক্তি পান। এমন সংকটময় সময়ে শহরাঞ্চলে জব গ্যারান্টি স্কিম প্রণয়ন করাও জরুরি। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য ১০০ দিনের কাজ বা ‘মনরেগা’-র মতো প্রকল্প গ্রামীণ অঞ্চলে চালু করার জন্য আলোচনায় বসেছে। যাতে এখনকার অতিমারী প্রকোপ বা আগামীর অর্থনৈতিক ধাক্কা এই মানুষগুলির জীবন সামলে উঠতে পারে। যাতে নিরাপত্তাহীনতা মাথায় না চেপে বসে।
‘কোভিড ১৯’ ও লকডাউন কালে দৃশ্যমান এই জাতিভিত্তিক বৈষম্যের নমুনা দেখে অবাক হওয়ার আসলে কিছু নেই। এই বৈষম্য ভারতে ছিল সবসময়। লকডাউন সেই বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে। লকডাউন সাক্ষী থাকল সেই বাঁধাধরা ছল-কাপট্যের, যার মাধ্যমে আজও জাতিভেদ রমরমিয়ে কার্যকর। এবং তা আজও দলিত ও তফসিলি জাতির মানুষদের মৌলিক অধিকার থেকে ব্রাত্য করে রেখেছে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখকদ্বয় পোস্ট ডক্টরাল স্কলার, আলগার্ভে বিশ্ববিদ্যালয়, পতুর্গাল
অর্থনীতির অধ্যাপক শারদা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected], [email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.