সেতু ভেঙেছে গুজরাটে। মৃত ১৪১, আহত অজস্র। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা তেমনই কিছু ক্ষতবিক্ষত মানুষ ভর্তি মোরবির সরকারি হাসপাতালে। প্রধানমন্ত্রী তাদের দেখতে আসবেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেওয়াল রং করে জোড়াতাপ্পি সংস্কারে ব্যস্ত। চিকিৎসায় যাতে বিন্দুমাত্র গাফিলতি না হয়, সেদিকে তো নজর দেওয়া বেশি দরকার ছিল! এই অবস্থা শাসকের দেউলিয়া মানসিকতার পরিচয় নয় কি? রাজদীপ সরদেশাই
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওয় ভারতের শাসনব্যবস্থার হতভাগ্য রূপ যথার্থভাবে ফুটে উঠেছে। কর্মীরা হুড়ুমতালে মোরবি-র হতবিধ্বস্ত সিভিক হাসপাতাল মেরামতির কাজ করে চলেছে প্রধানমন্ত্রীর গুজরাট সফরের আগে- এই চিত্র একটি ডিস্টোপিয়ান তথা বহুধা বিপর্যস্ত বাস্তবের আভাস দেয়। কথা হল, এই হাসপাতালেই ভরতি রয়েছেন মচ্ছু নদীতে সেতু ভেঙে পড়ার পর কোনওক্রমে বেঁচে যাওয়া কিছু নাগরিক।
ছোট্ট শহর মোরবি। আর সেখানে, কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে সদ্য তৈরি সেতু ভেঙে পড়ল (Morbi bridge collapse)। আর তাতে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল- কত কী ঘটে গেল! সেই ট্র্যাজেডি থেকে শহরটা সেরে ওঠার চেষ্টাও করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আহতদের প্রধানমন্ত্রী দেখতে আসবেন বলে সেই মানুষগুলোর সেবা-যত্ন নিয়ে বাড়তি তৎপরতা চলছে, তা নয়। দেখা গেল, সরকারি হাসপাতালটির দুর্দশাগ্রস্ত রূপ ঢাকতে জোড়াতাপ্পি সংস্কারে লেগে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ! ১৪১ জন মানুষের অকালমৃত্যু আর অজস্র মানুষের আহত হওয়ার শোককে লুকিয়ে রাখার জন্য একটা রঙের পোঁচই যেন যথেষ্ট- এই ধারণা আতঙ্কের। কিন্তু, ভুললে তো চলবে না, গুজরাটে এখন নির্বাচনের মরশুম। এবং বহুল আলোচিত ‘গুজরাট মডেল’-এর ‘চমক’ বা চাকচিক্য দিয়ে তো সরকারি হাসপাতালের দুরবস্থা এবং নিষ্কর্মা স্থানীয় প্রশাসনের কালিমাকে ঢাকতে হবে! আর আমরাও বলিহারি, চাকচিক্যময় দুনিয়ার বাসিন্দা, যেখানে ‘পারফেক্ট’ ছবির উপর সত্য কিছু নেই।
গুরমিত রাম রহিমের ধর্মীয় সমাবেশ বা ‘সৎসঙ্গ’-এর সাম্প্রতিক জমায়েতের কথা-ই ভাবা যাক। ‘ডেরা সাচ্চা সৌদা’ সম্প্রদায়ের এই আধ্যাত্মিক প্রধানের সমাবেশে বিধায়ক, মন্ত্রী, ভিভিআইপিদের উপস্থিতি- একেবারে চাঁদমারি ব্যাপার। উল্লেখ করি, এই ডেরা-প্রধান ধর্ষণ ও খুনের দায়ে সাব্যস্ত দোষী। আপাতত ৪০ দিনের জন্য শর্তাধীন মুক্তি পেয়েছেন। এ-ও উল্লেখযোগ্য, মুক্তি ঘটল হরিয়ানায় উপনির্বাচন এবং হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে-আগেই। বিষয়টা কাকতালীয় তো নয়ই, উল্টে ভালরকম সংযুক্ত। কারণ, এই দু’টি রাজ্যেই ডেরা সম্প্রদায়ের বেশ সংখ্যাধিক্য, তথা রমরমা। একটি ভিডিওয় তো দেখা গেল, হিমাচলের এক বিজেপি মন্ত্রী দোষী গডম্যানের কাছ থেকে ‘আশীর্বাদ’ চাইছেন! এ তো একেবারে অভিযুক্ত ধর্ষক-খুনির অপরাধকে জনসাধারণের চোখে নিরপরাধ ঠাওরানোর চরিত্রশুদ্ধির খেলা!
আরও একটি সাম্প্রতিক ভিডিওর কথা স্মরণ করা যাক। ২০০২ সালে বিলকিস বানোর ধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার দায়ে সাব্যস্ত ১১ জন দোষীর যাবজ্জীবন সাজা মকুব হওয়ার পর গুজরাটের ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ তাদের মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। ভাইরাল হয়েছিল সেই ভিডিও। পরে সুপ্রিম কোর্টে গুজরাট সরকারের হলফনামা থেকে জানা যায়, দোষীদের অকালমুক্তির বিরোধিতা করেছিল সিবিআই এবং মুম্বইয়ের বিশেষ আদালত, যারা বিচারপর্ব পরিচালনা করেছিল। এখানেও, রাজনৈতিক অভিসন্ধি অগ্রাহ্য করা যায় না: নির্বাচনী মরশুমে গুজরাটে ‘হিন্দু ভোট’-এর সন্ধান অন্য সবকিছু ছাপিয়ে যাচ্ছে যেন।
চতুর্থ যে-ভিডিওর কথা বলব, সেখানে এই বার্তা আরও স্পষ্ট। পশ্চিম দিল্লির এক বিজেপি সাংসদ, পরভেশ ভার্মা জনতাকে উদ্দেশ করে বলছেন একটি বিশেষ ‘সম্প্রদায়’-কে অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করতে এবং তাদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে। স্পষ্ট করে ‘মুসলমান’ উল্লেখ না করেও, তাঁর উত্তেজক বক্তৃতায় যথেষ্ট প্রসঙ্গ রয়েছে, যার ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না ‘শত্রু’ বলে তিনি কাদের চিহ্নিত করছেন। এমন দায়িত্বহীন ঘৃণাত্মক বক্তৃতার উদ্দেশ্য নির্লজ্জভাবে ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিত করা: দিল্লিও এমন সময়েই পুর নির্বাচনের লড়াইয়ের সাক্ষী হতে চলেছে।
সম্মিলিতভাবে এই ভিডিওগুলো গভীর এক নৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের নির্দেশ করে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বিনষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট। প্রথমত, কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির অভাব দৃশ্যত স্পষ্ট। ঔপনিবেশিক যুগের একটা আইকনিক ব্রিজ সংস্কারের পর জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য আবার খুলে দেওয়া হল, আর মোরবির সরকারি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সচেতনই ছিলেন না- এমন ডাহা মিথ্যে বলে কী লাভ? ওই সেতুতে পুলিশি নিরাপত্তার সুস্পষ্ট অভাব। তাঁরা কীভাবে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সেতুতে অতিরিক্ত ভিড়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করতে পারেন? এ তো কর্তব্যের চরম অবহেলা!
একইভাবে, হরিয়ানা সরকার কীভাবে দাবি করতে পারে যে, তারা ডেরা-প্রধানের প্যারোলের চরম অপরাধ বিষয়ে অবগত নয়? কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিলকিসের অভিযুক্তদের মুক্তিতে নীরব থাকল যেভাবে, সেটাই বা গ্রহণযোগ্য হয় কীভাবে? যদিও, কাকেই বা দোষ দেওয়া যায়, এই মুক্তি তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সবুজ সংকেতেই ঘটেছে। পরভেশ ভার্মার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনুরূপ। বিশেষ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে, জনসমক্ষে এই সাংসদের এমন কথায় বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব খুশি হননি, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভার্মার প্রতি কোনও প্রকাশ্য তিরস্কার তো নেই। এমনকী, দিল্লি পুলিশ কোনওরকম পদক্ষেপও করেনি।
দ্বিতীয়ত, এই প্রতে্যকটি দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের নৈতিক অবক্ষয়কেই সূচিত করে, এবং একই সঙ্গে সূচিত হয় বহুস্তরীয় প্রশাসনিক দুরবস্থা। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা খ্যাত হয়েছেন কর্তব্যপালনে তাঁদের শ্লথ গতি এবং দুর্নীতির সুবাদে! সংস্কারের পর একটা ব্রিজ খোলা হল, তার অবস্থা নির্ণয়ের সাধারণ সুরক্ষাবিধিগুলি না ঝালানোর মধ্য দিয়ে মোরবি প্রশাসনের যে ব্যর্থতা প্রকট হল, তা দিয়েই উপরোক্ত বক্তব্য বাস্তব প্রমাণিত হয়। অভিযুক্ত ও অপরাধী ডেরা-প্রধান যেভাবে জনসমাবেশের আহ্বানের অনুমতিপ্রাপ্ত হলেন, তা থেকে প্রমাণিত, দেশের আইনশৃঙ্খলা কতটা ঝরে পড়েছে। আইনের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার বিধানের কোনও লক্ষণ নেই। বিলকিস বানো মামলায় অপরাধী হত্যাকারী ও ধর্ষকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড উবে যাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত, কীভাবে পক্ষপাতদুষ্ট রাজনীতির মধ্য দিয়ে আইনকে দুমড়ে মুচড়ে নেওয়া যায়। দিল্লিতে সাম্প্রতিক পরভেশ ভার্মার ঘৃণা-ভাষণের বিরুদ্ধে কোনওরকম পদক্ষেপ না করার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, পুলিশ-প্রশাসন কতটা ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হয়ে আছে। ছাত্রনেতা উমর খালিদ দু’-বছর নিরবচ্ছিন্ন কারাবাসের পরেও জামিন পান না, অথচ ক্ষমতাসীন পার্টির সাংসদ কেবল তঁার ক্ষমতার খাতিরে কোনওরকম শাস্তি তাঁর গা ঘেঁষতে অবধি পারে না।
তৃতীয়ত, এত যে অনাচার হচ্ছে, সেসব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ক্ষমতাসীনদের প্রকট নীরবতা আরওই প্রমাণ করে দেয়, নৈতিকভাবে এরা দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। এমন একটা বিপর্যয় ঘটল সেতু ভেঙে, এদিকে ‘ডাব্ল ইঞ্জিন’-এর গুজরাত সরকার সেই দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করতে পারছে না? কোন আক্কেলে তারা এমন একটা শতাব্দীপ্রাচীন সেতুর মেরামতির জন্য একটা বেসরকারি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়ে দিল, যাদের কোনওরকম সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোজেক্টের অভিজ্ঞতা নেই? যেখানে কিনা এই কাজের জন্য খুবই দক্ষ কর্মী ও পরিকল্পনার প্রয়োজন। কীভাবেই বা বিলকিস বানোর মামলা বা বিজেপির পরের পর ঘৃণা-ভাষণের সঙ্গে মোদি সরকারের তাক লাগানো ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ স্লোগান খাপ খায়? না কি এ এক অন্য দুনিয়া? যেখানে সুপ্রশাসন, সামাজিক ঐক্যর মতো বিষয় আমাদের বর্তমান রাজনীতিতে একেবারে বেমানান, এবং ক্ষমতার রাজনীতি-ই সব। সেখানে ভোটব্যাঙ্কের জন্য রাজনৈতিক আদর্শ, মানবিকতা, সাংবিধানিক নৈতিকতা- বিসর্জন দেওয়া যায়।
যেভাবেই হোক ক্ষমতা কায়েম রাখতে হবে- এই মন্ত্রই হল এখনকার অবক্ষয় ও সংঘর্ষময় পরিস্থিতির কারণ। যার পরিণতিতে, ধন্দ জাগে, গণতন্ত্রে এমন নৈতিকতার অভাব মেটানো যাবে কোন জাদুবলে? মহারাষ্ট্রকেই উদাহরণ হিসাবে দেখা যাক। বর্তমান সরকারের বিরোধী পক্ষরা স্লোগান তুলেছে, ‘পানাস খোখে, একদম ওকে’! যার ইঙ্গিত: শিবসেনার ভিতরকার বিদ্রোহীদের পক্ষবদল করার জন্য নাকি প্রত্যেককে ৫০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও, এই বিরোধীরাই যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন বিভিন্ন অন্যায় তোলাবাজি ও টাকা তছরুপের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। তখন তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ওয়াসুলি সরকার’ অর্থাৎ তোলাবাজির সরকার। এই অভিযোগ উড়িয়ে দিলে তো চলবে না। কারণ, তৎকালীন রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখনও তোলাবাজি ও টাকা তছরুপের দায়ে জেলবন্দি। ফলে, দশা হয়েছে এমন, নাগরিকবৃন্দকে এখন দুটো দলের মধ্যে বেছে নিতে হবে কোনও একটিকে, যেখানে কিনা দুটো দলই প্রবল দুর্নীতিতে একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ। ফলে সত্যিকারের পরিবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে অলীক স্বপ্ন।
পরিবর্তন আনার মতো তেমন কেউ নেইও। সম্প্রতি, গুজরাটের (Gujarat) সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনায় অনেকেই একইভাবে ভেঙে পড়েছি। কিন্তু, সামগ্রিক রাজনৈতিক বিবেক যেভাবে ঝুরঝুর করছে, তা আমাদের আরও বেশি করে পীড়িত করা উচিত। দুঃসময় যখন আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে, তখন কবিতা আমাদের আত্মাকে কিছু উপশম কি দেবে না? ‘উমিদ পর হ্যায় দুনিয়া কায়েম,/ ইয়ে ওয়াক্ত বুরা ভি টল জায়েগা,/ রৌশনি মে ফির বদল জায়েগি,/ সময় কা সাথ বদল জায়েগা…’ এই পৃথিবী তো আশাতেই বেঁচে আছে। খারাপ সময় একদিন কেটে যাবেই। আলোয় আলো হবে সব, সময়ের সঙ্গও বদলাবে। পরিবর্তন আসবেই তার হাত ধরে।
পুনশ্চ আমাকে অনেকেই প্রায় জিজ্ঞেস করে, সারাক্ষণ প্রাইম টাইম নিউজে থাকার কারণে যে নৈরাশ্য চেপে ধরে আমাকে, সেই খোলস থেকে বেরিয়ে আসি কী করে? আমার ওষুধ বলতে, পুরনো দিনের হিন্দি গান আর বিখ্যাত সব ক্রিকেট ম্যাচ। আপনারাও চেষ্টা করে দেখতে পারেন!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.