Advertisement
Advertisement

Breaking News

Sports Editor

অরুণদা ছিলেন সাংবাদিক তৈরির ফ্যাক্টরি, তিন মন্ত্রেই লিখেছেন জীবনের কাহিনি

অজাতশত্রু, অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, পাহাড়ের মতো বুকে আগলে রাখা মানুষটার এই সমাজে কোনও ফটোকপি পাওয়া দুষ্কর।

Former Sports Editor of Sangbad Pratidin passes away | Sangbad Pratidin
Published by: Sulaya Singha
  • Posted:November 24, 2023 5:57 pm
  • Updated:November 24, 2023 6:25 pm  

ফ্রেন্ড, ফিলোজফার, গাইডের মতোই দিতেন অফিশিয়াল পরামর্শ। কাজের গন্ডগোলে কখনও ধমক দিয়েছেন, তো পরক্ষণেই মন দিয়ে শুনেছেন সহকর্মীর সমস্যার কথা। ময়দানের হাঁড়ির খবর থেকে যে কোনও খেলার অতীত পরিসংখ্যান- সব ধন্দের সমাধানে অরুণদা। প্রয়াত ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর প্রাক্তন ক্রীড়া সম্পাদক অরুণ সেনগুপ্ত। গুরুর স্মৃতিচারণায় সোমনাথ রায়

সো হোয়াট।
ছাড় তো।
ধোর ব্যাটা।
এই ছিল অরুণদা, অরুণ সেনগুপ্তর তিন মন্ত্রগুপ্তি।

Advertisement

তখন সবে পেশায় এসেছি। অরুণদা অফিসে কম, ভবানীপুর ক্লাবে বেশি সময় দিচ্ছে। ওঁরই কাছের অনেকের মুখে অরুণদা সম্পর্কে নানা টিকাটিপ্পনি শুনছি। একদিন বললাম, লোককে কেন এত বলার সুযোগ দিচ্ছ?
– সো হোয়াট?
– মানে?
– মানে আবার কী? ছাড় তো, কারও জন্য কিছু আটকে থাকে না রে। অভি, দীপক, দুলাল, সত্যরা আছে তো। ওরা ডিপার্টমেন্ট চালিয়ে নেবে। এই টিমটাকে আই লিগ খেলাতেই হবে। টুটু’দা, টুম্পাইয়ের সঙ্গে এটা এখন আমারও স্বপ্ন।

সামনের বার ওডাফাকে রাখবে না মোহনবাগান। অফিসে এসে বললাম। কী যেন একটা ভাবল। কিছুই বলল না। হতাশ হয়ে বসে থাকলাম। একটু পরই বলল, “কী হল, কপিটা কোথায়?” জবাব দিলাম, তুমি তো কিছুই বললে না? বিরক্তির সঙ্গে বলল, “ধোর ব্যাটা, এটাও আবার বলতে হবে? খবরটা ঠিক তো?” ঘাড় নাড়তেই বলল, “লিখে ফেল। আর শোন, ভুল করেও টুম্পাইকে ফোন করবি না। পাতা ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে দেবাশিসকে ফোন করে একটা রিঅ্যাকশন নিয়ে দু’লাইন জুড়ে দিবি শুধু।” পাঁচ মিনিট বাকির অপেক্ষা করিনি। সাড়ে ন’টা বাজতেই দেবাশিসদাকে ফোন লাগালাম। ওমা। নট অ্যাভেলেবল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কোথাও ফ্লাই করছে। অরুণদাকে বলতেই বলল, “তোর কপাল খারাপ। টুম্পাইকেই কর।” কী হতে চলেছে জেনেই ফোনটা করলাম। ওপ্রান্ত থেকে চিৎকার। “খেপেছিস? এই খবর আমার কাগজে যাবে? একটা লাইনও যেন না দেখি।” সেটাই এসে বললাম।
– সো হোয়াট?
– মানে?
– মানে আবার কী? এই খবর কাগজে যাবেই। টুম্পাইকে কীভাবে ম্যানেজ করবি, তোর ব্যাপার।

জীবনে যত কথা লিখেছে লোকটা, তার মধ্যে নির্ঘাত তিন প্রধানের নাম ছিল সবথেকে বেশি। আর মুখে যে কথাগুলো বলত, তার মধ্যে এই তিনটে শব্দ সবথেকে বেশি হবেই হবে।

[আরও পড়ুন: বান্ধবীকে খুনের দায়ে জেল, দশ বছর পরে মুক্তি ‘ব্লেড রানার’ পিস্টোরিয়াসের]

কার বাড়ির কী সমস্যা। কোন সিনিয়র রিপোর্টার জুনিয়রকে কাজ করতে দিচ্ছে না। কোন জুনিয়র রিপোর্টারের ব্যবহারে খারাপ লেগেছে সিনিয়রের। কোন ক্লাব অফিশিয়াল কীভাবে সবার সামনে অপমান করলেন। ডিপার্টমেন্টে ওঁর চেয়ারের কাছে, অফিসের ছাদে বা ই-মলের সামনের চায়ের দোকানে। সবাই এসে ওই লোকটার কাছে দুঃখ-কষ্ট উগড়ে দিয়ে হালকা হত। আর অরুণ’দা নিজে ব্লটিং পেপারের মতো অন্যের দুঃখগুলো বুকে টেনে নিত। ঠিক যেন নীলকণ্ঠ। সব শুনে একগাল হেসে ওই তিনটে কথা। সঙ্গে আকর্ণ বিস্তৃত অথচ মৃদু, মুচকি ওই সিগনেচার স্টাইল হাসি। তারপর এক হাতে চায়ের ভাঁড়, অন্য হাতে ফিল্টার উইলসকে বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে নিজের, অন্যের জীবনের কিছু গল্প বলে মোটিভেট করা। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া, এই সমস্যা? সো হোয়াট? জানিস অমুকের কী হয়েছিল? ধোর ব্যাটা, ছাড় তো। এসব নিয়ে ভাবলে হবে?

সবাই ওঁকে নিজেদের কষ্টের কথা বলেছি। কেউ কখনও ওঁর কষ্ট জানতে চেয়েছি? নাকি উনি এই সবের ঊর্ধ্বে? আজ মনে হয়, সত্যিই তো, মানুষটা কীভাবে এমন ছিল?

সেপ্টেম্বরের গোড়ার কথা। কোন্নগরের বাড়িতে চা দিতে দিতে বউদি বলছিলেন, “জানো সোম, মানুষটাকে দেখে ভাবি কী ছিল, আর কী হয়ে গেল। নাতনি অন্ত প্রাণ। অথচ সোনি কীভাবে বড় হয়ে গেল তার বিন্দুবিসর্গ জানে?”

না, জানে না। সেই গল্প আমাদেরও বহু করেছে। হুগলিতেই কোনও এক ফুটবলারের বিয়ে। সপরিবার নিমন্ত্রণ। বৌদি সেজেগুজে বাড়িতে রেডি। অরুণদা তখন আজকাল পত্রিকায়। কাজ মেটাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। সেদিন একা বাড়ি যাওয়ার সাহস করতে পারেনি ময়দানে একের পর এক খবর ব্রেক করে তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্মকর্তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা মানুষটা। ‘গুরু’ সরোজদাকে বগলদাবা করে নিয়ে গেছিল বাড়ি। তাঁকে দিয়ে বৌদির মানভঞ্জন করে তারপর গিয়েছিল বিয়েবাড়ি। আসলে অরুণ সেনগুপ্ত যে আর পাঁচটা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির মতো নয়। তাঁর কাজ শুধু সংসার করা নয়। তাঁর কাজ ময়দানের অজানা গল্প দুনিয়াকে জানানো। তাঁর কাজ ময়দানের গল্প দুনিয়াকে জানানোর মতো শয়ে শয়ে সাংবাদিক তৈরি করা। তাঁর কাজ কোনও বড় ব্র্যান্ডের আড়ালে থেকে নিজের নাম তৈরি না করে নিজের জোরে তুলনায় ছোট কাগজকে ব্র্যান্ডে পরিণত করা।

সাধারণ মধ্যবিত্তের সঙ্গে এই পেশার মানুষের একটা পার্থক্য থাকে, ঠিক। তাই নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বলা উচিত, অরুণ সেনগুপ্ত আর পাঁচজন সাংবাদিকের মতোও নন। ওঁর পরিধি ইস্ত্রি করা কেতাদুরস্ত দামি জামা প্যান্টে এসি রুমে শীর্ষকর্তাদের সঙ্গেই সীমাবদ্ধ না। উনি মাঠ করতেন মাঠের ঘাসে বসে। নিজের চোখে দেখেছি তিন প্রধানের মালি এসে ওঁর হাতে লুকিয়ে খৈনি গুঁজে দিত। চোখের ইশারায় ম্যাচ শুরুর আগে পুরনো সল্টলেক স্টেডিয়ামের লিফটম্যান প্রেসবক্সের বাইরে ওঁর জন্য বিড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। বয়স, অভিজ্ঞতা বা কোন মিডিয়া – এই ধরনের কোনও বাধা ছিল না লোকটার কাছে। উনি সবার গুরু। কেউ ওঁর অর্জুন, কেউ বা একলব্য। এই গুরু আবার কোনও কাঠিন্যে বাঁধা নয়। এই গুরু যেমন বকেন, তেমনই বুকে টেনে নেন। সিগারেট চেয়ে খান। প্রেস ক্লাবে নিয়ে যান। আসলে উনি শুধুই সাংবাদিক তো নন। অরুণ’দা ছিলেন সাংবাদিক তৈরির ফ্যাক্টরি। যার প্রোডাক্ট এখন কোনও চ্যানেলের হেড, কেউ ক্রীড়া সম্পাদক, কেউ আবার ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে নতুন ডেস্টিনেশন দেওয়ার পর এক সফল ব্যবসায়ী।

সেবার প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৮০তম জন্মদিন। মন্ত্রী সুজিত বসুর উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত পিকের ছাত্র জগত। নক্ষত্রের সমাবেশ। এক সুপার স্টার ফুটবলার তথা মেগাস্টার কোচ অনুষ্ঠান মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়ে পিকের প্রতি তীর্যক কিছু কথা বলছিলেন। পরক্ষণেই আবার মাইক হাতে গুরুস্তুতিতে ভরিয়ে দিলেন। অরুণদার চলে যাওয়ার পরও সামাজিকমাধ্যম ভরে উঠেছে তাঁর স্মৃতিবন্দনায়। সেখানে কিন্তু যে বা যাঁরা লিখছেন, প্রত্যেকেই নিজেদের মনের কথাটা বলছেন। এখানে যে পাইয়ে দেওয়ার কিছু নেই। অজাতশত্রু, অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, ভবিষ্যতকে পথ দেখানো, পাহাড়ের মতো বুকে আগলে রাখা মানুষটার আজকের এই সমাজে কোনও ফটোকপি পাওয়া খুবই দুষ্কর। তাই তো নিজেদের মতো করে কেউ সারারাত কাটিয়ে দিয়েছে জিটি রোডের উপর ওই হাসপাতালের সামনে। কেউ আবার ভোর থাকতে উঠে চলে এসেছে ময়দানে। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে কোনও এক অভাগা আবার গুরুকে শেষবার দেখতে না পাওয়ার কষ্টে সারারাত বালিশ ভিজিয়েছে। বাইরে থাকা সত্ত্বেও টুম্পাইদা যখন সারাক্ষণ বাপ্পাদার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চিকিৎসা, পরবর্তীতে শেষযাত্রার ব্যবস্থা করেছেন। নীতুদা তখন মাঝরাত পেরিয়েও বন্ধুর জন্য অনেকটা সময় ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন।

আজ, যাঁরা তোমায় শেষ দেখা দেখতে পেল, প্রত্যেকে তোমার বুকে একটু ফুল-মালা রেখে গেল। আমি পারলাম না। দূর থেকে ছবিগুলো দেখলাম। মনে পড়ে গেল অমল দত্তের শেষযাত্রায় তোমার লেখা শেষ কতগুলো লাইন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ধার করে তুমি লিখেছিলে, পাথরটা সরিয়ে নাও, আমার লাগছে। নিজের শেষ ইচ্ছেগুলো, শেষ কথাগুলোই কি সাড়ে সাত বছর আগে লিখে গেছিলে অরুণ’দা? তুমি যে এই লৌকিকতায় কখনওই বিশ্বাসী নও।

[আরও পড়ুন: ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাসে রেকর্ড! কাপযুদ্ধের ফাইনালের সাক্ষী ৩০ কোটি দর্শক]

আজ থেকে ঠিক ১১ বছর আগে যে মানুষটার কাছে খবরের অ-আ-ক-খ শিখেছি, তাঁর স্মৃতিতেই যে এই লেখা লিখতে হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। অফিসের এক সহকর্মী ফোনে যখন সকালে বলল গুরুকে বিদায় জানাতে হবে, প্রথমে বলেছিলাম এ বড় কঠিন কাজ। আমার দ্বারা হবে না। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে আবার রাজিও হয়ে যাই। অরুণদাই তো শিখিয়েছে আবেগে ভেসে গেলে হবে না। চোয়াল শক্ত রেখে মাথা উঁচু করে নিজের কাজ করে যেতে হবে।

শো মাস্ট গো অন…

লেখাটা একবার পড়ে নিও অরুণদা। তোমার টেবিলে প্রিন্ট আউট দিতে পারলাম না। নিজের মতো করে এডিট করে নিও। আবার যেদিন দেখা হবে, সেদিন বকা দিয়ে বলে দিও কী কী ভুল হল।

ভাল থেকো অরুণদা।
ভাল থেকো ‘গুরু’।
ভাল থেকো কমরেড।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement