ফাইল চিত্র
একের-পর-এক শ্বেতাঙ্গিনী, একটু রোগা, চুলের রং বাদামি ঘেঁষা কালো– এমন মহিলাদের গলা টিপে খুন করেছিল কেন্ডাল ফ্রাঙ্কো। গড়পড়তা সিরিয়াল কিলিংয়ের গল্প এটা হতেই পারত, কিন্তু তখনই মঞ্চে প্রবেশ সাংবাদিক ক্লদিয়া রো-এর। ফ্রাঙ্কোকে নিয়ে লিখলেন তাঁর বই ‘দ্য স্পাইডার অ্যান্ড দ্য ফ্লাই’। প্রশ্ন জাগে, এখানে কে সেই শিকারি ঊর্ণার ফাঁদ পেতে বসে থাকা মাকড়সা, আর জালে ধরা দিতে না-চাওয়া মক্ষিকাই বা কোনজন? লিখছেন ঋত্বিক মল্লিক
১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস। কিছুদিন আগেই এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছে ক্যাটিনা নিউমাস্টার, বছর পঁচিশের এক যুবতী। তারই তদন্তের কাজে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় দঁাড়িয়েছিল দুই ডিটেকটিভ ম্যানাইন আর ম্যাকরেডির গাড়ি। আচমকা হন্তদন্ত হয়ে এক মহিলা এসে খবর দিলেন– একটা চলন্ত গাড়ি থেকে একটু আগেই প্রায় ঝঁাপ মেরে তিনি পালিয়ে যেতে দেখেছেন একটি মেয়েকে, গাড়ির লোকটাকে তঁার মোটেই সুবিধার ঠেকছিল না।
খবর শোনামাত্র গাড়ি ছুটল সেদিকে, পাওয়াও গেল সেই মেয়েকে, নাম ক্রিস্টিন সালা। ভয়ে তখনও থরথর করে কঁাপছে মেয়েটা। হামলার কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলল ক্রিস্টিন, অল্প বয়স থেকেই ড্রাগের খপ্পরে জড়িয়ে পড়েছে সে। সেই টোপ ফেলেই সাতসকালে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় অভিযুক্ত, কেন্ডাল ফ্রাঙ্কো। গাড়ি গ্যারেজে ঢোকানো মাত্র ক্রিস্টিনের কাছে আসে যৌন প্রস্তাব। রাজি না-হওয়ায় প্রথমে এক ঘুসিতে ক্রিস্টিনকে শুইয়ে দেয় ফ্রাঙ্কো, গলা টিপে ধরে। তারপর চুলের মুঠি ধরে গাড়ি থেকে বের করে এনে তার মুখে ঠুসে ধরার চেষ্টা করে নিজের যৌনাঙ্গে। সেই সঙ্গে টানা ঘড়ঘড়ে গলার চিৎকার– ‘আজ তোকে মেরেই ফেলব, পুঁতে দেব এখানেই।’ বিপদ বুঝে ক্রিস্টিন ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করে ফ্রাঙ্কোকে, বলে, ফ্রাঙ্কোর প্রস্তাবে সে রাজি, তার শুধু ড্রাগটা চাই। ফ্রাঙ্কোকে সঙ্গে নিয়েই আবার গাড়িতে উঠে বসে ক্রিস্টিন, মূল রাস্তায় গাড়ি ওঠামাত্রই দরজা খুলে লাফ মেরে পালায় সে। পরের ঘটনা জানা। দৃশ্যতই হতবাক ডিটেকটিভরা ফ্রাঙ্কোর সম্পর্কে খেঁাজখবর করতে গিয়ে আরও অবাক হলেন। গত বছর দুয়েক ধরেই বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে অভব্য আচরণের জন্য ভূরি ভূরি অভিযোগ এসেছে তার নামে, একবার গ্রেপ্তারও হয়েছে সে।
বেশিরভাগ অভিযোগই কিন্তু আসছে যৌনকর্মীদের থেকে। সেবার পরপর বেশ কিছু যৌনকর্মীর নিখেঁাজ হওয়ার খবর আসায়, তদন্তে নেমে পুলিশ বিভাগের গোয়েন্দা বিল সিগ্রিস্ট দেখেন, স্ট্রিট প্রস্টিটিউটের অনেকেই স্থানীয় একটা লোকের কথা বলছে, যার নাম ফ্রাঙ্কো। মেয়েদের প্রতি অত্যন্ত রুক্ষ ব্যবহার, চড়া মেজাজ আর বিছানায় ভয়াবহ রকম হিংস্র। টাকাকড়ি নিয়ে ঝঞ্ঝাট হওয়ায় একটি মেয়েকে গলা টিপে প্রায় মেরে ফেলার জোগাড় করেছিল ফ্রাঙ্কো, তখনই একবার হাজতবাস হয় তার।
এবার কিন্তু আর বিষয়টা ফেলে রাখতে চাইলেন না ডিটেকটিভরা। রহস্যর গন্ধ ঘনীভূত হওয়ার অঁাচ পেয়ে সরাসরি তঁারা হানা দিলেন ফ্রাঙ্কোর বাড়িতে, ৯৯ ফুলটন স্ট্রিট।
পুলিশ রিপোর্ট বলছে, বাড়িটার হল থেকে শুরু করে ঘরের সর্বত্র আবর্জনা একেবারে ঠাসা, ফঁাকা বোতল, পচে গন্ধ ওঠা খাবারের অবশেষ, জামাকাপড়ের স্তূপ, পুরনো খবরের কাগজ আর ভাঙা আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিল যেখানে-সেখানে। ক্যাবিনেট, সিঙ্ক, আলমারিগুলোতে জঞ্জাল বোঝাই। দুর্গন্ধর চোটে ইনভেস্টিগেটরদের অবস্থা কাহিল, শেষে মাস্ক পরে ঢুকলেন তঁারা। একটু খেঁাজাখুঁজি করতেই বাড়ির চিলেকোঠা থেকে পাওয়া গেল বছর ৩৪-এর এক মহিলার দেহ, তিনি যে নিখেঁাজ, সেই খবরটাই যদিও ছিল না পুলিশের কাছে।
শুরু হল ট্রায়াল। আশ্চর্যের ব্যাপার, পুরো পর্ব জুড়ে পুলিশের সঙ্গে বিন্দুমাত্র অসহযোগিতা করেনি ফ্রাঙ্কো। কোনও অনুশোচনা, রাগ, দুঃখ বা বিন্দুমাত্র চিত্তবিক্ষেপ দেখা যায়নি তার মধ্যে। অত্যন্ত স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি– এরকম ঠান্ডা অভিব্যক্তি নিয়ে গড়গড় করে নিজের অপরাধের ইতিহাস বলে যেত কোর্টে দঁাড়িয়ে, যেন অপরাধী নয়, বরং সে-ই অপরাধের সাক্ষী। শিউরে উঠল সবাই, যখন জানা গেল একটা নয়, দুটো নয়, এই দু’-বছরে মোট আটটা খুন করেছে এই কেন্ডাল ফ্রাঙ্কো। যে-দেহটি পাওয়া গিয়েছে তার বাড়ি থেকে, সেই অড্রে পুগলিজ-ই তার অষ্টম শিকার। সিরিয়াল কিলিংয়ের প্যাটার্ন পুনরাবৃত্তির তত্ত্ব মেনে এক্ষেত্রেও দেখা গেল, একটা নির্দিষ্ট টাইপ ছিল এই খুনের নেপথে্য।
খুন হওয়া সমস্ত মহিলাই শ্বেতাঙ্গী, শারীরিক গড়ন একটু রোগার দিকে, চুলের রং বাদামি ঘেঁষা কালো, প্রত্যেককেই খুন করা হয়েছে গলা টিপে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌনমিলন চলাকালীন খুনটা হয়েছে বিছানায়, আর দেহগুলো একের পর এক পুঁতে রাখা হয়েছে ওই চিলেকোঠার ঘরে আর বেসমেন্টে।
গল্পটা এখানেই থেমে যেতে পারত, আর পঁাচটা সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনা যেমন রোমাঞ্চ হারায় ‘হু-ডান-ইট’ রহস্যর উন্মোচনের দিন থেকেই। কিন্তু ঠিক এই সময় কাহিনিতে ঢুকে পড়লেন ক্লদিয়া রো, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর তৎকালীন সাংবাদিক, আর হঁ্যা, শ্বেতাঙ্গী, শারীরিক গড়ন একটু রোগার দিকে, চুলের রং বাদামি ঘেঁষা কালো! রো এসেছিলেন এই হাড়-কঁাপানো সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে একটা জমজমাট স্টোরির প্রত্যাশায়। কিন্তু ফ্রাঙ্কোর মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্ত থেকেই আমূল বদলে গেল সব। রো লিখছেন, “Staring up at the Francoise’s front porch that sultry September morning, blood in my veins turns to ice water, I knew I was looking at a story that would prove Derrick wrong…”।
এখানে উল্লিখিত ডেরিক তখন ক্লদিয়ার প্রেমিক। ডেরিকের দাবি ছিল, সাংবাদিকরা কখনওই সত্যিকারের লেখক হয়ে উঠতে পারে না। ক্লদিয়া ঠিকই বলেছেন, ডেরিকের এই আলটপকা মন্তব্যকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এর পরবর্তী চার বছর ধরে টানা তিনি কথা বলবেন ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে, সময় কাটাবেন, মিশবেন, ক্রমশ টের পাবেন তঁার ব্যক্তিত্ব গ্রাস করে ফেলছে এই কেন্ডাল ফ্রাঙ্কো, অপরাধ আর অপরাধী-সংক্রান্ত সমস্ত সামাজিক ভাল-মন্দ, হঁ্যা-না, সাদা-কালোর বোধ গুলিয়ে যাচ্ছে তঁার। আর এই অদ্ভুত কথোপকথনের সাক্ষী হয়ে থাকবে তঁার বই, ‘দ্য স্পাইডার অ্যান্ড দ্য ফ্লাই’; ‘সত্যিকারের লেখক’ বনে যাবেন ক্লদিয়া রো।
প্রশ্ন জাগে, এখানে কে সেই শিকারি ঊর্ণার ফঁাদ পেতে বসে থাকা মাকড়সা, আর জালে ধরা দিতে না-চাওয়া মক্ষিকাই বা কোনজন? বেশ, ব্যাপারটা অতটাও সরলরৈখিক নয়। বইয়ের পাতাজুড়ে প্রতি মুহূর্তে যেন সত্তার অদলবদল ঘটে চলেছে ক্লদিয়া আর ফ্রাঙ্কোর। ক্লদিয়া যত টের পাচ্ছেন, তিনি ঠিক ওই খুন হয়ে যাওয়া মেয়েগুলোর মতো, ততই ভিতরে ভিতরে অসাড় বোধ করছেন, আর ফ্রাঙ্কোর ভয়ানক জবানবন্দির জাল থেকে পালিয়ে ফেরা মাছিটির মতো নিজের ভনভনানি ঘুরে মরছে তঁারই চারপাশে, হাহাকার হয়ে।
ফ্রাঙ্কোরই কি মুক্তি আছে? পুরনো ফ্ল্যাশব্যাক একের-পর-এক ভেসে ওঠে তার সামনে। স্টুডেন্ট মনিটরের চাকরিতে থাকার সময় ছোটাছুটি, পরিশ্রম ভালই করতে হত ফ্রাঙ্কোকে; পরিশ্রান্ত, ঘর্মাক্ত, কালো চামড়ার ফ্রাঙ্কোর গায়ের গন্ধ নিয়ে দিনের-পর-দিন নিষ্ঠুর রসিকতায় শ্বেতাঙ্গ ছাত্ররা তার নামই দিয়ে দিল, ‘স্টিংকি’। ছাত্রীদের কাউকে কাউকে যে মনে ধরেনি কখনও, তা নয়। কিন্তু তারাও এমন ঘৃণা করত, যেন ফ্রাঙ্কো একটা দানব। সেও স্পষ্ট টের পেতে থাকে, তার জীবনের গল্প, অপরাধের বর্ণনা, সমস্তই যত না সাংবাদিকের রিপোর্ট, তার চেয়ে ঢের বেশি এই মেয়েটির নিজেকে চিনতে পারার পাসওয়ার্ড। ক্লদিয়ার নিজস্ব হতাশা, অবসাদ, পরাজয় সেই কাহিনির মূল প্লট। তারই জালে জড়িয়ে পড়া এই মেয়ের প্রশ্নের সামনে একসময় অসহায় বোধ করতে থাকে ফ্রাঙ্কো। নিজের জায়গায় হাতে পেলে এই মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলতে তার কয়েক মিনিটও লাগত না।
নিজের বদ্ধ, অন্ধকার, বন্দি জীবনের কঁাধে বন্দুক রেখে ক্লদিয়ার এই আত্ম-উন্মোচনের খেলা ক্রমশ অসহ্য হয়ে ওঠে ফ্রাঙ্কোর কাছে। সে শর্ত দেয়, ক্লদিয়ার শরীরের নিবিড়তম বর্ণনা বলতে হবে তাকে, প্রেমিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অন্তরঙ্গতম মুহূর্তের খুঁটিনাটি বিশদে শুনতে চায় সে, তবে ভেবে দেখবে বাকি কথা বলা যায় কি না– “You want to go into the depths of my mind and into my past. I wanted a peek into yours. It is only fair, isn’t it?”
ক্লদিয়া এই পর্যায়ে একের-পর-এক চিঠি লিখবেন ফ্রাঙ্কোকে। টের পাবেন, একসময় এই চিঠি লেখার মধ্যে আশ্চর্য যৌনগন্ধী পরিতৃপ্তি হচ্ছে তঁার। এক অপরাধীর গোপন জবানবন্দি জনসমক্ষে আনার পথে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধবোধ যেটুকু জমেছিল, নিজের গোপনীয়তার সবটুকু বলে ফেলার, সব জানিয়ে দেওয়ার উল্লাস ক্রমশ তাকে ছাপিয়ে উঠছে। পরস্পরের ‘প্রিভেসি ভায়োলেশন’-এর এই দ্বিবিধ খেলায় মিশে যাচ্ছে কেন্ডাল ফ্রাঙ্কোর কথা বলার ছাড়পত্র। ফ্রাঙ্কোকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ক্লদিয়া, ‘কেন করলে এতগুলো খুন?’ আশ্চর্য একখান জবাব দিয়েছিল ফ্রাঙ্কো– ‘Killing seemed easier than getting into a relationship!’
ভালোবাসার নাম দিয়ে শুরু হওয়া সম্পর্কগুলোর ভিতরে জাল বিছিয়ে বসে থাকা এই আগ্রাসী মাকড়সার হাত থেকে পালিয়ে ফেরা মাছিটির মতো হতভাগ্য খুনে জীবন নিয়ে ফ্রাঙ্কো শেষ পর্যন্ত মারা যায় ২০১৪ সালে, ৪৩ বছর বয়সে, এড্স হয়েছিল তার। কিন্তু তার জবানবন্দি পাথর হয়ে চেপে থাকে ক্লদিয়ার বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে। কালো মানুষের ব্লুজ নয়, যে শুনতে ভালবাসত হোয়াইট পপ, ভালবাসা ছাড়া আর কোনও যোগ্যতাই যার ছিল না, ভালবাসার বদলে ঘেন্নার কুয়াশা অন্ধ করে দিয়েছে যাকে, ভয়াবহ ভালোবেসে যে ভয়াবহ খুন করে গিয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.