মস্কোর রাস্তায় শেষ ট্যাঙ্ক দেখা গিয়েছিল ১৯৯১-এর আগস্টে। সে-সময় মিখাইল গর্বাচভকে উৎখাত করতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থী বরিস ইয়েলৎসিন ট্যাঙ্ক নামিয়েছিলেন। যদিও সেই যাত্রায় গর্বাচভ গদি বাঁচাতে সফল হয়েছিলেন। পরে ক্রেমলিনের ক্ষমতায় আসেন ইয়েলৎসিন। ১৯৯৯ সালে ইয়েলৎসিনকে সরিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে তিন দশক পর মস্কোর অদূরে ফের ট্যাঙ্কের দর্শন খুবই ইঙ্গিতবাহী। তবে আপাতত বিদ্রোহী ভাড়াটে সেনা ওয়াগনার বাহিনীর নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন-কে বেলারুশে নির্বাসনে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন।
মস্কো অভিযান হঠাৎ নাটকীয়ভাবে বাতিল করে বেলারুশের কোথায় গিয়ে প্রিগোজিন আশ্রয় নিয়েছেন, তা অবশ্য পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমও জানাতে পারছে না। দক্ষিণ রাশিয়ার রস্তভ শহরে প্রিগোজিনকে শনিবার সন্ধ্যায় শেষ দেখা গিয়েছিল। তখন তিনি জনতার অভিনন্দন গ্রহণ করছিলেন। ইউক্রেন সীমান্ত-ঘেঁষা রস্তভ শহর প্রিগোজিনের বাহিনী দখল নেওয়ার পর হাজার হাজার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল বিদ্রোহী ভাড়াটে সেনাদের অভিনন্দন জানাতে। তারা যে পুতিনের শাসন থেকে মুক্তি চায়, তা বলা বাহুল্য। রস্তভ থেকে অচিরে মস্কো পৌঁছে প্রিগোজিন ক্রেমলিনের দখল নেবেন বলে এরা আশা করছিল। কিন্তু, মাঝপথে হঠাৎ প্রিগোজিনের কী ঘটল, তা এখনও অজানা।
সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ বলছে, পুতিনের সঙ্গে প্রিগোজিনের শেষ মুহূর্তে একটা সমঝোতা হয়ে যায়। এই সমঝোতা অনুযায়ী, প্রিগোজিন বেলারুশে নিরাপদে থাকবেন। তাঁর বাহিনীর ২৫ হাজার সদস্যের কারও বিরুদ্ধে রুশ সরকার দেশদ্রোহিতার মামলা করবে না। তবে প্রিগোজিনের বাহিনীকে আর ইউক্রেনে কাজে লাগাবেন না পুতিন। সিরিয়া-সহ আফ্রিকা মহাদেশের যেখানে যেখানে রাশিয়া যুদ্ধ করছে, সেখানে তাদের পাঠানো হবে। এতে নাকি প্রিগোজিন খুশি। কারণ, সিরিয়া ও আফ্রিকায় যুদ্ধ করলে তাঁর বেশি মুনাফা হবে।
শনিবার সকালে যখন প্রিগোজিনের বাহিনী ইউক্রেনের বাখমুট থেকে সরে এসে রস্তভ দখল করার পর দ্রুত জাতীয় সড়ক ধরে মস্কোর দিকে এগোচ্ছিল, তখন পুতিন হুমকি দিয়েছিলেন প্রবল প্রত্যাঘাতের। কিন্তু রাতেই দেখা গেল পুতিনের অবস্থান বদল। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় পুতিন রীতিমতো সমঝোতায় চলে এলেন প্রিগোজিনের সঙ্গে। প্রভূত রক্তপাত হবে এই অজুহাত দেখিয়ে মস্কো থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরেই প্রিগোজিন তাঁর বাহিনীর অভিমুখ ঘুরিয়ে দিলেন। সকালে কঠোর থাকার পর বিকেলে পুতিনের এই সুর নরম থেকে স্পষ্ট যে, তাঁর পায়ের তলার মাটিও নরম হয়ে এসেছে।
বলা হয়ে থাকে, রাশিয়ার মানুষের কাছে পুতিন স্থায়িত্বের প্রতীক। ২৩ বছর ধরে তাঁর জমানা চলছে। এই জমানার ভিত নড়বে বলে রুশিদের একটা বড় অংশই এতদিন বিশ্বাস করত না। কিন্তু, ওয়াগনর বাহিনীর ট্যাঙ্ক রুশিদের সেই বিশ্বাসে নাড়া দিয়ে গিয়েছে। শনিবার মস্কোতে কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর স্মৃতি ফিরে এসেছিল। সমগ্র মস্কো শহর রুশ সেনারা ঘিরে ফেলেছিল। জেসিবি দিয়ে রাতারাতি মস্কো ঢোকার সব রাস্তা কেটে ফেলা হয়েছিল। রাস্তা জুড়ে বসানো হয়েছিল কাঁটাতারের বেড়া। বিমানবন্দরের তথ্য বলছে, শনিবার সকালে মস্কো থেকে প্রেসিডেন্টের দু’টি বিমান উড়ে গিয়েছিল। রবিবার সে দু’টি ফের মস্কো ফিরে আসে। এই দু’টি উড়ানের একটিতে খোদ পুতিন ছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। অতিপ্রবীণরা বলছেন, ১৯৪১ সালে হিটলারের বাহিনী যখন মস্কো অভিমুখে এগিয়ে এসেছিল, তখন শহরের যে-চেহারা হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি ঘটে শনিবার। ফলে, প্রিগোজিনের বিদ্রোহ শেষ মুহূর্তে থমকে গেলেও পুতিনের কর্তৃত্ব তা পুরোমাত্রায় খর্ব করে দিয়ে গিয়েছে।
প্রিগোজিনের সঙ্গে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছিল গত চার মাস ধরেই। প্রিগোজিনের বাহিনী ইউক্রেনের বাখমুট শহর দখলের পর থেকেই এই দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। বাখমুটে ইউক্রেনীয় সেনারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে ওয়াগনর বাহিনী। অস্ত্রশস্ত্রর জন্য প্রিগোজিন বারবার দরবার করছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের কাছে। প্রিগোজিনের অভিযোগ, তাঁদের কোনওরকম সহযোগিতা করছিল না রুশ সেনাপ্রশাসন। সর্বশেষ ক্রেমলিন ডিক্রি জারি করেছিল, ওয়াগনর বাহিনীর সদস্য-সহ যেসব ভাড়াটে সেনা ইউক্রেনে রাশিয়ার হয়ে লড়াই করছে, তাদের সবাইকে রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। ক্রেমলিনের এই ডিক্রিতেই নাকি বেঁকে বসেন প্রিগোজিন। কারণ, তাঁর বাহিনীর সদস্যরা যদি রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে প্রিগোজিনের সেনাবাহিনীর ব্যবসা লাটে উঠবে। এছাড়া ক্রেমলিনের অভিযোগ, ওয়াগনর বাহিনী রাশিয়ার ট্যাঙ্ক-সহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র চুরি করছে। বিরোধ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছয় যে, ওয়াগনর বাহিনীর সঙ্গে রুশ সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়। প্রিগোজিনের অভিযোগ, তাঁর বাহিনীর উপর রুশ সেনারা ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত ছোড়ে।
ওয়াগনার বাহিনী যে এইভাবে ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মস্কোর দিকে অগ্রসর হবে, সেই গোয়েন্দা তথ্য নাকি হোয়াইট হাউস এবং মার্কিন সেনা হেড কোয়ার্টার পেন্টাগনে কয়েক দিন আগে পৌঁছেছিল। মার্কিন প্রশাসন ওই তথ্য পেয়েও চুপ করে ছিল। মার্কিন প্রশাসন নাকি চাইছিল, রাশিয়ায় যা ঘটে ঘটুক। শেষ মুহূর্তে পুতিন পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নেওয়ায় হতাশ আমেরিকা ও ইউরোপের কূটনৈতিক মহল। হতাশা গ্রাস করেছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ও ইউক্রেনীয় সেনার মধ্যেও। ওয়াগনার বাহিনী মস্কো পৌঁছলে যে রাশিয়া জুড়ে এক ‘গৃহযুদ্ধ’-র পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাশিয়ায় অস্থিরতা তৈরি হলে ইউক্রেনের পক্ষে প্রতি-আক্রমণ সহজ হত। ইউক্রেন এখন ক্রিমিয়া উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রিমিয়ার দখল নিতে পারলে যুদ্ধে রাশিয়া পিছু হটবে। ওয়াগনার বাহিনী বিদ্রোহে ইতি টানায়, সবটাই প্রশ্নচিহ্নর মুখে দাঁড়িয়ে গেল।
তবে রাশিয়ার অতীত ইতিহাস অনুসরণ করে এই বিদ্রোহ যদি পুতিনের শেষের শুরুর ইঙ্গিত বহন করে, তাহলে তা ইউক্রেন-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে ইতিবাচক হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.