সুতীর্থ চক্রবর্তী: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফল ঘিরে এবার দুনিয়াজোড়া আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এর কারণ অবশ্যই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন নাগরিকরা ট্রাম্পের নীতিকে কী চোখে দেখছে, তা নিয়ে কৌতূহল গোটা বিশ্বজুড়ে। কিন্তু মার্কিন জনতা শেষ পর্যন্ত যে রায় দিল, তা খুবই ঘোলাটে। দু’দলই তাদের জয় দাবি করছে। আট বছর বাদে ‘হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ’ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দখলে এলেও মার্কিন সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির আধিপত্য রইল। অর্থাৎ এ কথা কোনওমতেই বলা যাবে না যে, মার্কিন নাগরিকরা মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের নীতিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। আবার ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা গত দু’বছরে বেড়ে গিয়েছে এমনটাও বলা যাবে না। হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের জয়কে ডেমোক্র্যাটরা খুব বড়ভাবে দেখছে। সেনেটের জয়কে ট্রাম্প বড় করে দেখাচ্ছেন।
আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে অতীতেও কখনও বোঝা সম্ভব হয়নি- দু’বছর পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কী হতে পারে। বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামার মতো জনপ্রিয় নেতারাও মধ্যবর্তী নির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছেন। কিন্তু আবার দ্বিতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে এসেছেন। মার্কিন সংসদের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে এবার ডেমোক্র্যাটদের জয়টা তুলনামূলকভাবে বেশ বড়। রিপাবলিকানদের থেকে অনেক বেশি শতাংশ ভোট তারা দখল করেছে। ডেমোক্র্যাটদের ভোটের হার দেখে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, শহর ও শহরতলির যুবসমাজ, শ্রমিক শ্রেণি ও মহিলারা ব্যাপক পরিমাণে তাদের দিকে রয়েছে। এমনকী, বয়স্কদের একটি বড় অংশের সমর্থনও ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে আছে। কারণ, এরা উদ্বিগ্ন ট্রাম্পের স্বাস্থ্যবিমা সংক্রান্ত নীতি নিয়ে। অভিবাসীদের নিরঙ্কুশ সমর্থন তো বরাবর ডেমোক্র্যাটদের দিকে রয়েইছে। ফলে মধ্যবর্তী নির্বাচনে পাওয়া এই সমর্থন-ভিত্তি ধরে রাখতে পারলে ডেমোক্র্যাটরা দু’বছর বাদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে জিততে পারে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
২০১৬-এ ট্রাম্পের পক্ষে মার্কিন যুবসমাজের, বিশেষত শ্বেতাঙ্গদের যে বিপুল সমর্থন লক্ষ করা গিয়েছিল, তা এবার অনেকটা অনুপস্থিত বলেই বিশেষজ্ঞদের মত।তবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফল দেখে এটা বলার সময়ও আসেনি যে, ট্রাম্পের নীতি সাধারণ মার্কিনিরা একেবারে খারিজ করে দিচ্ছে। বা, দু’বছর বাদে তাঁর পরাজয় একেবারে নিশ্চিত। বরং ফ্লোরিডা, আইওয়া, ওয়াইহো-র মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে রিপাবলিকানরা ক্ষমতা ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে। এই তিন রাজ্যের গভর্নর নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প অনুগামীরা। মার্কিন রাজনীতিতে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে ফ্লোরিডা, আইওয়া, ওয়াইহো-র মতো রাজ্য ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্ট কে হবেন তার একটা ইঙ্গিত দেয়। মার্কিন রাজনীতির একটি মজার দিক হল– এখানে ৫০টি রাজ্যের মধ্যে সাত-আটটি রাজ্যের ভোটের ফল সবসময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে যেরকম গো-বলয়ের রাজ্যগুলি দিল্লির ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়, আমেরিকায় কিন্তু সেইরকম বড় বড় রাজ্য প্রেসিডেন্ট ঠিক করে দেয় না। আমেরিকার সবচেয়ে বড় রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার ফল কখনও ঠিক করে না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে কে বসবেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় সবসময়ই ডেমোক্র্যাটরা ভোটে জেতে। কিন্তু তা’বলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবসময় ডেমোক্র্যাটরা জিততে পারে না। আমাদের দেশে উত্তরপ্রদেশ মোটামুটিভাবে যে দলের কবজায় থাকে, কেন্দ্রের ক্ষমতা সেই দলের কাছে থাকে। কারণ উত্তরপ্রদেশে লোকসভার আসন সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এখন ৮০টি। ২০১৪-এ এই ৮০টি আসনের মধ্যে ৭৩টি দখল করে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির মসনদে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ভোটে জিততে গেলে নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হয়। সেখানে কখনও একটি বড় রাজ্য প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বরং একাধিক ছোট রাজ্য নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। ৫০টি রাজ্যের মধ্যে এখানে এমন কিছু রাজ্য আছে যেগুলি ‘ডেমোক্র্যাট’ বলে পরিচিত। এই রাজ্যগুলি প্রধানত আমেরিকার দুই উপকূলে অবস্থিত। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া বা নিউ ইয়র্ক। উপকূলে অভিবাসীদের ভিড়। অভিবাসীরা ঐতিহাসিকভাবে ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থক। এইসব রাজ্যে কখনওই দাঁত ফোটাতে পারে না রিপাবলিকানরা। আবার মধ্য আমেরিকায় যেখানে অভিবাসীরা তুলনামূলকভাবে জনসংখ্যার কম অংশ, সেখানে বিপুল শক্তি রিপাবলিকান পার্টির। মধ্য আমেরিকা মূলত কৃষিপ্রধান। এখানকার কৃষিজীবী, রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গরা রিপাবলিকানদের বিশাল ভোটব্যাঙ্ক। এই অঞ্চলে ডেমোক্র্যাটরা দাঁত ফোটাতে পারে না। ফলে ৫০টি রাজ্যের মধ্যে যে রাজ্যগুলি ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে, সেগুলি বাদ দিয়ে মার্কিন রাজনীতির হিসেবনিকেশ হয়। তাতে করে ফ্লোরিডা, আইওয়া, ওয়াইহো, পেনসেলভিনিয়ার মতো মিশ্র জনসংখ্যার রাজ্যগুলির গুরুত্ব সব নির্বাচনেই অনেক বেশি হয়। এই রাজ্যগুলিকেই আমেরিকার ভোট-রাজনীতিতে ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ বলা হয়ে থাকে। এরা কখনও ডেমোক্র্যাটদের দিকে, কখনও রিপাবলিকানদের দিকে ঝোঁকে। দেখা যাচ্ছে, এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে সেইসব ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটে ট্রাম্প কিন্তু ধরাশায়ী হননি। অর্থাৎ ২০২০-তে ট্রাম্প বিদায় নিচ্ছেন, এমন কোনও ইঙ্গিত কিন্তু মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনে স্পষ্ট হয়নি। আবার এটাও বলা যাচ্ছে না যে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’, এই নীতি ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। হাউজে জয়ী হওয়ার পর ডেমোক্র্যাট নেত্রী ন্যানসি পেলোসি জানিয়েছেন, এখনই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনার সম্ভাবনা নেই। চেয়ার না গেলেও ক্ষমতা যে খর্ব হল ট্রাম্পের তা নিয়ে তো কোনও সংশয় নেই। মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল তোলার পরিকল্পনা বিশ বাঁও জলে তলিয়ে গেল। এবার ট্রাম্পের অভিবাসন থেকে শুরু করে সবরকম নীতি পরিবর্তনের বাসনা আটকে যাবে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে।
২০০৮-এর মহামন্দা থেকে বেরিয়ে মার্কিন অর্থনীতি ফের ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। একটু একটু করে চাঙ্গা হচ্ছে সে দেশের শেয়ারবাজার। দেশে চাকরিবাকরির সুযোগ বাড়ছে। ট্রাম্পের কড়া অভিবাসন নীতির সমর্থক শ্বেতাঙ্গদের বড় অংশ। আমেরিকার কাজ বিদেশিরা কেড়ে নিচ্ছে– এই প্রচার শ্বেতাঙ্গ মার্কিনিদের মধ্যে ২০১৬ সালে আলোড়ন তুলেছিল। যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাম্প ক্ষমতা এসেছিলেন, তা রক্ষা করতে যে তিনি তৎপর তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। অনেকে ভাবছিল, শ্বেতাঙ্গরা ঢেলে ভোট দেবে ট্রাম্পকে। এই ভাবনাটাও মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গও যে ট্রাম্পের বিভেদের রাজনীতি সমর্থন করছে না, তা কিন্তু হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের ফলাফলে বোঝা যাচ্ছে। মার্কিন সমাজেরও বৈশিষ্ট্য হল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। আমাদের দেশের মতোই। এখানেও বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এসে মিলেছেন। তারা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম নিয়ে এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। ‘সাদা বনাম কালো’ কিংবা ‘সাদা বনাম বাদামি’ এই সুড়সুড়িগুলো কাজ করে। তাতে কিছু মানুষ প্রভাবিত হয়। কিন্তু সেটাই যে মার্কিন সমাজের শেষ কথা নয়, ভোটের ফল তা বলছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিন নাগরিক কিন্তু মধ্যবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের চরমপন্থী নীতিতে কিছুটা লাগাম পরাতে চেয়েছে। দু’বছর আগে ট্রাম্পের জয়ের পর গোটা পৃথিবীজুড়ে এমন একটা হাওয়া উঠেছিল যে, মনে হচ্ছিল সমাজে চরমপন্থীরাই এবার শেষ কথা বলবে। যে চরমপন্থী স্বর সমাজে ও রাজনীতিতে ট্রাম্প প্রতিষ্ঠা করছিলেন। এই স্বরের সমর্থক দেশে দেশে ছড়িয়ে। মধ্যবর্তী নির্বাচন ঘিরে সেই কারণেই গোটা পৃথিবীতে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। ফল কিছুটা ঘোলাটে হলেও ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরা যে একটু ধাক্কা খেল, তা কিন্তু বলাই যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.