রাজধানীর হাল৷ রাজনীতির চাল৷ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়মিত কলম সৌম্যদর্শন৷
নরেন্দ্র মোদি যতই গিলগিট, পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা বালুচিস্তানের ধুয়া তুলুন, কাশ্মীরে শরিফেরা যতই জঙ্গি, অস্ত্র ও অর্থ সাপ্লাই দিন, ভূগোল বদলানোর বিন্দুমাত্র ক্ষমতা কারও নেই৷ সত্তর বছর ধরে যা চলছে, আরও সত্তর বছর সেভাবেই চলবে বাস্তবকে স্বীকার না করলে৷ পাকিস্তান বলবে স্বাধীনতার সংগ্রাম, ভারত বলবে সীমান্তপারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ৷ নিট রেজাল্ট সাধারণ মানুষের ধারাবাহিক দুর্ভোগ৷
ভারতের ৭০তম স্বাধীনতা দিবসের আগের ক’টা দিনের ঘটনাগুলো খুব ইণ্টারেস্টিং৷ প্রথমে পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রকের উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ বললেন, জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে কথা বলতে পাকিস্তান শিগগিরই ভারতকে আমন্ত্রণ জানাবে৷ সঙ্গে সঙ্গে ভারত বলল, এই প্রস্তাবকে তারা স্বাগত জানাচ্ছে৷ ইদানীং কাশ্মীরে যা চলছে, মানে সাম্প্রতিক ও প্রাসঙ্গিক সব বিষয়, যার মধ্যে রয়েছে সীমান্তপারের সন্ত্রাসে পাকিস্তানের মদত এবং অবশ্যই হাফিজ সঈদ ও সৈয়দ সালাউদ্দিনের যাবতীয় অপকম্মো, সে সব নিয়ে আলোচনায় ভারতও আগ্রহী৷
সরতাজ আজিজের এই প্রস্তাব এবং ভারতের জবাবটা যেদিন এল, সেদিন চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই দিল্লিতে এবং স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হতে ঠিক দু’দিন পাকি৷ ওই একই দিনে পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রক একটা চিঠি দিল ভারতকে৷ বলল, তারা জম্মু-কাশ্মীরের দুর্গতদের সাহায্যের জন্য ওষুধ-সহ অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে চায়৷ এমন ধরনের কোনও আবদার পাকিস্তান আগে কখনও করেনি৷ তবে এই আবদারটা যে বিছের হুল ফোটানোর মতো, ভারতের তা বুঝতে দেরি হয়নি৷ সঙ্গে সঙ্গেই তারও উত্তর গেল৷ বলা হল, অনেক ধন্যবাদ, আগ মার্কা সন্ত্রাস, অত্যাধুনিক অস্ত্র, মাদক ও জাল নোটের দেদার সাপ্লাই দিয়ে তোমরা আমাদের অনেক সাহায্য করছ, বাড়তি আর কিছুর তাই দরকার নেই৷
পরের দিন ১৪ আগস্ট৷ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস৷ দিল্লিতে হাই কমিশনার আবদুল বাসিত বললেন, এবারের স্বাধীনতা দিবস তাঁরা উৎসর্গ করছেন জম্মু-কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে৷ উপত্যকার মানুষের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত এই লড়াই চলবে৷ পাকিস্তান সেই সংগ্রামে সব ধরনের সহায়তা করবে৷
আবদুল বাসিতের কথা শুনে ভারতও নড়েচড়ে বসল৷ দু’দিন আগেই এই বাসিতকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর হাতে ভারত একটা ‘ডিমার্শ’ ধরিয়েছে৷ মানে কড়া প্রতিবাদপত্র৷ পাকিস্তানি এক জঙ্গি কয়েকদিন আগে জ্যান্ত ধরা পড়ে৷ ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে পাকিস্তানের যোগসাজশ নিয়ে সে হড়হড় করে সব বলে দিয়েছে৷ ‘ডিমার্শ’টা তাকে ঘিরেই৷ বাসিতের সেই কথার জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ লালকেল্লার ভাষণে তিনি চাঁচাছোলা ভাষায় বালুচিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম, গিলগিট ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মানুষের আন্দোলন এবং মানবাধিকার হরণের প্রশ্নগুলি তুলে পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দিলেন, ওহে, বেশি কাশ্মীর-কাশ্মীর করলে তোমাদেরও বালুচিস্তান, গিলগিট নিয়ে ফ্যাসাদে পড়তে হবে৷ অতএব, নিজের চরকায় তেল দেওয়াই তোমাদের পক্ষে মঙ্গল৷
এই কাজিয়ার মধ্য দিয়ে যা হল, দু’দেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এই প্রথম কোনও দেশই অন্য দেশকে অভিনন্দিত করল না৷ ১৯৭১ সালেও কিন্তু এই শিষ্টাচারের অভাব দেখা যায়নি৷ এই ‘টিট ফর ট্যাট’ বা ইটের বদলে পাটকেল ছোড়ার মতো পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের কপালেই দেখছি অনেক রকমের ভাঁজ পড়েছে৷ আমি অবশ্য নির্বিকার৷ কেন না, দেশ ভাগাভাগির সময় থেকেই ভারত-পাকিস্তনের সম্পর্ক এমনই নরম-গরম৷ চার চারটে যুদ্ধ আমাদের মধ্যে হয়েছে৷ লাগাতার ছায়াযুদ্ধ চলছে তো চলছেই৷ মৃত্যুর মিছিলও অন্তহীন৷ তারই মধ্যে দুই দেশ নিয়ম করে আলোচনার টেবিলে যেমন বসেছে, তেমনই আবার জাতিসংঘে একে অন্যকে দুষেওছে৷ ক্রিকেট যেমন খেলেছে, দুই দেশের নেতারা একে অন্যের সঙ্গে ইতি-উতি ফিসফিস-গুজগুজ যেমন করেছেন, তেমনই আনুষ্ঠানিক আলোচনাও চলেছে ও বন্ধ হয়েছে৷ সত্তরটা বছর ধরে সম্পর্কের এই যে ধারাবাহিকতা, তাতে কখনও কোনওদিন ফুলস্টপের ফুটকি পড়বে বলে আমার মনে হয় না৷ দুই দেশের রাজারা আসবে-যাবে, এই শত্রূতা, অবিশ্বাস ও অনাস্থার শেষ হবে না৷ কখনও একজন ‘আপার হ্যান্ড’ নেবে, কখনও অন্যজন৷ সত্তর বছর আগেই এই ভবিতব্য দুই দেশের ললাটে লেখা হয়ে গিয়েছে৷
আসল ব্যাপার কাশ্মীর৷ সম্পর্কের উন্ন্তি-অবনতি সবকিছুই এই কাশ্মীর-কেন্দ্রিক৷ পাকিস্তান এই যে বারবার বলে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ‘কোর ইস্যু’ হল কাশ্মীর, সেটা তারা ঠিকই বলে৷ কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হলে স্যর ক্রিক বা তুলবুল নেভিগেশন প্রকল্পের সমাধান যেমন হবে না, তেমনই দু’দেশের বাণিজ্য বা মানুষে-মানুষে যোগাযোগ অথবা অন্য হাজারটা বিষয়ের সুরাহাও হবে না৷ পাকিস্তানের মানসিকতা, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশনীতি, রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতিতে কাশ্মীর যেভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাতে এই প্রশ্নটাকে বাইরে রেখে ওই দেশটার এক পাও এগনোর উপায় নেই৷ পাকিস্তানের কাছে কাশ্মীরই এক থেকে নববই৷ বাকি দশ ভাগ অন্য সব কিছু৷
ভারতের অবস্থাটা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম৷ ভারতের কাছে কাশ্মীর আরও একশোটা সমস্যার একটা৷ এ দেশের রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি কিংবা বিদেশনীতি কোনও কিছুই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায় না৷ কাজেই পাকিস্তানি মননে কাশ্মীর যেভাবে মিশে রয়েছে, কিংবা বলা ভাল, পাকিস্তানি রাজনীতিকরা, সেনানীরা, গোয়েন্দারা আম আদমির মন ও মগজে কাশ্মীরকে কোষাকুষিতে ঘষে যেভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয়দের মন-মগজ সেভাবে কাশ্মীরাচ্ছন্ন নয়৷ হ্যাঁ এটা ঠিক, কাশ্মীর নিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া ভারতের কোনও দলের পক্ষেই সম্ভব নয়৷ তবে তাই বলে কাশ্মীর-কাশ্মীর করে ভারতীয় মন সব সময় উদ্বেলিত ও উত্তেজিত হয় সেটাও সত্য নয়৷
প্রশ্ন দুটি৷ প্রথম প্রশ্ন, পাকিস্তান হঠাত্ এতটা হাত-পা ছোড়া কেন শুরু করল৷ দ্বিতীয় প্রশ্ন, কাশ্মীর সমস্যার আদৌ কোনও সমাধান সম্ভব কি না৷
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে নওয়াজ শরিফের সম্পর্কটা এই গত দু’বছরে বেশ মাখোমাখো হয়ে উঠেছিল৷ এতটাই যে, আফগানিস্তান থেকে ফেরার পথে প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে শরিফকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে মোদি টুক করে ইসলামাবাদে নেমে পড়েছিলেন৷ মোদি মনে করেন শরিফ আদ্যন্ত ব্যবসায়ী৷ তাঁর সঙ্গে তাই তাঁর বেশ পটবে৷ এই ধারণায় বা বোঝাপড়ায় কোনও ভুল নেই৷ কিন্ত্ত তার চেয়েও বড় সত্যি, কাশ্মীর সমস্যার সমাধানকে অধরা রেখে পাকিস্তানের কোনও রাজনীতিক ভারতের সঙ্গে দহরম মহরম করতে গেলে দেশের সেনা ও গোয়েন্দারা তাঁকে রেয়াত করে না৷ ১৯৯৯ সালে পারভেজ মুশারফ তাঁর কী হাল করেছিলেন, শরিফের তা জানা৷ এবারেও সেই বিপদ শরিফের সামনে৷ বাড়তি বিপদ ইসলামি মৌলবাদী শক্তি৷ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এই বছরের নভেম্বর মাসে৷ মুশকিলটা হল, রাহিল শরিফকে নওয়াজ শরিফ দ্বিতীয়বারের জন্য সেনাপ্রধানের দায়িত্বে রাখতে চান না৷ অন্যদিকে রাহিল শরিফও চান না সরে গিয়ে অবসর জীবন কাটাতে৷ চান না বলে তিনি নওয়াজ শরিফের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন৷ দেশের সব বড় বড় শহরে পোস্টার ও ব্যানার পড়েছে সেনা অভ্যুত্থানের দাবিতে৷ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে আক্রমণ করে ওই পোস্টার-ব্যানার-হোর্ডিংয়ে বলা হয়েছে, সেনা-শাসনে দেশের মানুষ ভাল থাকে৷ কারণ, দুর্নীতি বন্ধ থাকে, অপরাধীদেরও সাজা হয়৷ সেনাবাহিনীর এই চাপের মুখে নওয়াজ শরিফকেও গরম হতে হচেছ৷ আর কে না জানে, পাকিস্তানে লোক খেপানো অথবা কুর্সি বাঁচানোর সেরা হাতিয়ারটির নাম ‘কাশ্মীর’৷
আগ্রা শীর্ষ সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার তিন বছর পর দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভ’-এ এসে পারভেজ মুশারফ কোনওরকম ভনিতা না রেখে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলেন, কাশ্মীর তাঁদের কাছে কতটা৷ নানাভাবে তিনি বুঝিয়েছিলেন, কেন কোনও পাকিস্তানির হিম্মত হবে না কাশ্মীর প্রশ্নে কোনওরকমের সমঝোতার রাস্তায় হাঁটতে৷ বলেছিলেন, কাশ্মীর সমস্যার সমাধানই সুসম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র উপায়৷ কাশ্মীরই সব, বাকি সব গৌণ৷
সমাধানের সূত্রটা কী, সেটাই দ্বিতীয় প্রশ্ন৷ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চারটে যুদ্ধ হয়েছে৷ সীমান্ত দুটি৷ একটি আন্তর্জাতিক সীমানা, অন্যটি নিয়ন্ত্রণ রেখা৷ এতগুলো যুদ্ধ সত্ত্বেও সেই সীমান্ত কিন্তু অপরিবর্তিতই রয়েছে৷ দুই দেশই এখন পরমাণু শক্তিধর৷ গোটা বিশ্বেরও নজর এই ‘কনফ্লিক্ট জোন’-এর দিকে৷ অর্থাত্ গায়ের জোরে কোনও দেশেরই এক ইঞ্চি জমি কাড়ার মুরোদ নেই৷ নরেন্দ্র মোদি যতই গিলগিট, পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা বালুচিস্তানের ধুয়া তুলুন, কাশ্মীরে শরিফেরা যতই জঙ্গি, অস্ত্র ও অর্থ সাপ্লাই দিন, ভূগোল বদলানোর বিন্দুমাত্র ক্ষমতা কারও নেই৷ সত্তর বছর ধরে যা চলছে, আরও সত্তর বছর সেভাবেই চলবে বাস্তবকে স্বীকার না করলে৷ পাকিস্তান বলবে স্বাধীনতার সংগ্রাম, ভারত বলবে সীমান্তপারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ৷ নিট রেজাল্ট সাধারণ মানুষের ধারাবাহিক দুর্ভোগ৷
বাস্তবটা তা হলে কী? নিয়ন্ত্রণ রেখাকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বলে নেনে নেওয়া৷ ভাবের ঘরে চুরি না করে এক যুগ আগে ফারুক আবদুল্লা এই প্রস্তাবই দিয়েছিলেন৷ এখনও পর্যন্ত এটাই চিরকালীন সমাধানের একমাত্র উপায়৷ মানলে সব পক্ষেরই মঙ্গল, নইলে এমনই নরমে-গরমে চলবে তো চলবেই৷
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.