Advertisement
Advertisement
CPM

ভোট ও জোটের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে কোথায় দাঁড়িয়ে কংগ্রেস?

কংগ্রেসকে সবাই ‘বোঝা’ বলেই মনে করছে আঞ্চলিক দলগুলি।

Her is how Congress stands as regional parties grow in strength | Sangbad Pratidin

ফাইল ছবি

Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:October 26, 2021 7:20 pm
  • Updated:October 26, 2021 7:27 pm  

রাজ্যে রাজ্যে ফের আঞ্চলিক দলগুলির শক্তি বাড়ছে। এসব আঞ্চলিক শক্তি কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে যেতে নারাজ। কংগ্রেসকে সবাই ‘বোঝা’ বলে মনে করছে। এমনকী, কেরল ছাড়াও সিপিএমের অন্যান্য রাজ্যের নেতারা আর কংগ্রেসের বোঝা টানতে রাজি নন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নেতারা নাকি কেন্দ্রীয় কমিটিতে সীতারাম ইয়েচুরির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের শেষে বলা হল, সীতারাম ইয়েচুরির ‘লাইন’-ই টিকে রইল। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

একটু আচমকাই ফের সিপিএমে প্রশ্ন উঠল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে। আপাতত সিপিএম সীতারাম ইয়েচুরির লাইনেই থাকছে। অর্থাৎ কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের জোট থাকছে। কিন্তু সিপিএমের আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে যে নীতিবদলের সমূহ সম্ভাবনা, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের (CPM) ভোট চার শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। তারা প্রায় এসইউসিআই-কে ছুঁইছুঁই। সরকার থেকে চলে যাওয়ার পর সিপিএমের যে এই হাল হবে, সেই ভবিষ‌্যদ্বাণী ছিল না, তেমনটা নয়। দলটা এতটাই সরকার ও সরকারি পরিষেবায় উপকৃতদের উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল, তাতে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। সেটাই এখন ঘটেছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে কী লাভ হবে, এবং জোট ভেঙে দিয়েই বা দলের সামনে কী সুযোগ খুলে যাবে, তা নিয়ে বিতর্ক করাটা কিছুটা অবান্তরও। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের শেষে বলা হচ্ছে সীতারাম ইয়েচুরির ‘লাইন’-ই টিকে রইল, অর্থাৎ, দলের যেটুকু শক্তিই থাক, তা নিয়ে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের রাস্তায় বহাল থাকবে। কিন্তু কয়েক দিন আগেই রাজ্যে এসে এই সীতারামই ঘোষণা করে গিয়েছিলেন- ‘ভোট শেষ, জোট শেষ।’ ভবানীপুর উপনির্বাচনে জোট হয়নি। সামনে যে চারটি কেন্দ্রে ভোট আছে, সেখানেও জোটের অস্তিত্ব নেই। তবুও বিতর্কের স্বার্থেই বিতর্ক জারি থাকছে।

[আরও পড়ুন: কাশ্মীরে হঠাৎ আলোর ঝলকানি? অরুণ মিশ্রর শাহ-বন্দনা কতটা যুক্তিযুক্ত]

কেরলে সিপিএম নেতারা জোটের ঘোর বিরোধী। সেটাই স্বাভাবিক। কেরলে এখনও বাম ও কংগ্রেসের মধ্যে লড়াই। কেরলের নেতারা যে সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে কখনওই স্বস্তিবোধ করেন না, তা বলা বাহুল‌্য। তবে কংগ্রেসের (Congress) দিক থেকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিস্ময় হল, দেশের কোনও রাজনৈতিক দলই আর তাদের সঙ্গে জোটে আগ্রহী নয়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত বলা হচ্ছিল তৃতীয় ফ্রন্টের পরীক্ষা প্রবলভাবে ব‌্যর্থ। দেশে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি দু’টি। বিজেপি ও কংগ্রেস। আইডেনটিটি পলিটিক্সের উপর ভিত্তি করে রাজ্যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থান হচ্ছিল, তারা ক্রমশ দুর্বল হবে বলে মনে করা হচ্ছিল। বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির বিপরীতে কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্তিকরণের রাজনীতিই প্রাসঙ্গিকতা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু দ্রুতই দেশের রাজনীতির পট বদলে যাচ্ছে।

রাজ্যে রাজ্যে ফের আঞ্চলিক দলগুলির শক্তি বাড়ছে। এই আঞ্চলিক শক্তি আর কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে যেতে নারাজ। কংগ্রেসকে সবাই ‘বোঝা’ বলে মনে করছে। এমনকী, কেরল ছাড়াও সিপিএমের অন্যান্য রাজ্যের নেতারা আর কংগ্রেসের বোঝা টানতে রাজি নন। পশ্চিমবঙ্গের নেতারা নাকি কেন্দ্রীয় কমিটিতে সীতারাম ইয়েচুরির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সেটা হতেই পারে। প্রকাশ কারাতকে নিয়ে এ রাজ্যের সিপিএম নেতাদের একটি বড় অংশের আগে থেকেই কিছু আপত্তি রয়েছে। এ রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর নেপথ্যে অনেকে প্রকাশের ভুল রাজনৈতিক লাইনকেই দাঁড় করায়। নিছক প্রকাশ-বিরোধিতা থেকে এ রাজ্যের সংখ‌্যাগরিষ্ঠ সিপিএম নেতারা হয়তো সীতারামের পাশে। কেউ কেউ বলছেন, দলে বাংলা ও কেরলের চিরদ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ এটা। কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে যে রাজ‌্য নেতাদেরও খুব একটা আগ্রহ নেই, তা বলাই যেতে পারে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ভোটে বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি বলে মনে করেন এ রাজ্যের সিপিএম নেতারা। ঐতিহ্যগতভাবে সিপিএমের এ রাজ্যের যে সমর্থন ভিত্তি, তা প্রধানত দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের বিরোধিতার উপর। ফলে বাম ভোটারদের কংগ্রেসকে ‘ভোট’ দিতে বলা মানে, তাঁদের উপর একটি বিড়ম্বনা তৈরি করা। আবার কংগ্রেস সমর্থকদের বামকে ভোট দিতে বলা মানে তাঁদের প্রতি নির্যাতন করা। কংগ্রেস রাজনীতি এ রাজ্যে বরাবর দাঁড়িয়ে থেকেছে বাম-বিরোধিতাকে পুঁজি করে। এ রাজ্যে বাম-কংগ্রেস জোট মানে যে, দু’পক্ষের কাছে নিজেদের দীর্ঘদিনের রাজনীতিকে লঘু করে দেওয়া, তা নিয়ে সংশয় নেই। জোট-রাজনীতির উপর দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে যে ভোট টানা যাচ্ছে না, তা পরপর কয়েকটি নির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে। বরং জোট রাজনীতির যত প্রচার হয়েছে, তত ভোট বেড়েছে তৃণমূলের।

পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতিতে যেমন ঐতিহাসিকভাবে কংগ্রেস বিরোধিতার যুক্তি স্পষ্ট, তেমন এই রাজ্যে তৃণমূলের উত্থান কংগ্রেসের আপসকামিতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। বাম জমানায় রাজ‌্য কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব চূড়ান্ত লড়াইয়ে যেতে নারাজ ছিল। তার প্রতিবাদ করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান। এই ইতিহাস আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে অন‌্যান‌্য আঞ্চলিক শক্তির কাছেও কংগ্রেস যেভাবে ব্রাত‌্য হয়ে পড়ছে, তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক উপনির্বাচন ঘিরে বিহারেও কংগ্রেসের সঙ্গে লালু যাদবের সংঘাত তীব্র হয়েছে। সেখানেও আরজেডি-কংগ্রেস জোট কার্যত ভেঙে গিয়েছে। একই চিত্র উত্তরপ্রদেশেও। বড় রাজ‌্যগুলির মধ্যে একমাত্র মহারাষ্ট্রে এখনও কংগ্রেস-এনসিপি বোঝাপড়া টিকে রয়েছে। শিবসেনার সঙ্গে কংগ্রেসের জোট গোড়া থেকেই বিস্ময়ের। শিবসেনা আপাদমস্তক একটি হিন্দুত্বের দল। আদর্শগতভাবে তারা বিজেপির কাছাকাছি। এনডিএ-র তারা গোড়ার দিকের শরিকও ছিল। সেনা-কংগ্রেস বোঝাপড়া ক্ষণস্থয়ী ঘটনা ছাড়া কিছু নয়।

কংগ্রেস সম্পর্কে রাজ্যে রাজ্যে যে একটা অনীহা তৈরি হচ্ছে, তা কংগ্রেসের নিজস্ব ভাঙন থেকেও বোঝা যাচ্ছে। কংগ্রেসের এই ব্রাত‌্য অবস্থায় বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে যে শূন‌্যতা তৈরি হয়েছে, তা ভরাট করতে এগিয়ে এসেছে তৃণমূল। বাংলার বাইরেও তারা বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান মুখ হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একসময় পশ্চিমবঙ্গে যেমন কংগ্রেসের শূন‌্যতা তৃণমূল পূরণ করেছিল, এখন ঠিক একইভাবে দেশে সেই শূন‌্যতা পূরণ করতে তারা আগ্রহী।

রাজ্যে রাজ্যে ব্রাত‌্য হয়ে উঠলেও কংগ্রেস নেতৃত্বের তরফে এখনও তার কারণ অনুসন্ধানের বিশেষ চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। কয়েক দিন আগে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ঘিরে দেশে আগ্রহের সঞ্চার ঘটেছিল। রাজনৈতিক মহল উন্মুখ হয়ে তাকিয়েছিল ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক থেকে কংগ্রেস নেতা বা লাইন পাল্টায় কি না, তা দেখার জন‌্য। কংগ্রেস সেই পথে হাঁটেনি। সোনিয়া গান্ধী ঘোষণা করে দিয়েছেন, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনিই দলের নেতৃত্বে থাকছেন। আগামী ১ নভেম্বর থেকে কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচন শুরু হবে। সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচন করতে করতে ২০২২-এর সেপ্টেম্বর গড়াবে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট হয়ে যাবে। এর মধ্যে কংগ্রেসের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ‌্য হল পাঞ্জাব। বিধানসভা ভোটে যদি পাঞ্জাবে কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে সরে যায়, তাহলে সেটা তাদের ক্ষেত্রে একটি বড় ধাক্কা। পাঁচ রাজ্যের ভোটের প্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতির ছবি অনেকটাই বদলে যাবে। ফলত, এত দেরিতে ফের নেতৃত্ব বদল নিয়ে ভাবনা কংগ্রেসের ক্ষেত্রে অনেক বিলম্ব বলে বিবেচিত হতে পারে। তাতে হয়তো চিন্তিত নন রাহুল গান্ধী বা সোনিয়া। রাহুলের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হয়, কোন নেতা দল ছাড়ল আর কে যোগ দিল, তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন ইন্দিরার পৌত্র। কারণ তিনি মনে করেন মোদি-ম্যাজিক যত মিলিয়ে যাবে, তত কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্তিকরণের রাজনীতি দেশের মানুষের কাছে গুরুত্ব পাবে। বস্তুত, সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভাঙতে ভাঙতে কংগ্রেস কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, তা নিয়েও জল্পনাতেও রাহুলের কিছু এসে যায় না। ভাঙনের ফলে যদি দলের সাংগঠনিক শক্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন কংগ্রেস নেতৃত্ব নতুন করে নেতৃত্ব বা দলের লাইন পর্যালোচনা করে কী লাভ করবেন, তা নিয়ে ভাবনা শুধু প্রবীণদের তথা দলের জি-২৩ নেতাদেরই।

দেশের ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’-র অবক্ষয়ের আরও গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ২০২৪-এর আগে বিজেপি বিরোধী শক্তি নিশ্চিতভাবেই দেশে জোট বাঁধবে। এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে সেই শক্তির জোট বাঁধার ক্ষেত্রে একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার উপর রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি বিরোধী শক্তির একটা আস্থাও লক্ষ‌ করা যাচ্ছে। মমতার নেতৃত্বে দেশে বিজেপি-বিরোধী কোনও শক্তিশালী জোট গঠন হয় কি না, তা দেখা এখন সময়ের অপেক্ষা। রাহুল গান্ধীর তথাকথিত কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্তিকরণের রাজনীতির উপর অগাধ আস্থা একমাত্র সীতারামের। তিনিও রাহুলের মতো দেখছি ধৈর্য ধরে দেখতে চান মানুষের মন একদিন ফিরবে ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’-র দিকে।

[আরও পড়ুন: আমরা-ওরা করেননি মুজিবকন্যা, উত্তপ্ত বাংলাদেশে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন হাসিনা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement