ডাক্তাররা সমাজের হৃৎপিণ্ড। তাঁদের বাদ দিয়ে সরকারি পরিষেবা চলবে না। তাই নিজেই আলোচনায় বসতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নে যান চিকিৎসকরা। মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষোভগুলো বলুন। স্বাস্থ্য ভবনকে কেন্দ্র করে আপনাদের অভিযোগ তুলে ধরুন। তিনি অবহিত হবেন। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
দোষীদের ফাঁসি হোক। নির্যাতিতা বিচার পাক। এই মৌলিক দাবিতে মনে হয় রাজ্যের প্রতিটি মানুষ একমত। তাই বলে বিক্রম ভট্টাচার্যর অসহায় মায়ের দিকে তাকাব না? হাসপাতালে পৌঁছেও যিনি চোখের সামনে দেখলেন রক্তে ভেসে চিরঘুমে চলে গেল ছেলে। ডাক্তার এল না। চিকিৎসা হল না। আমরা ‘জাস্টিস চাই’ বলে মিছিল করব না নিহত তরুণ শ্রমিক সাবির মল্লিকের জন্য– গোরক্ষার নাম করে যাঁকে পিটিয়ে মারা হল হরিয়ানায়, যাঁর ঘরে দুধের এক শিশু, অসহায় স্ত্রী? যাঁরা রাত হলেই ‘দখল’-এ নামছেন, তাঁদের বিবেক কি শুধু আর. জি. করের নির্যাতিতার জন্য জাগ্রত? মেরুদণ্ড সোজা কি শুধু আর. জি. করের মিছিলে?
কী অমানবিক দৃশ্য! তরতাজা তরুণ বিক্রম শুয়ে আছেন স্ট্রেচারে। পথ দুর্ঘটনায় মারাত্মক আঘাত। কোন্নগর থেকে কলকাতা আসতে খানিক সময় গিয়েছে। শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। দ্রুত অক্সিজেন কমছে শরীরে। ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছেন। বিধ্বস্ত মা স্ট্রেচারটি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এদিক-ওদিক। এমারজেন্সি থেকে আউটডোর, কোথাও ডাক্তার নেই! কোথাও চিকিৎসা নেই! ঘটনাস্থল সেই আর. জি. কর হাসপাতাল। আড়াই-তিন ঘণ্টা ডাক্তারের অভাবে চিকিৎসাই হল না বিক্রমের। মায়ের চোখের সামনে চলে গেল ছেলে।
শ্যামবাজার থেকে এইট-বি, তারপর অনেক রাত দখল হয়েছে, কিন্তু কখনও বিক্রম বা সাবিরের জন্য মোমবাতি জ্বলেনি। কেউ-কেউ বলতেই পারেন– আর. জি. করে চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন আর এই সব ঘটনা কি এক? না এক নয়। কিন্তু তাঁদের প্রাণগুলোও চলে গেল পরিবারকে ভাসিয়ে। সমাজের মননে আঘাত করে। চিকিৎসা পেলে হয়তো বেঁচে যেতেন বিক্রম।
মেডিক্যাল কলেজগুলির প্রাণ জুনিয়র ডাক্তাররা। একমাস হয়ে গেল তাঁরা রোগী দেখছেন না। নিত্যনতুন দাবি তাঁদের। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও তাঁরা মানবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের মনে গভীর ক্ষত আছে। তাঁদের মনে সহকর্মীকে হারানোর ক্ষোভ আছে। তাঁদের বিচারের দাবি ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু তাই বলে রোগী দেখবেন না কেন? আন্দোলনের তো অনেক পথ আছে। দাবি আদায়ে রিলে অবস্থান, কর্মবিরতিতেও করা যায়। কিন্তু তাঁরা অনড়। তাছাড়া বিচার তো দেবে সিবিআই, বিচার হবে সুপ্রিম কোর্টে। রাজ্য সরকার বিচার দিতে পারবে না। মুখ্যমন্ত্রী বিচার দিতে পারবেন না। তাঁদের দাবির সঙ্গে সুর মিলিয়ে যদি বলা যায়, তথ্যপ্রমাণ লোপাট করা হয়েছে, তাহলে সেই বিচারের দায়িত্ব তো সুুপ্রিম কোর্টের হাতে, সিবিআইয়ের হাতে।তাহলে কর্মবিরতি কেন? নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যক্ষেত্র নিয়ে নির্দিষ্ট দাবি আছে। সেসব তুলে ধরে সমস্যা মেটান। আর কতদিন বিক্রমরা হাসপাতালে চিকিৎসা না-পেয়ে মারা যাবেন?
ইতিপূর্বে স্বাস্থ্যভবন অভিযান করে তাঁরা যা যা দাবি করেছিলেন, সরকার মেনে নিয়েছে। তালিকা ধরে সব অফিসারকে সরিয়ে দিয়েছে। লালবাজার অভিযানের দিন দাবিমতো কলকাতার পুলিশ কমিশনার তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এবার তাঁরা দাবি করেছেন পুলিশ কমিশনার ও স্বাস্থ্যসচিবকে সরাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে তাঁদের সময় দিতে চেয়েছেন। যান– তাঁর কাছে। বলুন কী কী দাবি। তিনি যদি না শোনেন, তাহলে আরও আন্দোলন করার সময় পড়ে আছে। কিন্তু কথা বলুন। মুখ্যমন্ত্রী নির্যাতিতাকে বিচার দিতে পারবেন না। কারণ, সেই ক্ষমতা তাঁর হাতে নেই। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর নিয়ে আপনাদের যা যা অভিযোগ আছে, তাঁকে গিয়ে বলুন। এটাই গণতন্ত্র। তিনিই সমাধান করতে পারবেন।
সাধারণ রোগীদের কী অপরাধ? তারা বেঘোরে মারা যাচ্ছে। সরকার তথ্য দিয়েছে, এই একমাসে ২৩ জন মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে। সাত লক্ষ মানুষ চিকিৎসা পায়নি। জুনিয়র ডাক্তাররা প্রথমে যা দাবি করেছিলেন, সরকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাঁরা কাজে ফেরেননি।
মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীকে উৎসবে ফিরতে বলবেন কি বলবেন না, সেটা একান্ত তাঁর বিষয়। তাঁর কথা মানুষ গ্রহণ করবেন কি করবেন না সেটা মানুষই বুঝিয়ে দেবেন। কিন্তু সামনে পুজো। কোটি কোটি মানুষের উৎসব। হাজার হাজার কোটি টাকা লগ্নি হবে। সেই টাকায় গরিব মানুষের সংসার চলবে। পুজোর বাজার শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন কি মুখ্যমন্ত্রী বলবেন, ‘উৎসব’ বন্ধ করে দিন? আগে বিচার, তারপর উৎসব– এমন কি বাস্তব? এত বড় ঘটনার বিচার সাতদিনে হয় না। সময় লাগবেই। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের বিচার ট্রায়াল চলেছে বছরের পর বছর।
তাছাড়া উৎসবের সঙ্গে নির্যাতিতার বিচারের কী সম্পর্ক আছে? সেটা আইনি প্রক্রিয়া। সাধারণ মানুষকে জীবন নির্বাহ তো করতেই হবে। কোন কাজটা আটকে গিয়েছে? মানুষ কি সামাজিক অনুষ্ঠান করছে না? গণেশ পুজো কি হল না? যারা উৎসবে ‘না’ লিখে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছে, তারা কি এবার দুর্গাপুজোর আনন্দে মাতবে না? পুজোর বাজার করবে না বলে ঠিক করেছে, না কি এবার পুজোয় বেড়াতে যাচ্ছে না? পুজোয় নতুন গান, সিনেমা বেরবে। দেখবে না তো?
যে-অভিনেত্রী রাত দখল করে ‘শেষ দেখে ছাড়ব’ পোস্টারটি তুলে ধরেছিলেন, তিনিই দেখলাম তাঁর নতুন ছবির বিজ্ঞাপন সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। রাত দখলে এক রূপ, আর দিন হলে অন্য রূপ শুধু
তাঁর নয়, অনেকেরই। কিছু মানুষ সততার সঙ্গে নিজের লড়াইকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আর কিছু মানুষ রাজনীতির ছকে চলে। তবে এ-ও বলা যায়, ওই অভিনেত্রী কিছু ভুল করেননি। এটাই স্বাভাবিক। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই হবে। আবার বাস্তবতার সঙ্গে এগতেও হবে। তদুপরি, এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আর. জি. করের ঘটনার পর যেভাবে সাধারণ মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদ করছে, তা নজিরবিহীন। ক্ষোভ অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক। সরকারে যিনি থাকবেন জবাবদিহি করতে হবে।
সরকার কিন্তু সেই অভিঘাত সহ্য করেছে। এখনও পর্যন্ত কোথাও বাধা দেওয়া, আঘাত করার মতো ঘটনা ঘটেনি। সরকারি দল তাদের পতাকা পোড়ানো হচ্ছে দেখেও পাল্টা সংঘাতে যায়নি। আন্দোলনরত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে দমন নীতি নেওয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট ক্ষমতা দিলেও রাজ্য করেনি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের আঘাত সহ্য করে পুলিশ সংযম হারায়নি। এক অফিসারের চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এক মহিলা কনস্টেবল মারাত্মভাবে আহত হয়েছেন। কিন্তু পুলিশ রিয়্যাক্ট করেনি। সরকারের এখন মাথাব্যথা জুনিয়র ডাক্তারদের নিয়ে। যদি বিরোধী দল এমন অবস্থান নিত, শাসক দল রাজনৈতিকভাবেই তার মোকাবিলা করত। কিন্তু ডাক্তাররা সমাজের হৃৎপিণ্ড। তাঁদের বাদ দিয়ে সরকারি পরিষেবা চলবে না। তাই নিজেই আলোচনায় বসতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
নবান্নে যান চিকিৎসকরা। মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষোভগুলো বলুন। স্বাস্থ্যভবনকে কেন্দ্র করে আপনাদের অভিযোগ তুলে ধরুন। তিনি অবহিত হবেন। তিনি সংবেদনশীল মানুষ। মানুষের মধ্যে থেকে নেত্রী হয়েছেন বলে মানুষের ভাষা বলে ফেলেন। আমার মনে হয়, নিজেদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন বৈঠকে গেলে।
আর দেরি নয়, একদিকে নির্যাতিতা বিচার পাক। অন্যদিকে বিক্রমের মায়েরা আপনাদের অপেক্ষায় বসে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.