বারাণসীর প্রত্যেক গলিতে একটিই প্রশ্ন, কী হবে জ্ঞানবাপীতে সার্ভের পরিণাম? এ-প্রশ্নের উত্তর কারওরই জানা নেই। কিন্তু সকলেই জানেন, এই এক উত্তরে বদলে যেতে পারে অনেক কিছুই। জ্ঞানবাপী নিয়ে কী ভাবছে দেবভূমি? গ্রাউন্ড জিরো থেকে দেখে এসে লিখলেন অরিঞ্জয় বোস।
‘অউর এক বাবরি নেহি হোগা! চাহে জো ভি হো যায়ে!’ ছাপোষা এক চায়ের আড্ডা থেকে উঠে আসা এ-কথা কি বর্তমান ভারতবর্ষেরই অন্তরের উৎসার! বিশেষত জ্ঞানবাপী (Gyanvapi Mosque) নিয়ে যখন দেশে তুমুল তর্ক আর চায়ের এই ঠেকটি যখন খোদ বিশ্বনাথের বিশ্বদ্বারে, তখন এহেন কথা চমকে দেয় বইকি! বাদলব্যাকুল শ্রাবণ-দিনে তখন খানিকক্ষণের জন্য ছুটি নিয়েছে বৃষ্টি। চায়ের জন্য চাতক আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম। তেমন কোনও স্থির গন্তব্য ছিল না। এমনিই ইতিউতি ঘুরতে-ঘুরতে চা-দোকান দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। এক কাপ চা চাইতে যাব যখন, তখনই ভেসে এল এই কথা। একে খবরের কাগজের মানুষ, তার উপর আলোচনার বিষয় জ্ঞানবাপী আর বাবরি। এরপর কি আর না দাঁড়িয়ে উপায় আছে! অতএব জলদি এক কাপ চা চেয়ে নিয়ে কান পাতলাম সেই আলোচনায়।
সত্যি বলতে, এই শ্রাবণে বারাণসী যাওয়া কোনও খবরের তাগিদে নয়। নির্ভেজাল তীর্থযাত্রাই ছিল উদ্দেশ্য। বিশ্বনাথের দর্শন, বেনারসী পান আর চাট, সেই সঙ্গে গঙ্গার ধার ধরে হেঁটে নয়নাভিরাম ছবি তোলা। এর বাইরে উইশলিস্টে বেশি কিছু ছিল না। খানিক ছুটি কাটানোও বলা যায়। তবে কিনা ঢেঁকি আর ধান ভানার প্রবাদটি যে বেনারসেও সত্যি হবে, তা ভাবিনি। তীর্থযাত্রা করতে এসে, প্রথমেই খবর পেলাম, হাই কোর্টের নির্দেশে জ্ঞানবাপীর ভিতরে সার্ভে করবে এএসআই। যে-খবরের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশ, নজর গোটা বিশ্বের, সেই খবর গ্রাউন্ড জিরো থেকে ‘কভার’ করব ভাবতেই পারিনি। সুযোগ যখন একবার পাওয়াই গিয়েছে, তখন আর হাতছাড়া করে কে! অন্যত্র থাকলে কী ঘটছে না-ঘটছে তার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হতো। আর এখন আমি নিজেই সেই খবরের তীর্থে। এর মধ্যে আবার বৃষ্টির নাছোড়বান্দা আবদারে খানিক ঘরবন্দি হয়ে থাকা। বিশ্বনাথের কৃপায় যখন তিনি বিরাম নিলেন, তখনই চা-কে ছুতো করে অলি-গলি-চলি-রাম ফুটপাথে ধুমধাম হয় কিনা পরখ করে নেওয়ার জন্য পথে নামা। আর এসে পৌঁছনো এই দোকানে।
উষ্ণ চায়ের মৌতাতেই তখন আলোচনা সরগরম। যা নিয়ে কথাবার্তা, খবরের সূত্রে তা আমাদের মোটামুটি সবই জানা। দেশের প্রশ্ন হচ্ছে, জ্ঞানবাপী মন্দির না মসজিদ? শিবলিঙ্গ সেখানে আছে না নেই? কিন্তু বাকি দেশের কাছে সেটা বাইরের প্রশ্ন, বেনারসের কাছে সেটাই একেবারে জীবনের গায়ে লেগে থাকা একটি জিজ্ঞাসা। যার উত্তর বদলে দিতে পারে এখানকার জনজীবনের দীর্ঘদিনের যাপনচিত্র। সেই ‘উষ্ণ’ প্রসঙ্গ যখন গরম চায়ের দৌলতে হাতের সামনে পাওয়াই গিয়েছে, তখন পালটা প্রশ্ন করার লোভ সামলানো গেল না। ট্যুরিস্ট পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম, “আপনারা চেয়েছিলেন নাকি যে আরেকটা বাবরি হোক?”
অবশ্য প্রশ্নখানা করার আগে মনে মনে এ পর্যন্ত দেখা বেনারসকে একবার ভাল করে স্মরণ করে নিলাম। বাঙালির কাছে বারাণসীর মাহাত্ম্য বরাবরই বেশ অন্যরকম। বার্ধক্যের বারাণসী থেকে জয় বাবা ফেলুনাথের স্মৃতি। বাঙালির মনে বারাণসী উচ্চারণেই এসে ভিড় জমায় ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক নানা অনুষঙ্গ। তবে হ্যাঁ, খেয়াল করলাম জ্ঞানবাপী বিতর্কের পরের বারাণসীতে একটা চাপা উদ্বেগ যেন থেকে থেকেই ভেসে বেড়াচ্ছে। শ্রাবণের মেঘের থেকে সে-মেঘের অন্ধকার কম কিছু নয়! এর মধ্যেই ঘুরে দেখেছি বিলাসবহুল বিশ্বনাথ করিডোরের চার নম্বর গেটের আশপাশ। পেল্লায় দরজা, সামনে রাখা বিশালাকায় ত্রিশূল, আর তার পাশ থেকেই উঁকি দিচ্ছে সেই বহু বিতর্কিত জ্ঞানবাপী। সামনেই পুলিশের ব্যারিকেড, নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র বলয়ে মাছি গলবার উপায় নেই। মনের ভিতর তখন অজস্র প্রশ্নের ঘুরপাক। এই জ্ঞানবাপী নিয়ে কী ভাবছে দেবভূমি? বিশেষত, সংখ্যালঘুরা। এই শহরেও তো প্রায় ১৫% সংখ্যালঘু।
সেদিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, পরের দিন শুক্রবারে নমাজ পড়তে আসবেন অনেকে। আবার সেদিনই জ্ঞানবাপীতে সমীক্ষায় আসবে এএসআই-এর প্রতিনিধি দল। এই দোটানার ভিতর সংখ্যালঘু মননে ঠিক কী আলো-ছায়া, তা জানবার ইচ্ছা ক্রমে তীব্র হয়ে উঠল এবং ওই করিডোরের গেটের সামনে এক সংখ্যালঘু পথচারীকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। তিনি প্রশ্নটা শুনে খানিক থমকালেন। একবার তাকালেন আমার দিকে। বোধহয় বুঝে নিতে চাইছিলেন, আমি সংবাদমাধ্যমের কেউ কিনা। যে কোনও কারণেই হোক সেই সন্দেহের কুয়াশা কাটতে, বলেই ফেললেন, “এত বছর ধরে তো এখানেই আল্লাহকে স্মরণ করলাম, এবার থেকে তাহলে কোথায় নমাজ পড়ব?” একটু যেন হতাশ হয়েই ফের বললেন, “তাহলে এতদিন ধরে আমাদের সাধনার তো আর কোনও মূল্যই রইল না!” ভদ্রলোকের উত্তরে আমিও চমকালাম। আমি ভেবেছিলাম স্বাভাবিক একটা প্রত্যাঘাত আসবে এই প্রশ্নের উত্তরে। কিন্তু ইনি তো বলছেন একেবারে অন্য কথা। মনে হল, যেন অনেকদিন পর মন খুলে কাউকে কিছু বলতে পারছেন। হয়তো বাইরে থেকে এসেছি বুঝেই মনের আগল খুলেছেন অনায়াসে। আমি আলতো করে বললাম, ”ঠিকই তো!” ভদ্রলোক এবার যেন অজানা ভবিতব্যের উদ্দেশেই বললেন, “যদিও বা মন্দির হয়, এতদিন পরে কেন?” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি চলে গেলেন।
আমার কৌতূহল বাড়ল। গোটা বারাণসীর সংখ্যালঘুরা কি এই কথাই ভাবছেন! জানতে প্রশ্নখানা আর পাঁচজনের দিকে এগিয়ে দিলাম। তবে আর কেউই আমাকে প্রথম ভদ্রলোকের মতো অবাক করলেন না। এবার প্রায় সকলেই এক সুরে যা বললেন, তার অস্যার্থ এই যে, এ সবই রাজনীতির ফলে হচ্ছে। জ্ঞানবাপীতে শিব নেই। এ উত্তর প্রত্যাশিতই ছিল। অতএব প্রশ্নটা এবার হিন্দুদের করলাম। তাঁরা আশ্চর্য হয়ে বললেন, মন্দিরই তো ছিল ওখানে। মন্দির ভেঙে মসজিদ বানানো হয়েছে। তারা আবার আমায় ছবি দেখিয়ে বোঝাতে চাইলেন, যে একটা মসজিদের আকৃতি নইলে মন্দিরের মতো হবে কী করে! আমায় প্রশ্ন করলেন, “বলুন তো, কেন নানা মূর্তি আছে মসজিদের ভেতরে?” ভদ্রলোক কথা শেষ করতে না করতেই পাশের দোকানদার, যিনি পুজোর সামগ্রী বিক্রি করেন, তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “আরে নন্দী মহারাজ কি আল্লাহ্র দিকে তাকিয়ে থাকেন?”
খবরের কাগজের দুনিয়ায় যাদের নিত্য ওঠাবসা, তাঁদের কাছে এ খুব চেনা ন্যারেটিভ। অতএব এলাকাটা আরও ঘুরে দেখতে লাগলাম। ততক্ষণে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে এলাকার দখল নিয়েছে। হাজার হাজার সশস্ত্রবাহিনী চারিপাশের এলাকায় টহল দিচ্ছে। পরের দিন যাতে কোনও গণ্ডগোল না হয় সেটাই লক্ষ্য ছিল প্রশাসনের। সেদিন রাতেই আমাদের বিশ্বনাথ দর্শন। রাত তিনটের সময় মঙ্গলারতি। ঢোকা সেই চার নম্বর গেট দিয়েই। পূর্ণিমা আর দিন কয়েক পরেই। চাপা উত্তেজনায় থইথই বারাণসীতে যেন বেহায়া এক চাঁদ উঠেছে সেদিন। ঠিক জ্ঞানবাপী আর বিশ্বনাথ মন্দিরের মাঝখানটিতে। হঠাৎ নেরুদা মনে পড়ে গেল, ‘In What Language Does Rain Fall Over Tormented Cities?’ জানি না। আমরা কেউই বোধহয় তা জানি না। চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম দুধসাদা জ্যোৎস্নার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া, কোথাও এতটুকু কার্পণ্য নেই। মন্দিরে ঢোকার আগে দেখলাম জ্ঞানবাপীকে। একদম সামনে থেকে। দেখলাম ভিতরে আলো জ্বলছে আর নিরাপত্তারক্ষীরা পাহারা দিচ্ছেন। সামনের দিক থেকে একদম মসজিদের মতো দেখতে হলেও পিছন দিক থেকে কিন্তু একটু অন্য রকম মনে হল। দেখলাম নন্দী সত্যিই তাকিয়ে আছেন এই বিরাট প্রশ্নোত্তর বুকে নীরব জ্ঞানবাপীর দিকে।
পরের দিন সকাল সাতটা থেকে সার্ভে। আমাদের মন্দির থেকে বেরোতে বেরোতে সেদিন প্রায় ভোর পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। পরদিন সকালবেলা যতক্ষণে এলাম, ততক্ষণে সার্ভে শুরু হয়ে গিয়েছে। জ্ঞানবাপী যেন দুর্গের নামান্তর। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। মোবাইল-সহ সমস্ত জিনিস জমা রাখতে হচ্ছে। চারিদিকে পুলিশ। উপস্থিত কিছু উচ্চপদস্থ অধিকর্তা। মসজিদ পক্ষ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। তবে, শীর্ষ আদালতও সমীক্ষায় স্থগিতাদেশ দিল না। অতএব সমীক্ষা জারি থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর নিরাপত্তা আরও বাড়ল শহর জুড়ে। প্রত্যেক গলিতে একটিই প্রশ্ন, কী হবে সার্ভের পরিণাম? এ-প্রশ্নের উত্তর কারওরই জানা নেই। কিন্তু সকলেই জানেন, এই এক উত্তরে বদলে যেতে পারে অনেক কিছুই। অতএব উদ্বেগের মেঘ নামে ফের ঘন হয়ে। বৃষ্টিও যেন অজানা উত্তরের খোঁজেই আপাতত চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। আর তখনই চায়ের খোঁজে পায়ে পায়ে আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম ওই দোকানে। যে বারাণসীকে চাক্ষুষ করলাম, দেবভূমির অন্তরের যে অস্থিরতা টের পেয়েছিলাম এতক্ষণে, সেই জায়গা থেকেই ছুড়ে দেওয়া গেল প্রশ্নখানা, “আপনারা চেয়েছিলেন নাকি যে আর-একটা বাবরি হোক?”
সাত-আটজন যাঁরা আলোচনা করছিলেন, তাঁরা এ-প্রশ্নে এক মুহূর্ত থমকালেন না। একযোগে সোচ্চারে বলে উঠলেন, “কেন চাইব? এতদিন ধরে তো আমরা মন্দিরে গেছি, ওরা মসজিদে গিয়েছে। এখন যদি বাবা মহেশ্বর থাকেন জ্ঞানবাপীর ভিতর, সেটা তো প্রমাণ করবে সার্ভে।” আমি মাথা নাড়লাম। সঙ্গে সঙ্গেই আরেকজনের তুরন্ত মন্তব্য, “যাই-ই হোক না কেন, যা করছে, যা হচ্ছে সবই হচ্ছে আদালতের নির্দেশে। ভাঙলেও ভাঙবে আদালতের নির্দেশে, যেমন আছে তেমন থাকলেও সেটা থাকবে আদালতের নির্দেশে।” জনৈক সংখ্যালঘু বললেন, “কী বলি বলুন তো! আগেকার মুসলিম শাসকরা অনেক মন্দির ভেঙে মসজিদ করেছেন, এখন সেই দায় আমাদের ওপর এসে পড়ছে। কী আর করা যাবে! বরং এখনকার পদ্ধতি অনেক শান্তিপূর্ণ। যা হবে, ঠিক করবে শীর্ষ আদালত।”
বাবরি চায় না বারাণসী। এই কথাটুকুকে সঙ্গী করেই চায়ের দাম মিটিয়ে গঙ্গার দিকে হাঁটা দিলাম। ভরা শ্রাবণের ডুবু-ডুবু ঘাটে ভালো ছবি তোলা যাচ্ছে না বলে খানিক আপশোস হয়েছিল। তবে, বারাণসীর মানুষের মনের যে ছবিটি দেখলাম, তার তুলনা হয় না। নিজে কানে যা শুনলাম, শান্তির ছায়া খোঁজা মানুষের যে চোখ দেখলাম, সে ছবি তুলে রাখলাম মনের আর্কাইভে। দুকূলপ্লাবী গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে শুধু বললাম, ক্যামেরাতে এর থেকে বেশি তৃপ্তিদায়ক আর কোন ছবিই বা তোলা সম্ভবপর হত!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.