ক্রিকেট ভক্তদের ঘৃণার মুখে হার্দিক।
অর্পণ দাস: ক্রিকেট এক বলের খেলা। ক্রিকেটারদের স্টার-ভ্যালুও কি তাই? এক মুহূর্তে হিরো। জনগণমনের অধিনায়ক। পরের মুহূর্তেই হয়তো গোটা দেশের ধিক্কার ধেয়ে আসবে তাঁর দিকে। ক্রিকেট যে দেশে ধর্ম, সেখানে এই ঝুঁকিটা নিয়েই মাঠে নামতে হয় সব খেলোয়াড়কে। ক্রিকেটাররা আসলে ট্রাপিজের দড়িতে হাঁটেন।
ক্রিকেটারদের ঈশ্বর হিসেবে পুজো করে যেমন মাথায় তুলে রাখা হয়, তেমনই দেবতাকে স্বর্গভ্রষ্ট করতেও বেশি দিন লাগে না। কুশপুতুল পোড়ানোর ইতিহাস থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মিম, ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে’। সেই রোষ যে কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা নিশ্চয়ই এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন হার্দিক পাণ্ডিয়া (Hardik Pandya)। কাঁটার মুকুট যে পরেছেন তিনি। তিনি রক্তাক্ত হচ্ছেন, সমালোচিত হচ্ছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, খেলোয়াড় জীবন ছানবিন করা হচ্ছে। দেশের ক্রিকেটপাগলদের চর্চায় উঠে এসেছেন হার্দিক পাণ্ডিয়া।
আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই বেনজির আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে মুম্বইয়ের নতুন অধিনায়ককে। গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ধিক্কার উড়ে এল গ্যালারি থেকে। সোশাল মিডিয়ায় তাঁর নতুন ডাক নাম হল ‘ছাপরি’।
রোহিত শর্মাকে সরিয়ে হার্দিকের হাতে অধিনায়কত্ব তুলে দেওয়ায় মুম্বই ভক্তদের ক্ষোভ হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের পুরনো মাঠে যেভাবে আক্রমণের শিকার হলেন হার্দিক, ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আগে কি কখনও ঘটেছে? মাঠ থেকে দূরে বসা বিদেশি ধারাভাষ্যকাররা পর্যন্ত বিস্মিত। যে দেশের মানুষের শয়নে, স্বপনে, জাগরণে শুধুই ক্রিকেট আর ক্রিকেট। যে দেশে ক্রিকেটাররা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের সমান, সেই দেশে এক ক্রিকেটার ধিক্কৃত হচ্ছেন! বন্দিত এক নায়ক নিন্দিত হচ্ছেন! স্মরণকালের মধ্যে এ দৃশ্য দেখেইনি ক্রিকেটবিশ্ব। তাই অবাক বিদেশিরাও।
হার্দিক পাণ্ডিয়া কি নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলছেন না? ফেলারই তো কথা। এই দলটাকেই তো ২০২২-এ আইপিএল দিয়েছেন হার্দিক। অভিষেকেই চ্যাম্পিয়নের মুকুট পড়েছে গুজরাট। গতবারের ফাইনালিস্টও তারা। চেন্নাই আর গুজরাটের রক্তের গতি বাড়িয়ে দেওয়া ফাইনালে শেষ বলে হার মানতে হল হার্দিকের দলকে। চ্যাম্পিয়নের রাজমুকুটের পরিবর্তে জুটল রানার্সের সান্ত্বনা। সেটাই বা কম কীসে!
এবার মুম্বই জার্সিতে হতেই পারত রাজকীয় প্রত্যাবর্তন। কিন্তু বাস্তবে মাঠে কুকুর ঢুকে পড়তে স্টেডিয়াম জুড়ে শোনা গেল ‘হার্দিক’-এর নাম। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কোথাও যেন রুচির সীমা ভেঙে দিল। হার্দিক কি এমনটাই প্রত্যাশা করেন? ক্রিকেট তো ভদ্রলোকের খেলা। দর্শকরা ভুলে গেলেন ভদ্রতা, শালীনতা আর অশালীনতার সীমারেখা। দেশ বদলে যাচ্ছে। মানুষ হয়ে পড়ছে অসহিষ্ণু। খেলার মাঠেও অসহিষ্ণুতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
বিষয়টা শুধু মুম্বই-ভক্তদের মধ্যে থেমে থাকলে তবু কিছু যুক্তি পাওয়া যেত। কিন্তু এই মুহূর্তে গোটা দেশ যেন মেতে উঠেছে হার্দিক-বিদ্বেষে। শুধু বাইশ গজের পারফরম্যান্স নয়। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চলছে তীব্র কাটা-ছেঁড়া। অথচ মাস কয়েক আগেও রোহিত-বিরাটদের সঙ্গে একই তালিকায় ছিল হার্দিকের নাম। গত বছরের বিশ্বকাপে টিম ইন্ডিয়ার অলরাউন্ডার হিসেবে শুরুটা খারাপ করেননি হার্দিক। তখন বিশ্বজয়ের স্বপ্নে মশগুল গোটা দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চোটটা অভিশাপ হয়ে নেমে এল তাঁর জীবনে। ছিটকে গেলেন টুর্নামেন্ট থেকে।
চোটের খাঁড়া যে কোনও মুহূর্তে নেমে আসতে পারে। সংশ্লিষ্ট প্লেয়ারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না তা। হার্দিকের অবশ্য যুক্তি ছিল, ইঞ্জেকশন নিয়েও তিনি চেষ্টা করেছিলেন মাঠে নামার। কিন্তু মাঠে নেমে ঘাম-রক্ত না ঝরালে এই ধরনের কথার কোনও মূল্যই থাকে না। শেষ কথা বলে পারফরম্যান্স। ওই টুর্নামেন্টেই আহত ম্যাক্সওয়েলের অমানবিক ইনিংস দেখেছে ক্রিকেট প্রেমীরা। ফলে হার্দিকের চোট নিয়ে ফিরে এল সেই পুরনো প্রশ্ন। জাতীয় টিমে খেলার সময়ই আহত হন। আইপিএল এলেই তিনি পুরো ফিট।
বিশ্বকাপের পর পরই ১৫ কোটি টাকায় মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে ফিরে এলেন হার্দিক। রোহিতের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দি দেখতে তৈরি ছিল ক্রিকেট ভক্তরা। সমস্যা শুরু হল মুম্বইয়ের অধিনায়ক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণার পর। সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম হিসেবে উঠে এল হার্দিকের নাম। কিন্তু সেটা ছিল ট্রেলার মাত্র। আইপিএল শুরু হতেই আগ্নেয়গিরির উদগীরণ দেখল গোটা দেশ। সবাই সমস্ত রাগ উগড়ে দিলেন হার্দিকের উপরে।
বিতর্ক আর হার্দিক যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এর আগেও বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। সেটা যত না ক্রিকেটীয় কারণে, তার থেকেও বেশি তাঁর ভাবমূর্তির জন্য, আলটপকা মন্তব্য করার জন্যও।
তবু যেন ‘শিক্ষা’ হয়নি তাঁর। মাঝেমাঝেই তাঁর শরীর থেকে খসে পড়ে ক্রিকেটারের জোব্বা। তিনি ভুলে যান ক্রিকেটারদের সামনেও ঝুলছে ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’-এর অদৃশ্য এক সাইনবোর্ড। হার্দিক সে সবের ধার ধারেন না।
আইপিএলে রোহিতের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুম্বইকে সাফল্যের হাইওয়ে-তে নিয়ে যাওয়া যেত। সুসম্পর্ক রেখে মহাযুদ্ধটা জিতেও নেওয়া যেত। অথচ মাঠে দেখা গিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। রোহিতকে দূরে ফিল্ডিং করতে যেতে বলেছেন। অন্য কারোর কোনও পরামর্শ শুনছেন না। কেনই বা শুনবেন? এ দলের অধিনায়ক হার্দিক, তিনিই বলবেন শেষ কথা। এ রকম একটা ‘অ্যাটিটিউড’ নিয়ে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাতে জয় এলে হয়তো সমালোচকদের মুখ কিছুটা বন্ধ করা যেত। কিন্তু দুম্যাচ যেতে না যেতেই মুম্বইয়ের সাজঘরে ঢুকে পড়েছে হারের আতঙ্ক।
এমন প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে চোট-পর্বের পর আইপিএল না জাতীয় দল, কোনটা তাঁর প্রাধান্য? হার্দিকের আচরণে অন্তত তার স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। দেশের নীল জার্সি পরা নিশ্চয়ই খুব সহজ নয়। প্রতিযোগিতা বাড়ছে প্রত্যেক দিন। আইপিএলেই হয়তো নতুন মুখ উঠে আসবে তাঁর বিকল্প হিসেবে।
স্মৃতি এমনিতেই বিশ্বাসঘাতক। ভারতের হয়ে কবে কোন ম্যাচে পাণ্ডিয়া দুরন্ত পারফরম্যান্স করেছেন, তা লোকে ইতিমধ্যেই ভুলতে শুরু করেছে। ২০১৬-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শেষ ওভারে মাত্র দুই রান দিয়ে ম্যাচ জেতানো কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৪৩ বলে ৭৬ রানের ইনিংস এখন অতীত। ভারতের ক্রিকেটে নায়ক আসবে-যাবে। হার্দিক যত দ্রুত সেই সত্য বুঝে নেবেন, ততই তাঁর পক্ষে মঙ্গল। কিন্তু হার্দিকের দলবদল এবং তার পরবর্তীতে ধেয়ে আসা আক্রমণ মনে করিয়ে দিচ্ছে আমরা-ওরার বিভাজন। যতক্ষণ আমাদের ততক্ষণ স্তুতি। অন্য দলের হলেই চলবে ট্রোলিং।
কেউ জানে না কত দিন চলবে এই আক্রমণ। সোশাল মিডিয়ায় ‘রিচ’ কমলেই হয়তো আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে হার্দিকের জন্য। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা যায় কেন এত ক্ষোভ? কেন টার্গেট হার্দিক? অধিকাংশ মানুষের কাছেই হয়তো এর স্পষ্ট উত্তর নেই। মুম্বই ভক্তরা বলতে পারেন, রোহিত শর্মার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে।
কিন্তু গুজরাটকে তো প্রথম মরশুমেই আইপিএল দিয়েছেন পাণ্ডিয়া। যে টুর্নামেন্টে টাকাই শেষ কথা বলে, সেখানে বড় অঙ্কের ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাওয়া কি খুব অন্যায়? নাকি আইপিএলে নতুন রাস্তার খোঁজ দিলেন হার্দিক। ধোনিকে মানুষ দেখতে অভ্যস্ত চেন্নাইয়ের হলুদ জার্সিতে। বিরাট প্রথম থেকেই বেঙ্গালুরুর প্রতি ‘লয়্যাল’। হার্দিক কি ভারতবাসীর সেই চিরাচরিত বিশ্বাসেই ধাক্কা দিলেন? ভালোবেসে দল আঁকড়ে পড়ে থাকার চেয়ে লোভনীয় হয়ে উঠল টাকার অঙ্কটা? সেই জন্যই কি তিনি ‘দলবদলু’?
আইপিএলে ঝাঁ চকচকে দুনিয়ার নীচে থাকা পেশাদার চেহারাকে প্রকাশ্যে এনে দিলেন হার্দিক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.