বিভিন্ন অ্যাপ প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে জুড়ে আছেন যে অসংখ্য ‘পার্টনার’, যাঁরা নানারকম ডেলিভারির কাজ করে থাকেন, তাঁরা কি শ্রমিকের মর্যাদা পান? তাঁরা কি শ্রম আইনের আওতায় পড়েন? চাকরির শর্তস্বরূপ কতখানি নূন্যতম সুযোগ ও সুবিধা পান? কর্নাটক সম্প্রতি এই গিগ-মজুরদের একটি বিল এনেছে। তা আইনে রূপান্তর হলে বাস্তব ছবিটা বদলাবে কতটা? লিখছেন অশোককুমার মুখোপাধ্যায়।
২৯ জুন, কর্নাটক সরকার অ্যাপ্লিকেশন-ভিত্তিক গিগ-মজুরদের জন্য ‘কর্নাটক প্ল্যাটফর্ম বেস্ড গিগ ওয়ার্কার্স (সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার) বিল ২০২৪’ প্রকাশ করে, এর উপর, জনসাধারণের মতামত আহ্বান করেছে। যদি এই বিল পাস হয়, তাহলে কর্নাটক হবে রাজস্থানের পরেই দেশের দ্বিতীয় রাজ্য, যারা গিগ-মজুরদের জন্য আইন প্রণয়ন করল।
২ বছরের কিছু আগে, যখন একদল ডেলিভারি রাইডারকে সল্টলেকের একটি বয়স্ক কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় ফুটপাথের উপর বসে থাকতে দেখি– আলাপ করতে ইচ্ছা হয়েছিল। সেই পরিচয় ক্রমশ গাঢ় হয় এবং খোঁজখবর নেওয়া শুরু করি। বোঝা যায়– লন্ডন, নিউ ইয়র্কে এদেরই যে প্রতিরূপ-কর্মীরা জীবিকার লড়াই চালিয়ে নিজেদের ভাসিয়ে রেখেছে, তাদের সঙ্গে এদের মূলে কোনও ভেদ নেই, প্রত্যেকেরই সমস্যা একরকম। বুঝতে শিখি, জামাকাপড় আলাদা হলেও, এরা-ই ডিজিটাল যুগের শ্রমিক; কার্ল মার্কসের বলা কারখানার শ্রমিকদের শপ ফ্লোরের বিচ্ছিন্নতা সরে এসেছে সেল্স ফ্লোরে! আর, ঠিক তখনই এদের নিয়ে একটি আখ্যান রচনার বাসনা তীব্র হয়, জন্ম নেয়– ‘এক নম্বর আকাশগঙ্গা’।
আখ্যানের গবেষণার কাজে চেনা হয়েছিল জন কার্কের সঙ্গে। পূর্ব লন্ডনের জন কার্ক ফুড ডেলিভারি রাইডার। সদ্য কৈশোরের চৌকাঠ ডিঙোনো তরুণটি মোটর বাইক চেপে বাড়ি-বাড়ি অর্ডার মাফিক খাবার পৌঁছে দিয়ে, যা রোজগার করে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অন্য কারণে ক্রমশ বাড়ছিল ওর অসন্তোষ। নামী দোকানের বাইরে, ময়লার স্তূপের সামনে, নিজের অস্তিত্ব বিলোপ করে, প্রায় ছায়া-মানুষ হয়ে তাকে দঁাড়িয়ে থাকতে হয়, ওই রেস্তোরঁার টয়লেট সে ব্যবহার করতে পারবে না, পাবলিক টয়লেট পেতে তাকে যেতে হবে প্রায় ২ কিলোমিটার, রাস্তায় একটু বেজায়গায় গাড়ি রাখলেই ফাইন, এই খাতে, পকেট থেকে দিনে প্রায় ৬৫ পাউণ্ড চলে যায়, বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নেই। মানবাত্মার এমন অপমান সহ্য করে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজের পর হাতে যা পাওয়া যায়, বলার মতো নয়। এখন তার ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে এত উগ্র হয়েছে যে, সাতে-পঁাচে না-থাকা ২৯ বছরের যুবকটি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন অফ গ্রেট ব্রিটেন’-এ যোগ দিয়ে বিশ্ববিখ্যাত বার্গারের দোকানের সামনে ডেলিভারি রাইডারদের মিলিত প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। জন বলছে, এসব অ্যাপ-কোম্পানি আমাদের রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে, কোনওরকম পরিকাঠামোর ব্যবস্থা না-করেই।
৩৩ বছরের ব্লেক ভলকান ৫ বছর ধরে সাইকেল চেপে নিউ ইয়র্কে ফুড ডেলিভারি করে বেড়ায়। এক-একটা ট্রিপে তার রোজগার ৩.৯০ ডলার, যা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে কিচ্ছু নয়। বিয়ে করার পর ব্লেক এই ডেলিভারির কাজ ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু কোভিড তাকে আবার বাইসাইকেলে উঠতে বাধ্য করেছে। ব্লেক ভলকান বলছে, ডেলিভারি করতে গেলে লোকেরা এমন ব্যবহার করে যেন আমি পথের নেড়ি কুকুর, অথচ এদের বাড়িতেই কল সারানোর মিস্ত্রি হিসাবে গেলে– ওই লোকগুলোই হেসে অভ্যর্থনা করবে– ‘হ্যালো স্যর, হাউ আর ইউ?’
একই কথা বলেছে বেঙ্গালুরুর সুন্দর রাজ। সুন্দর বলেছে, কেউ-কেউ এমন ভাব দেখায়, যেন আমরা সমাজের জঞ্জাল, স্পর্শ এড়িয়ে চলতে পারলেই ভাল! তবে এই ব্যাপারটা, রুক্ষ পাথরে ঘষা লেগে ত্বক ছড়ে যাওয়ার মতোই সামান্য। আসল কথা হল আমরা কে? কর্তৃপক্ষ বলছে আমরা নাকি ‘পার্টনার’, ‘অ্যাসোসিয়েট’, ‘সহযোগী’। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, যে-প্ল্যাটফর্মে আমরা কাজ করি, সেই কর্তৃপক্ষ যখন মাসে কোটি-কোটি টাকা কামাচ্ছে, তখন আমাদের, ওদের ভাষায় ‘পার্টনার’-দের, মাসান্তে মোটরবাইকের তেলের খরচ বাদ দিয়ে ১৫ হাজার টাকা রোজগার করতে দম বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ ব্যাপারটা হল, যতই গালভরা পদ দাও না কেন, আমরা ওই ব্যবসার ‘পার্টনার’-ও নই, কোম্পানির খাতায় নাম লেখা ‘শ্রমিক’-ও নই, ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে আছি!
মুম্বইয়ের ৩১ বছরের যুবক নীতিন পেরুলকর বলেছে, সেই বদরাগী খদ্দেরটির কথা, যে তাকে ১২ তলা হেঁটে উঠতে বাধ্য করেছিল। যে-আবাসনে থাকে ওই ভদ্রমহিলা, তাতে নিয়ম হয়েছে ‘আবাসিক’ না-বললে গিগকর্মীদের লিফ্টে চড়তে দেওয়া হবে না। আমি কতবার বললাম, একবার একটু আবাসন-অফিসে বলে দিন না, প্লিজ, উনি রাজি হলেন না, কী আর করা, আমাকে হেঁটেই উঠতে হল, জানাল নীতিন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার কোম্পানিকে জানালে না কেন? উত্তর দিতে গিয়ে হাসল ছেলেটা, কোম্পানির এসব ভাবার সময় নেই!
ভাবলাম, ঠিকই তো, ১৪০ কোটির দেশে, যেখানে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মোবাইল-শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা, সেখানে এই অনাচার বাড়বেই, এই গিগ-মজুরদের জীবন অ্যাপ-ভিত্তিক পরিষেবা প্রদানকারীদের কাছে ফুচকা-আলুকাবলির মতোই তুচ্ছ!‘আমি তো মরেই যেতাম’– বলেছিল কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির বাসিন্দা পম্পা দাস। গড়িয়াহাট ফ্লাইওভার থেকে গোলপার্কের দিকে নামার সময়, পিছন থেকে একটা চারচাকা এসে মারল ধাক্কা, আমি ছিটকে রাস্তায়।
কোম্পানি সাহায্য করেনি? পম্পা ঝঁাজিয়ে উঠল, সাহায্য তো করেইনি, উল্টে বলেছে ডেলিভারি করতে যাওয়ার পথে তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি, হয়েছে ফেরার পথে, অতএব…। খড়দার বাসিন্দা সোমনাথ বর সদ্য কৈশোরের গণ্ডি পেরিয়েছে। সে-ই জানাল, খড়দার ডেলিভারি রাইডারদের আন্দোলনের খবর। কারণ, বেতন কাঠামো। ওদের এলাকায় ওই প্ল্যাটফর্মের দু’-ধরনের রেট কার্ড চালু। গত কয়েক বছরে কোম্পানি বারংবার নানা রেট কার্ড চালু করেছে, যার হিসাব বোঝা মুশকিল! কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এর ফলে নাকি ডেলিভারি রাইডারদের উপার্জন বাড়বে। কিন্তু, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বাড়েনি, বরং অনেকটাই কমেছে। ওরা সারা দিনে ১৩ ঘণ্টা কাজ করেও, তেলের দাম বাদ দিয়ে ৫০০ টাকা রোজগার করতে পারছে না। এছাড়া, প্রতি ডেলিভারিতে আছে কিলোমিটার চুরির গল্প। একটি অর্ডারে, গুগ্ল ম্যাপে দূরত্ব দেখাচ্ছে ৫.১ কিলোমিটার। অর্ডার ডেলিভারি করার পর অ্যাপের হিসাবে সেটা হয়ে যাচ্ছে ৪.২ কিলোমিটার! প্রতিটি অর্ডারে চুরি! ফলে, রাইডারদের যতটা মজুরি প্রাপ্য, তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
এছাড়াও, সোমনাথ জানাল, তাদের এলাকায় কোম্পানি যখন-তখন নতুন কর্মী নিয়োগ করছে। প্রয়োজন দিনে ১,৬০০ অর্ডার ডেলিভারি করার, কর্মী আছেন ৮০ জন। অর্থাৎ দিনে ২০টা করে অর্ডার যদি প্রত্যেকে ডেলিভারি করে, তাহলেই তো হয়ে যায়। কিন্তু না, কোম্পানির কানে এসব সহজ অঙ্ক ঢোকে না, তারা নতুন লোক নিয়েই চলেছে। ৮০ জনের জায়গায় এখন কর্মী ২০০ জন। ফল ভুগছে প্রতিটি কর্মী, প্রত্যেকের অর্ডার কমেছে।
এটা যে শুধু খড়দার গল্প, তা নয়। বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে, প্ল্যাটফর্ম কোম্পানিগুলো এই কৌশল নিয়েছে সর্বত্র। কোম্পানি বলে, ডেলিভারি রাইডাররা পার্টনার। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের সমস্যা নিয়ে, কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলোচনায় একটু অসহিষ্ণুতা দেখালেই– আইডি ব্লক। অর্থাৎ তুমি আর ঢুকতে পারবে না অ্যাপে! সোজা কথায়, কাজ থেকে ছঁাটাই। পানিশমেন্ট। এমনকী, ওই প্ল্যাটফর্মে তো নয়ই, অন্য প্ল্যাটফর্মের কোম্পানিতেও ঢোকা শক্ত। ওরা যদি শ্রমিক হত, শ্রম-আইনের আওতায় আসত, কোম্পানি পারত এমন মর্জিমাফিক কাউকে ব্লক করে দিতে? জিজ্ঞাসা করেছিল সোমনাথ।
আইডি ব্লক করা হয়েছে কুমারটুলির সমীর কুণ্ডুর। ওকে দু’-বছর আগে থেকেই চিনি। ও এখন একটা ক্লাউড কিচেনের ডেলিভারির কাজে, বেঁচে থাকার চেষ্টায়। জিজ্ঞাসা করেছিলাম– সকালে কখন কী খেয়ে কাজে যাও? উত্তর এসেছিল– সকালে রাস্তার টাইম কলে স্নান সেরে, মুদির দোকানে কাচের বয়ামে রাখা একটা লাড্ডু আর দুটো রুটি খেয়ে নিয়ে সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যেই দৌড়তে হয়! বাড়িতে ওর বিধবা মা আর দাদা। দাদা ভাড়ার গাড়ি চালাত, আপাতত বেকার; আর মা দু’-তিন বাড়িতে রান্নার কাজ করে।
এই প্রেক্ষাপটে কর্নাটকের বিলটিকে মন দিয়ে পড়লে দেখা যাবে, গিগ মজুরদের এমন সব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়েছে ওই রাজ্য, যা ২০২৩ সালে প্রণয়ন করা রাজস্থান সরকারের গিগ-আইন পারেনি। ইভজেনি মরোজোভ, মরিৎজ অলটেনরিড, জুলিয়া টোমাসেটি-র মতো বিশ্ববিখ্যাত আইনশাস্ত্র বিশারদ ও অর্থনীতিবিদ বারবার বলেছেন– প্ল্যাটফর্মভিত্তিক কাজটা আসলে অন্যান্য চাকরির মতোই, যেখানে গিগ-মজুররাও কর্মী, আর প্ল্যাটফর্ম বা অ্যাপ-কোম্পানি মোটেই ‘মধ্যস্থতাকারী’ নয়, তারা স্বয়ং নিয়োগকর্তা। চিন্তকদের এই মতামত-ই মান্যতা পেয়েছে নেদারল্যান্ডসের আদালতে উপস্থাপিত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মামলায়। আদালত স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, ‘রাইডার’ আর ‘প্ল্যাটফর্ম’-এর সম্পর্কটা ‘আধুনিক যুগের নিয়োগকর্তা আর কর্মীর সম্পর্ক’। কর্নাটক সরকারের বিল নেদারল্যান্ডসের পথেই এগিয়েছে। এতে আলাদা করে না হলেও, স্পষ্ট করে বলা আছে, গিগ-কর্মীরা তাদের বিরোধ মেটাতে দেশের ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট ১৯৪৭’-এর সুযোগ নিতে পারে। অতএব, অপ্রত্যক্ষ হলেও এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ যে, এই প্রথম বলা হল, গিগ-মজুররা ভারতীয় শ্রমবিধির সাহায্য পেতে পারে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা কর্নাটকের বিল জানাচ্ছে, যখন-তখন, যেমন-খুশি-তেমন কোনও গিগ-কর্মীকে ছঁাটাই করা যাবে না; তা করতে হবে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে, এবং দিতে হবে অন্তত চোদ্দো দিনের নোটিস। এরপরেও যে খেয়ালখুশির চাকরি খাওয়া থাকবে না, তা নয়, তবে একটা আইনের শাসন চালু হলে, কিছুটা অন্তত ভেবেচিন্তে কাজ করবে কোম্পানি।
আলোচ্য বিলে আছে গিগ-কর্মী আর প্ল্যাটফর্মের মধ্যের অস্বচ্ছ সম্পর্কের কথা। বলেছে, প্ল্যাটফর্ম কোম্পানিগুলি যে ঠিক কীভাবে কর্মীদের গতিবিধির বিচার, মূল্যায়ন করছে তা স্বচ্ছ নয়। ঠিক এই কথাগুলিই তো বলছে, বলে চলেছে, খড়দার সোমনাথরা! সম্পর্ক স্বচ্ছ হলে বিরোধও কমে। এছাড়া, গিগ-মজুরদের জন্য একটি ‘ওয়েলফেয়ার বোর্ড’ এবং ‘ওয়েলফেয়ার ফান্ড’ তৈরির প্রস্তাব করেছে এই বিল। অনুমান করা যায়, হয়তো এর নির্ভরে পীড়িত অথবা দুর্ঘটনা আক্রান্ত মজুরকে সাহায্য করা হবে। হয়তো পম্পাদের গলা আর ততটা অসহায় শোনাবে না!
দেশের একটি রাজ্যের এই বিল যুগান্তকারী হলেও কিছু কথা থাকে। আমরা কি মানসিকভাবে গিগ-কর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসাবে দেখতে তৈরি? তাহলে এদের হাতে অর্পণ করতে হবে বহু বছর ধরে লড়াই করে পাওয়া শ্রমিকদের যাবতীয় সম্মান এবং অধিকার। এবং অবশ্যই প্রণয়ন করতে হবে ভারতের শ্রম আইনের মতো এমন কিছু, যা প্রযোজ্য হবে দেশের মাটির প্রতিটি ইঞ্চিতে, সমানভাবে, সর্বত্র।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক ঔপন্যাসিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.