’৮৭ সালে দিল্লি গিয়ে দেখেছিলাম, রাজীব গান্ধী পরিবারের সকলের সঙ্গে আবির খেলছেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি হোলি উৎসবে সাধারণ মানুষকেও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। তখনও রাজনৈতিক নেতাদের হোলি এখনকার মতো রাষ্ট্রীয় ই-ভোল্টে পরিণত হয়নি। এখন নেতাদের সমস্ত উৎসবই নানা ধরনের ‘ইমেজ’ ও ‘ন্যারেটিভ’ তৈরির কারিকুরি। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
‘দোল’ আর ‘হোলি’ এক নয়। আমরা কলকাতায় বসন্তোৎসব, শান্তিনিকেতনের নাচ-গান দেখেছি, কিন্তু উত্তর ভারতের হোলি আমার দীর্ঘজীবনে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন উৎসবের অভিজ্ঞতা। তা সে বৃন্দাবন-মথুরায় লাঠি নিয়ে মারামারিই হোক কিংবা বিহারের পাটনার ‘হোলি হ্যায়’।
তবে রাজধানী দিল্লির হোলি ‘হাইপাওয়ার’ হোলি মিলন। রাজনেতাদের মধ্যে বিশেষত মন্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আবির খেলা হত তখনকার ৭ নম্বর রেস কোর্স রোডে। প্রধামন্ত্রীর বাসভবনে। আমি যখন ’৮৭ সালে প্রথম দিল্লি যাই, তখন দেখেছি রাজীব গান্ধী পরিবারের সকলের সঙ্গে আবির খেলছেন। তখনও রাজনৈতিক নেতাদের ‘হোলি খেলা’ এখনকার মতো রাষ্ট্রীয় ই-ভোল্টে পরিণত হয়নি। তাই তখনও রাজীব গান্ধীর বাড়িতে দোল ছিল ঘনিষ্ঠদের নিয়ে আবির খেলা। রাজীবের মা ইন্দিরা ছোটবেলায় কিছুদিন শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই সেখানে গুরুদেবের তৈরি বসন্তোৎসবের রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ অনুভব করেছেন। তিনি নিজেও বাড়িতে শান্তিনিকেতনের সেই সংস্কৃতি প্রয়োগ করেছিলেন। হলুদ তাঁতের শাড়ি, কপালে লাল-হলুদ আবির। এসব ইন্দিরা তাঁদের পরিবারে চালু করেন। রাজীব গান্ধীও ‘বিশ্বভারতী’-র আচার্য ছিলেন বেশ কিছুদিন। শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব তিনিও খুব কাছ থেকে দেখেন। তবে, সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল সোনিয়া নিজে ইতালি থেকে আসা বিদেশিনী হয়েও ভারতের এই রঙের উৎসবের আনন্দ খুব গভীরভাবে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন। ভাবতে অদ্ভুত লাগে সোনিয়া কীভাবে নিজেকে তিল-তিল করে ‘ভারতীয়’ করে তুললেন।
রাজীব-সোনিয়া যখন রেসকোর্স রোডে হোলির উৎসব করতেন, তখন সেখানে নিয়মিত হাজির থাকতেন সাংবাদিক সুমন দুবে ও তাঁর স্ত্রী, রাজীবের যুগ্মসচিব মণিশংকর আইয়ার এবং জি. পার্থসারথি। বেশ কয়েকবার অমিতাভ বচ্চনও ছিলেন। বচ্চন পরিবারের সঙ্গে গান্ধী পরিবারের সম্পর্ক দীর্ঘদিন অসাধারণ থেকেছিল। মণিশংকর আইয়ারের কাছে গল্প শুনেছি ভারতের প্রতিটি পুজো-পার্বণ নিয়ে সোনিয়া গান্ধীর ছিল প্রবল উৎসাহ। মণিশংকর নিজে খুব একটা আস্তিক মানুষ না হলে কী হবে, তা নিয়ে পড়াশোনা করেন চিরকাল। হোলিকা দহন, কামদহনের রাত্রির তাৎপর্য সম্পর্কে সোনিয়া নিজে অনেক পড়াশোনা করেন। এছাড়া প্রবীণ কংগ্রেস নেতা কাশ্মীরের রাজা হরি সিংয়ের পুত্র করণ সিং হিন্দু ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার বিষয়ে বিশেষ প্রাজ্ঞ হওয়ার দরুন তিনিও সোনিয়াকে পড়িয়েছেন। তবে অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর হোলি উৎসবে সাধারণ মানুষকেও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। তিনি দরজা খুলে দেন সবার তরে। হোলির দিন আমরা সবাই যেতাম।
সে এক দারুণ মজার ব্যাপার! এখন রাজনৈতিক নেতাদের সমস্ত উৎসবের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই নানা ধরনের ‘ইমেজ’ ও ‘ন্যারেটিভ’ তৈরির কারিকুরি। তাই পিছন ফিরে তাকিয়ে ভাবি- অটলবিহারী বাজপেয়ীর সেই হোলি উৎসবেও কি এ ধরনের মিডিয়া-কেন্দ্রিক কলাকৌশল ছিল? এ প্রশ্নের সরাসরি কোনও জবাব আমার কাছে নেই। মানে, আমি জানি না। সেভাবে দেখলে এখন হয়তো বা কারও মনে হতেই পারে, গান্ধীজি যে ফকির সেজে ট্রেনের থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত করতেন সেটাও ছিল ভাবমূর্তি তৈরির খেলা। এসব নিয়ে তো এখন বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। তা হোক। আমার কিন্তু বাজপেয়ীর বাড়ির সেই উৎসব দারুণ লাগত। বাজপেয়ী অবশ্য ‘গিলা হোলি’ বা জলের হোলি খেলতেন না। শুকনো আবির খেলতেন।
প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি তো! এসপিজি মানে ‘স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ’-এর কঠোর নিরাপত্তা ছিল তখনও। তবে এখনকার মতো নয়। এখন তো লোহার দুর্গ! তখন আমাদের বলা হত বাইরে থেকে কেউ যেন হাতে বা পকেটে আবির নিয়ে না আসে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেই আবিরের ব্যবস্থা করা হত। বড় বড় রুপোর ট্রেতে নানা রঙের আবির টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা হত। কাঠের টেবিল কাচ দেওয়া যেমন আমাদের ড্রয়িং রুমে রাখা হয়। আর তার উপর একদিকে থাকত আবির আর অন্যদিকে নানা ধরনের মিষ্টি। লাড্ডু, গুজিয়া (‘গুজিয়া’ মানে কিন্তু সেখানে আমাদের বাঙালি গুজিয়া নয়- এগুলো হল ঘিয়ে ভাজা জিভেগজার মতো উত্তর ভারতীয় মিষ্টি) ইত্যাদি।
বাজপেয়ীজি ভাং খেতেন, তবে খুব সামান্য। নেশা করার মতো নয়। ভাং তো বেনারসে বিশ্বনাথ মন্দিরে শিবকে পুজোয় দেওয়া হয়। বাইরে দোকানে ‘ঠান্ডাই’ বলে বিক্রি হয়। বৃন্দাবনেও হোলির দিনে খুব প্রচলিত। আমরা লাইন দিয়ে যেতাম। বাজপেয়ীজি দেশের প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তাঁকেও রং মাখাতাম। একদম রং মেখে তিনি ভূত হয়ে যেতেন। বাজপেয়ীর কন্যা নমিতা ও জামাতা রঞ্জন ভট্টাচার্য তো থাকতেনই। ওঁরা বাজপেয়ীকে ‘বাবজি’ বলে ডাকতেন। তা বাবজি আবার খুব ভালবাসতেন নাতনি নেহা-কে যার ভাল নাম নীহারিকা। নেহা তো এখন লেডি। নেহার সঙ্গে বাজপেয়ী খুব রং খেলতেন। নেহা দাদুর কোলে বসে থাকত সারাক্ষণ।
আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলি। বাজপেয়ীর পাশাপাশি তাঁর উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতেও ব্যাপকভাবে রং খেলা হত। আমি প্রথম আদবানির বাড়িতে যাই তাঁর পান্ডারা পার্কের বাড়িতে। সে বড় সুখের স্মৃতি। পরে তিনি ৩০ নম্বর পৃথ্বীরাজ রোডে চলে এলেন। সেই বাড়িতেই তিনি এখনও থাকেন। এই বাড়িতে ছিল দুটো বিশাল লন। বাইরে একটা আর ভিতরে আরও বড় একটা। বড় লনে আদবানিজির জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী বা কন্যা প্রতিভার জন্মদিন পালনের পার্টি হত। কিন্তু হোলির মিলনোৎসব হত বাইরের লনে। পান্ডারা পার্কের লন ছিল ছোট, কিন্তু সেখানেও জল হোলি হত।
আদবানি আর বাজপেয়ীজির ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল বড় মধুর। আদবানিজি হোলির দিন ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই সাড়ে আটটা নাগাদ চলে যেতেন বাজপেয়ীর বাড়ি দেখা করতে। বয়সে সামান্য ছোট ছিলেন তিনি। একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন, মানে যাকে বলে সমসাময়িক। দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে আবির মাখাতেন। আমরা সে দৃশ্য দেখতাম। তারপর আদবানি ফিরে আসতেন নিজের বাড়ি। ততক্ষণে নিজের বাড়িতে চাঁদের হাট। এক-এক করে সব মন্ত্রী, নেতারা আসতে শুরু করে দিতেন। যশবন্ত সিন্হা থেকে শুরু করে শত্রুঘ্ন সিন্হা, সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ- সবাইকে প্রবলভাবে রং মাখানো হত। কংগ্রেসের নেতারা, এমনকী, লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়াম সিংহ যাদব পর্যন্ত এসেছেন ওঁর বাড়ি। রাজনীতি নিয়ে যতই বিরোধ থাক, সংসদে অথবা সংসদের বাইরে সেদিন হোলি মিলনে কিন্তু কোনও ঝগড়াঝাটি ছিল না।
একটা বিশাল প্লাস্টিকের চৌবাচ্চা ছিল। সেখানে রং গোলা থাকত। আদবানি-কন্যা প্রতিভা সেই বিশাল চৌবাচ্চায় অনেককে ঠেলে ফেলে দিতেন। তবে কখনওই অসম্মান বা রুচি-বহির্গত কিছু হতে দেখিনি। নিজের বাবাকেও বালতি করে রং এনে ঢেলে দিতেন মাথার উপর।
শুধু রাজনেতা নয়, সেখানে আসতেন অনেক ফিল্মস্টার, অনেক খেলোয়াড়। একবার তো ভূতের মতো একজন ব্যক্তিকে দেখলাম চেয়ারে বসে আছেন গালে হাত দিয়ে। চিনতে পারিনি তাঁকে। অনেকক্ষণ পর কাছে এসে বুঝলাম তিনি আর কেউ নন, ফিল্মস্টার মনোজ কুমার! সঙ্গে ছেলে জয়ন্ত ও স্ত্রী গীতিকা। আদবানির স্ত্রী প্রয়াত কমলা দেবীও ছিলেন প্রচণ্ড ইনভলভ্ড। তিনি তো পুরো দোলের এই উৎসবকে মাত করে রাখতেন। মন্ডা মিঠাই, নমকিন, শরবত এসব তো আসতই।
তবে রামবিলাস পাসোয়ান আর লালুপ্রসাদ যাদবের হোলিও মাঝেমধ্যেই হত দিল্লির বাড়িতে। বিহারের হোলি মানে ব্যাপারই আলাদা লিট্টি-চোখা থেকে পকোড়া-লাড্ডু। এখন ভাবি, বোধহয় ক্ষমতার স্নায়ুকেন্দ্রে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্যই মাঝেমধ্যে লালু-রামবিলাস দিল্লি এসে হোলি করতেন। খালি গায়ে গামছা জড়িয়ে ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরে লালুর ভোজপুরি হোলির গান আর নাচ এসবই বোধহয় আমজনতা আর রাজধানীর ক্ষমতাবৃত্তর সংযোগসাধন।
‘হোলি সংস্কৃতি’ মূলত হিন্দি বলয়ের আধিপত্য হলেও কোন রাজনৈতিক নেতা এটা নিয়ে কতটা হইচই করবেন সেটা কিন্তু সবসময়ই তাঁর ব্যক্তি চরিত্রর উপর নির্ভর করে। যেমন, বিহারের হয়েও নীতিশ কুমারকে কোনও দিনই হোলি নিয়ে হাইপার-রাজনীতি করতে দেখিনি। যেমন, প্রধানমন্ত্রী হয়েও মনমোহন সিংহকেও হোলির দিন দেখেছি খুবই ব্যক্তিগত পরিসরেই থাকতে। সে-অর্থে মনমোহন চিরকালই টেকনোক্র্যাট প্রধানমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রী। তিনি কোনও দিনই মানবজমিনের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। হোলির দিন প্রণব মুখোপাধ্যায়কেও আমি খুব বেশি হইচই করতে দেখিনি।
এত বছর পর মনে হচ্ছে, সেই দিল্লিটাও কি আছে? বাজপেয়ী নেই, লালু সিবিআই আর অসুস্থতা নিয়ে অনেকটাই ম্রিয়মাণ। আদবানি আছেন, কিন্তু ৯৪ বছর বয়সে, বিশেষত পত্নীবিয়োগের পর এখন তিনি বড় একা। তবে দলীয় ভেদাভেদ, নির্বাচনী রাজনীতি যাই হোক, দিল্লিতে হোলির মিলন উৎসব সব সংঘাত ভুলিয়ে দেয় এখনও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.