কংগ্রেসে যোগ দিলেন না প্রশান্ত কিশোর। কংগ্রেসের প্রস্তাব মানলেন না পিকে, না কি কংগ্রেসই তাঁকে গ্রহণ করল না? অথচ, তিনি বিশ্বাস করেন, কংগ্রেস ছাড়া বিরোধী জোট দুরূহ। ফলে, অ-বিজেপি রাজনৈতিক দলগুলির কাছে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। কথায় বলে, রাজনীতিতে পূর্ণচ্ছেদ নেই। পিকে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে পদাধিকারী হননি, কিন্তু রাতারাতি কংগ্রেসের শত্রু হয়ে গিয়েছেন কি? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
ব্যক্তিটির নাম প্রশান্ত কিশোর। আপনার পছন্দ হোক আর না হোক, সর্বভারতীয় মঞ্চে এখন আপামর জনতার কাছে প্রশান্ত কিশোর (Prashant Kishore) এক প্রবল আগ্রহের বিষয়। প্রশান্ত কিশোর কী করছেন? কোন দিকে যাচ্ছেন? তিনি কংগ্রেসে যোগ দিলেন না কেন- এ সমস্তই সুবিস্তৃত মধ্যবিত্ত ভারতীয় সমাজের কৌতূহলের বিষয়। একেই বলা যেতে পারে- ‘দ্য ইম্পর্ট্যান্স অফ বিয়িং প্রশান্ত কিশোর।’
তা, এহেন প্রশান্ত কিশোর ওরফে পিকে-কে নিয়ে গত সপ্তাহে আলোচনা করেছিলাম যে, কংগ্রেসে এলে পিকের সঠিক ভূমিকা কী হবে? কংগ্রেসের সঙ্গে পিকের সম্পর্কের পুনরুদ্ধার, আর সেই দলে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দেওয়া- দুটো ভিন্ন মোটেও এক বিষয় নয়।
সেই আখ্যানের প্রথম অধ্যায়ে আলোচনার বিষয় ছিল কংগ্রেসের (Congress) সঙ্গে পিকে-র ঘনিষ্ঠতা। পিকে প্রথমে নিজের সংস্থা ‘আইপ্যাক’ থেকে ইস্তফা দিলেন। তারপর তিনি প্রিয়াঙ্কা এবং রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেন। একবার নয়, একাধিকবার। গুঞ্জন উঠল, তিনি কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন। কার্যত যোগ দিলেন, কারণ তিনি তখন কংগ্রেসের ওয়ার গ্রুপের সদস্য। ওয়ার গ্রুপের বৈঠকে যোগ দিলেন। সেই ওয়ার গ্রুপে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণপত্রটিও আমি দেখেছিলাম। তারপরই হঠাৎ শুরু হল দ্বিতীয় অধ্যায়। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে পিকের একটি বৈঠকে বেহালার ছড়ি ব্যবহৃত হল। অর্থাৎ করুণ সুরের মূর্ছনা। কংগ্রেসের আচরণের সমালোচনায় মুখর হলেন পিকে। গোয়া ভোটের সময় এই সম্পর্ক আরও তেতো হয়ে গেল।
গোয়ায় কংগ্রেসকে ভাঙার কৌশল ছিল মূলত পিকেরই। কংগ্রেস আর তৃণমূলের দূরত্ব বাড়ার নেপথ্যেও বহু কংগ্রেস নেতা পিকেকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। এমনকী, গোয়া ভোটের সময় দিল্লিতে এক শীর্ষ কংগ্রেস নেতা আমাকে বলেছিলেন, পিকে-কে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিতাড়িত করেন, তাহলে কংগ্রেস-মমতা সম্পর্ক আবার ভাল হয়ে যেতে পারে। বস্তুত, পিকে-দিদি বিচ্ছেদের খবর যেদিন ‘ব্রেকিং নিউজ’ হয়, সেদিন রাজধানীর কংগ্রেস শিবিরে যাঁরা দিদি-রাহুল ঐক্যের পক্ষে, তাঁদের মধ্যে দারুণ উল্লাস দেখেছি।
এরপর শুরু হল তৃতীয় অধ্যায়। এবার, গোয়ার ভোটপ্রকাশের পর পিকের সাক্ষাৎকার। তাঁর বক্তব্য: কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মোদি-বিরোধী সর্বভারতীয় জোট সম্ভব নয়। বিরোধী জোটে কংগ্রেসকে প্রয়োজন। তারপরই এক সপ্তাহে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা ও সোনিয়ার সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করলেন। প্রচারিত সংবাদ- পিকে কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন। তিনি কংগ্রেসের ভোটকুশলী, না কি এবার কংগ্রেস নেতা? না দেশের অ-বিজেপি দলগুলোর সঙ্গে কংগ্রেসের সমন্বয় সাধনের প্রধান নির্ধারক চরিত্র? এ যেন ওটিটি-র রোমহর্ষক ওয়েব সিরিজ! এরপর, সর্বশেষ এপিসোড। পিকে কংগ্রেসে যোগ দিলেন না। প্রশ্ন, কংগ্রেসের প্রস্তাব মানলেন না পিকে, না কি তিনি সোনিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন? না কি কংগ্রেসই তাঁকে গ্রহণ করল না? এসব বিশ্লেষণও শুরু হয়ে গেল।
সাংবাদিকতার এই প্রাত্যহিক তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে যাওয়ার চেষ্টা করি। বলতে পারেন, লেট্স মুভ বিয়ন্ড ব্রেকিং নিউজ। প্রথমত, পিকে-কে এই দেশের প্রায় সব অ-বিজেপি রাজনৈতিক দলের নেতাদেরই প্রয়োজন। কারণ, পিকের ভারতীয় নির্বাচনী রাজনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে আছে এক অমোঘ প্রজ্ঞা, যা বিজেপি নেতারাও মানবেন। দ্বিতীয়ত, এই অসাধারণ যোগ্যতার পাশাপাশি পিকের সমস্যা হল, ভোটকুশলী হিসাবে তিনি যে অ্যাকশন প্ল্যান দেন, তাতে সম্পূর্ণ ‘আজাদি’ চান। অর্থাৎ, পিকের ক্লায়েন্ট রাজনেতাকে পিকের উপর সম্পূর্ণ ভরসা করতে হবে। আউটসোর্স মানে আউটসোর্স। পঞ্চায়েতের মতো নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসন হলে চলবে না। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের ক্ষেত্রে এ কাজটা সহজ নয়। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ ভোটে ভাল ফল হয়েছে, কিন্তু প্রার্থী মনোনয়নেও পিকের টিমের নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে কথা উঠেছিল। তৃতীয়ত, যে-সমস্যা এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে: শুধু ভোটকুশলী নয়, পিকে নিজেই রাজনৈতিক শীর্ষপদের দাবিদার। নীতীশ কুমার তঁাকে জেডিইউ দলের সহ-সভাপতির পদ পর্যন্ত দিয়েছিলেন, তিনি রাজি হননি।
বিহারের প্রায় সব নেতা ও বহু সাংবাদিক মনে করেন পিকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। অর্থাৎ, আবার বিহারের এক ব্রাহ্মণ মুখ্যমন্ত্রী, যেমনটা ছিলেন জগন্নাথ মিশ্র। নীতীশ কুমারের সঙ্গে পিকের বিচ্ছেদের মূল কারণও নাকি এটাই।
আবার, তৃণমূল কংগ্রেসেও নাকি তিনি ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট হতে চান। কিন্তু চাইলেই কি তা হওয়া যায়? চতুর্থত, এবার কংগ্রেসের কাছেও দীর্ঘ প্রেজেন্টেশনে পিকে বলেছিলেন, মোদি-শাহ তথা বিজেপির প্রধান টার্গেট হল নেহরু-গান্ধী পরিবার। বিজেপির এই আক্রমণের আলেখ্যকেই সম্পূর্ণ ভোঁতা করে দেওয়া সম্ভব, যদি গান্ধী পরিবার দলের সভাপতির পদ থেকে সরে গিয়ে অ-গান্ধী কোনও নেতাকে দলের সভাপতি করে দেয়। তাহলেই বিজেপি বিপদে পড়ে যাবে। মানে, মনে করুন, শচীন পাইলটের মতো কেউ কংগ্রেস সভাপতি আর পিকে ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট। রাহুল-প্রিয়াঙ্কার পক্ষে এহেন প্রস্তাব মানা কি সম্ভব? মুখে যাই বলুন, ইস্তফার নাটক যাই হোক, গান্ধী পরিবার কি দলের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে আদৌ চায়? না, চায় না।
তাছাড়া পিকে ভোটের জন্য খরচের যে-বাজেট দেন, তা দেখেও রাহুল গান্ধীর চক্ষু ছানাবড়া। পিকের সাফ কথা: ‘দেয়ার ইজ নো ফ্রি লাঞ্চ’। বিজেপি হাজার-হাজার কোটি টাকা খরচ করবে, আর কংগ্রেস চাইবে ২০২৪ সালে সব আলেখ্য তৈরি হবে বিনি পয়সার ভোজে, তা-ও কি হয়? ভোট রাজনীতিতে ভারতে টাকা সর্বদাই বড় ফ্যাক্টর।
তবে, এত কিছুর পরেও বলব, আবার যদি ‘ব্রেকিং নিউজ’ হয় যে পিকে-কংগ্রেস সম্পূর্ণ আলবিদা হল না, তাহলেও অবাক হব না। কেননা, রাজনীতিতে পূর্ণচ্ছেদ বলে কিছু নেই। তিষ্ঠ ক্ষণকাল। পিকে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে পদাধিকারী হননি, কিন্তু কংগ্রেসের রাতারাতি ‘শত্রু’ হয়ে গিয়েছেন কি? কংগ্রেস ছাড়া বিরোধী জোট সম্ভব নয়- এই কথা তো তিনি বিশ্বাস করেন। মমতা, পাওয়ার, স্টালিন, কেজরিওয়াল, কেসিআর, উদ্ধব এমনকী, নীতীশ কুমার পর্যন্ত পিকে-কে পছন্দ করেন এবং সম্পর্ক রক্ষা করেন, কেন? কারণ একটাই, তাঁকে সবাই চেনে-জানে, কনফিডেন্সে নেয়। মোদি-বিরোধী জোট গঠনে, ২০২৪ সালের আসন সমঝোতার পাটিগণিতে, কে কত আসন পাবে- এসব চূড়ান্ত করতে পিকে এক মস্ত বড় ম্যাজিশিয়ানের ভূমিকায় আকস্মিকভাবে অবতীর্ণ হতে পারেন। এমনকী, আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী বাছাইয়ের রাজনীতিতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন। অতএব, খেলা এখনও শেষ হয়নি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.