সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমা ৫০ পূর্ণ করল এই ডিসেম্বরে। আর, সেই সিনে-গল্পের নায়ক ফেলুদার প্রথম অ্যাডভেঞ্চারের প্রকাশ এ-মাসেই পা রাখল ৬০-এ। কেমন আছে জয়সলমীঢ়, তার স্মৃতি-সত্তা নিয়ে? স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বীকার করে দীর্ঘকায় মানুষটির অবদান? লিখছেন প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত।
জয়সলমীঢ় শহরের ব্যস্ত এলাকা হনুমান চৌরাহার কাছে অবস্থিত হোটেল থেকে অটোরিকশা ধরে ফোর্টের গেটের কাছে গিয়ে নামতেই একটি লোক এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়েছিল ‘গাইড’ বলে। কিন্তু ট্যুরিস্ট পরিবারের কর্তার কানে তার সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছেলেটি ফিসফিসিয়ে বলে দিল, ‘আগে দেখে নাও, আমরা এখানে যা দেখতে এসেছি, সেগুলো দেখাবে কি না’। সেই শুনে ভদ্রলোক গাইডের কাছে ‘কেল্লায় দেখার কী আছে?’ জানতে চাইলে– গাইড গড়গড়িয়ে রাজামহল-রানিমহল-দশেরা চক ইত্যাদির সঙ্গে যেই না বলেছে ‘মুকুলবাড়ি’, সমস্যার সমাধান হয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে! গাইডকে আর মক্কেল ধরতে হল না, মক্কেলই গাইডকে বগলদাবা করে নিয়ে চলল কেল্লার ভিতর! ‘মুকুলবাড়ি’-তে যে-ছবির (‘সোনার কেল্লা’, ১৯৭৪) শুটিং হয়েছিল তা মুক্তি পাওয়ার ৫০ বছর পূর্ণ হল এই ডিসেম্বরে । আর সেই সিনে-গল্পের নায়ক ফেলুদার প্রথম অ্যাডভেঞ্চারের প্রকাশ ৫৯ পূর্ণ করে ৬০-এ পা রাখল এই মাসেই।
ওই গাইড লোকটি, মুকেশকুমার বিশা, আজন্ম কেল্লার ভিতরের একটি বাড়ির বাসিন্দা। তাদের পরিবার বংশানুক্রমে যে কত বছর ওই বাড়িতে আছে, তা সে জানেও না! ‘সোনার কেল্লা’-র অন্দরমহল ঘুরিয়ে দেখানো শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটি জানিয়ে দিয়েছিল, হালে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে জয়সলমীঢ়ের এত খ্যাতি, এখানকার ত্রিকূটগড়ের এত নাম-ডাক, এখানে যে এত হোটেল-রেস্তোরঁা-দোকানপাট, তার কৃতিত্ব সত্যজিৎ রায় নামক মানুষটির প্রাপ্য। তিনি ‘সোনার কেল্লা’ না-বানালে এসব কিছুই নাকি হত না। মুকেশের ভাষায়– জয়সলমীঢ়ের মানুষের রুটির ব্যবস্থা সত্যজিৎ করে দিয়েছেন।
মুকেশকুমারের মতো লক্ষ্মীনারায়ণ ক্ষত্রীকেও ‘জয়সলমীঢ়ের ভূমিপুত্র’ বলা যায়। দু’জনের সামাজিক অবস্থানে অবশ্য পার্থক্য অনেক। একাধারে লেখক-গবেষক-সংগ্রাহক ও শহরের একটি সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠাতা শ্রীক্ষত্রী ‘জয়সলমীঢ় ফোকলোর, হিস্ট্রি অ্যান্ড আর্কিটেকচার’ বইটির লেখক। তঁারই মতো আর-একজন হলেন জয়সলমীঢ়ের সরকারি কলেজের শিক্ষক জগদীশকুমার পুরোহিত। শ্রীপুরোহিতের লেখা বইয়ের নাম ‘জয়সলমীঢ় হিস্ট্রি আর্ট অ্যান্ড কালচার’। আশ্চর্যের বিষয়– জয়সলমীঢ় প্রসঙ্গে বিস্তর তথ্য ও খবরাখবর এই বইগুলিতে লেখা থাকলেও ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমা বা সিনেমার পরিচালক সম্পর্কে একটি শব্দও বইগুলিতে লেখা হয়নি। অথচ, মরুশহরে বা কাছাকাছি এলাকায় শুটিং হওয়া দু’-একটি হিন্দি ছায়াছবির নাম উল্লিখিত হয়েছে শ্রীক্ষত্রী বা শ্রীপুরোহিতের লেখা বইতে।
আরও বেশি আশ্চর্যের বিষয়, এই বই দু’টি তো বটেই, অন্য বেশ কিছু বই বা ব্রোশিওরে জয়সলমীঢ়ের কেল্লাকে ‘সোনার কেল্লা’ যেমন বলা হয়েছে, তেমন এখানকার হলুদ পাথরের তৈরি পাত্রগুলিকেও সাধারণভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সোনার পাথরবাটি’ নামে। এই লেখকরা কিন্তু ‘সোনে কা কিলা’ বা ‘সোনে কা কটোরা’ নয়, ‘সোনার কেল্লা’ আর ‘সোনার পাথরবাটি’-ই লিখেছেন রোমান অক্ষরে! শব্দবন্ধগুলির উৎসটুকুই যা উহ্য রেখেছেন।
কিন্তু এভাবে তো আর সাধারণ মানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না। তাই মুকেশকুমারের মতো গাইড, কেল্লার ভিতরের বা বাইরের অজস্র দোকানদার, প্রাইভেট হোটেল ও রেস্তোরঁার মালিক, কর্মচারী, গাড়ি আর অটোরিকশার মালিক ও চালক– প্রত্যেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বীকার করেন দীর্ঘকায় মানুষটির অবদান।
এছাড়াও আছে ‘মুকুল স্টোন শপ’-এর মতো দোকান। কেল্লার ভিতরে যে-জনপদ, তার কেন্দ্র বলা যায় জয়সলমীঢ়ের রাওয়ালের প্রাসাদের সামনের খোলা চত্বরকে। তার নাম ‘দশেরা চক’। ওখান থেকে খুব কাছেই অবস্থান পাথর আর নানারকম স্মারকের এই দোকানটির। এই ‘মুকুল’ যে কে, তা আর বলে দিতে হয় না।
তবে দশেরা চক থেকে ‘নকল ডা. হাজরা’ মানে ‘ভবানন্দ’-কে এড়িয়ে উত্তর-পশ্চিমের যে রাস্তা দিয়ে মুকুল দৌড় মেরেছিল, সেই রাস্তায় খানিক এঁকেবেঁকে এগিয়ে যদি ‘লাইট অফ দ্য ইস্ট’ নামে যে পাথরের গয়না আর আরও অনেক মহার্ঘ ও দুর্লভ বস্তুর সংগ্রহশালা গোছের দোকানে পৌঁছনো যায়, তবে ব্যাপারটা হবে– যাকে বলে, রোমহর্ষক। দোকানের মালিক কিশোরকুমার পারেখের জন্ম ও পড়াশোনা কলকাতায়। কলেজে পড়ার সময়ে ‘সোনার কেল্লা’ ছবি দেখে অভিভূত হয়ে একাই চলে এসেছিলেন জয়সলমীঢ়। তারপর সেখানেই থেকে যান, ব্যবসা শুরু করেন। ‘দুর্লভ’, মানে ‘অ্যান্টিক’ জিনিসের প্রতি কিশোরবাবুর আকর্ষণ সত্যজিৎ রায়ের লেখার প্রভাবে কি না তা বলা যায় না।
জয়সলমীঢ়ে ‘সোনার কেল্লা’-র শুটিংয়ের সময় মুকেশকুমারের জন্ম হয়নি। তবে দশেরা চক থেকে পুবদিকে চলে যাওয়া রাস্তায় রানিমহলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে টিবেটান রেস্তোরাঁর বিপরীতে সোনার পাথরবাটির দোকানটির মালিক রসিক বাঙালি পর্যটক পেলে তঁাদেরকে শোনান তঁার বাবার শুটিং দেখার গল্প। তাছাড়া ‘গুগাবাবা’ সিনেমায় গুপ্তচর আর সৈন্যদের গুপী-বাঘাকে খুঁজে ফেরার সময় উটের যে একটি দৃশ্য ছিল, সেটি নাকি তঁাদের বাড়ির সামনে তোলা হয়েছিল বলে শুনেছিলেন। সেই বাড়ি অবশ্যই এখন আর আগের মতো নেই। কেল্লার ভিতরের দৃশ্যপট অনেকটাই বদলেছে এই ৫০ বছরে।
৫০-পেরনো ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার ঠেলায় জয়সলমীঢ়ের দুর্গের ভিতর পৌঁছে যাওয়া বাঙালি ট্যুরিস্টদের মধ্যে বাচ্চা-বুড়ো অনেকেই এখনও খুঁজে বেড়ায় ‘রতনের বাড়ি’, ‘গিরিধারীর বাড়ি’, ‘একটা মন্দির’ কিংবা সেখানে মুকুলরা হোলি খেলত– সেসব জায়গা। আর, মুকুলের নিজের বাড়ি তো কেল্লার বিশেষ দ্রষ্টব্য। সেই বাড়ির মালিক ভাঙা ইমারত না-সারিয়ে এখনও রেখে দিয়েছেন সেই ৫০ বছর আগে বাড়িটি যেমন ছিল, ঠিক তেমনই।
কতকটা যেন ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমা আর ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারের মতোই। ৫০ বা ৫০ বছর পার করেও যার আকর্ষণ এতটুকু কমেনি বহু মানুষের কাছে, যা হয়তো আরও ৫০ বা ৬০ বছর বা তারপরেও ঠিক এমনই থেকে যাবে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.