আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বারবার জেলবন্দি হতে হয়েছিল তাঁকে। জেলে বসে লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিকে এই উপলক্ষে ফিরে দেখা, ফিরে পড়া। লিখলেন অংশুমান কর
মার্কসবাদ বা গান্ধীবাদের মতোই সমাজবিদ ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা বলতে শুরু করেছেন ‘মুজিববাদ’ নিয়ে। এই তত্ত্ব-চর্চায় আড়ালে চলে যাবেন না তো সেই মুজিব, যঁার অসাধারণ জনসম্মোহিনী ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে ছিল একজন সাধারণ মানুষ, যিনি মাতৃ এবং পিতৃবৎসল, মরমি স্বামী এবং দরদি পিতা? শেখ মুজিবর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি পড়তে গিয়ে এমনটাই মনে হচ্ছিল।
রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার কারাগারে থাকতে হয়েছে শেখ মুজিবকে (Sheikh Mujibur Rahman)। এমনও হয়েছে যে, মুক্তির পর মুহূর্তেই কারাগারের মূল দরজা থেকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লম্বা কারাবাস-কালে মুজিব ডায়েরি লেখার মতো করে লিখেছেন দিনলিপি। এই রোজনামচা লেখার ক্ষেত্রে প্রেরণা ছিলেন স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, প্রিয় ‘রেণু’। মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা লিখছেন, ‘আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুরু করেন। যত বার জেলে গেছেন আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌঁছে দিতেন আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে নিজে সযত্নে রেখে দিতেন। তঁার এই দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকত তাহলে এই মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে দিতে পারতাম না।’
২০১৭-য় প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’-র (ইংরেজি অনুবাদে যায় ‘প্রিজন ডায়ারিজ’) ভূমিকা লিখেছেন বাংলাদেশের (Bangladesh) বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। সেই ভূমিকা থেকে জানা যায়, যে-নোটবইগুলিতে মুজিব রোজনামচা লিখতেন, সেই রুল-টানা খাতাগুলি উদ্ধার করা একেবারেই সহজ ছিল না। খাতাগুলি শেখ হাসিনাকে দু’বার উদ্ধার করতে হয়। একটি খাতা, এমনকী তিনি হাতে পান অনেক পরে, ২০১৪ সালে। আগে প্রাপ্ত খাতাগুলি থেকেই নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু’-র আত্মজীবনী ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়।
‘কারাগারের রোজনামচা’য় আছে ১৯৬৬-’৬৮ সাল পর্যন্ত লেখা ‘বঙ্গবন্ধু’-র কারাগারের দিনলিপি।
রোজনামচায় ‘বঙ্গবন্ধু’ লিখেছেন তঁার রাজনৈতিক বিশ্বাস আর মতাদর্শের কথা। ঘোষণা করেছেন যে, মানুষের আত্মবলিদান বৃথা যাবে না, সংকল্প নিয়েছেন যে, নিজেকে আরও সংহত করে সঁপে দেবেন সংগ্রামে। ৮ জুন, ১৯৬৬। বুধবার। তিনি লিখেছিলেন, ‘যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচ ঢালা কালো রাস্তা লাল করে, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না।… মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো।’ এই কণ্ঠস্বর আমাদের চেনা।
‘কারাগারের রোজনামচা’ কিন্তু সামনে আনে আর-এক ‘বঙ্গবন্ধু’-কেও। বন্দিজীবনে লেখা রোজনামচা পড়তে পড়তে বোঝা যায় যে, নিজের পরিবারের জন্য বারবার বিচলিত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ৮০ বছর বয়সি অসুস্থ বাবা তঁাকে দেখতে চান বলে তঁার ভাই কয়েক ঘণ্টার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু’-কে যাতে প্যারোলে ছেড়ে দেওয়া হয়– সেই আবেদন জানিয়ে সরকারকে টেলিগ্রাম করেছেন– এই তথ্য জানার পরে মুজিব লিখছেন, ‘খোদা আমাকে যথেষ্ট সহ্য শক্তি দিয়েছেন কিন্তু আমার আব্বা-মার অসুস্থতার কথা শুনলে আমি পাগল হয়ে যাই, কিছুই ভাল লাগে না। খেতেও পারি না। ঘুমোতেও পারি না।… এখন আমার ৪৭ বৎসর বয়স, আজও আব্বা ও মায়ের গলা ধরে আমি আদর করি, আর আমাকেও তঁারা আদর করেন।’ ওই সময়েই তিনি লিখছেন, ‘৬ এপ্রিল থেকে আমার বড় ছেলে কামাল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। কোনো খবর পাই নাই কেমন পরীক্ষা দিল।’
দীর্ঘদিন জেলে বন্দি থাকার সময় একবার তঁার দু’-বছরের কনিষ্ঠপুত্র রাসেল তঁাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবদার করে। এই আর্জি যে কতটা বিহ্বল করে তুলেছিল রাজনৈতিক সংকল্পে দৃঢ় এই মানুষটিকে, বোঝা যায় যখন দেখি, ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, “৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা, বালি চলো’। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো’। ও কি বুঝতে চায়!… দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা।”
সচরাচর বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অন্তর্লীন জীবন তখনই প্রকাশ্য আলোচনার বিষয় হয়, যখন সেই জীবনে লেগে থাকে একটি-দু’টি দাগ। অন্যথায় এঁরা বারবার আলোচিত হন সামাজিক-রাজনৈতিক কর্ম ও দর্শনের জন্য। ‘জাতির পিতা’ হয়ে উঠতে গেলে এরকম একজন ব্যক্তি এবং তঁার পরিবারকে কিন্তু চোকাতে হয় অপরিমেয় মূল্য। একজন প্রবল প্রতাপান্বিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও কিন্তু দিন-শেষে একজন সাধারণ মানুষ– একজন, পুত্র, একজন স্বামী কিংবা একজন পিতা। আর, একজন বড় মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অনেক সময়ই তঁার জনসত্তাটি প্রাপ্ত হন পারিবারিক ব্যক্তিসত্তাটির বিসর্জনের মাধ্যমে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়তে-পড়তে বোঝা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। তঁার জনসত্তাটি ছিল পারিবারিক ব্যক্তিসত্তার-ই সম্প্রসারণ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.