‘এল চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ… ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ’– চা-পান বিষয়ে বাঙালিকে এই উৎসাহন ও উপদেশ রবীন্দ্রনাথের। বঙ্গদেশে চা-পানের দীর্ঘ সংস্কৃতি ও সরণির সেই শুরু। ‘সব পেয়েছির দেশে’ বইতে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের অভিজাত চা-পানের অনন্য এক কলমচিত্র রেখে গিয়েছেন এবং অবাক হয়েছেন এই কথা ভেবে যে, সেই সময়কার গ্রামাঞ্চল শান্তিনিকেতনে কীভাবে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল চা-পানের সেই বিদগ্ধ আয়োজন, বিদেশি সরঞ্জাম সাজিয়ে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের টি-পটের শৌখিন ও বিপুল আকারটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, চা-পানের বৈকালিক পর্বটি নিঃসন্দেহে ছিল তাঁর প্রিয় সময়।
অধিকাংশ বাঙালির জীবনে চা জড়িয়ে আছে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতোই। অন্য কোনও পানীয়ই বাঙালির জীবনে চায়ের জায়গা নিতে পারেনি। ভারতজুড়েই চা ক্রমশ পৌঁছেছে প্রিয়তার তুঙ্গে, কিন্তু দুধ ছাড়া চায়ের ‘শ্যামলরস’-ধারা বাঙালির রসবোধ, রুচি এবং ইন্টেলেক্টকে যেভাবে বেঁধে ফেলেছে, ভারতের অন্য কোনও সম্প্রদায়কে তেমনভাবে কালো বা লাল চায়ের নেশা ধরতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
বাঙালি জীবনে সকাল-বিকেলের চা অনেকটাই ব্রিটিশ-সংস্কৃতির দান। ইউরোপে, একমাত্র ইংল্যান্ডেই চায়ের পাঠ ঘরে-ঘরে, বিশেষ করে যে-সংসারে বয়স্ক মানুষ আছেন। তবে সমগ্র বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র জাপানেই চা-পানের অনুষ্ঠান প্রায় ধর্মানুষ্ঠানের নিয়মানুবর্তিতায় পৌঁছেছে।
আকস্মিক বিশ্বজোড়া চা-সংস্কৃতি ও চা-বাণিজ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটল। রটেছে, চা খেলে বিষ খাওয়াও হচ্ছে। কীভাবে? চায়ের পাতায় পোকা ধরে। সেই পোকাকে মারতে ব্যবহার করা হচ্ছে কীটনাশক ও বিষ। যে-বিষ চায়ের পাতায় থেকে যায়, এবং তা চায়ের সঙ্গে আমাদের শরীরে ঢুকে সবথেকে ক্ষতি করছে লিভার, ফুসফুস এবং কিডনির। এই খবর রটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক চা-বাজারে ভারতীয় চায়ের চাহিদা ও কদর কমছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে কীটনাশকগুলিও।
কিন্তু গরম পড়লেই ভারতের বিস্তীর্ণ চা-বাগান জুড়ে বাড়বে রেড স্লাগ, হেলোপেলটিস এবং লুপার নামের চা-পাতার রাক্ষুসে পোকারা। ‘নিষিদ্ধ’ কীটনাশকগুলির মধ্যে এমন ৪-৫ টি কীটনাশক রয়েছে, যাদের সাহায্য ছাড়া চা-পাতার ভয়ংকর পোকাদের সঙ্গে লড়াই অসম্ভব। এই কথা ভেবেই হয়তো বিশটি কীটনাশককে নিষিদ্ধ করেও তাদের উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়নি। প্রশ্ন হল, ফুটন্ত জলে চা-পাতা বেশ কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে তারপর চা করলে কি তার মধ্যে কীটনাশকের বিষ কার্যকর থাকে? কিন্তু তাতে চায়ের স্বাদ ও সুরভি নষ্ট হয়, এতেও তো সন্দেহ নেই!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.