দিল্লিতে নিত্য বেসুরো গাওয়া অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে বশে আনতে আইন করে মনোনীত উপ-রাজ্যপালকে নির্বাচিত সরকারের সমকক্ষ করা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টাইট দিতে নারদ ও আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে হাতিয়ার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যা করতে চাইছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করারই ছক। সেই সঙ্গে কোণঠাসা হিন্দুত্ববাদকে জাগিয়ে তোলাই কি এখন বিজেপির কৌশল? লিখছেন, সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সরকারের সাত বছরের সাফল্যের গুণগান গাওয়ার সময় নতুন একটা প্রতিশ্রুতি শুনিয়েছেন। বছর শেষ হওয়ার আগেই সকলকে টিকা দেওয়া হবে। ‘অচ্ছে দিন’, বছরে ২ কোটি চাকরি, সর্বাঙ্গীণ বিকাশ বা কৃষি আয় দ্বিগুণের মতো এটাও যে ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাবে না- বুক ঠুকে বলা যাচ্ছে না। কেননা, বছরের অর্ধেক কেটে গিয়েছে, এখনও তিন শতাংশের বেশি মানুষ টিকা পাননি। ১ মে থেকে ১৮ বছর বয়সিদের টিকা পাওয়ার কথা ছিল। শুরু হতে না হতেই বন্ধ! এখন এক-এক ধরনের টিকার এক-এক রকম দাম! অথচ সরকার বলেছিল, সবাইকে বিনা পয়সায় টিকা দেওয়া হবে। যখন শুরু হয়, তখন ফ্রি টিকার পাশাপাশি একটাই দাম ছিল। আড়াইশো টাকা। সরকারেরই বেঁধে দেওয়া। এখন সরকার হাত তুলে দিয়েছে। নাগরিক জীবন ও কর্পোরেট স্বার্থের মধ্যে দ্বিতীয়টিকে বেছে নিয়েছে। টিকার দামেরও তাই কোনও ঠিকঠিকানা নেই। সাধারণ জনতা কাঁদতে হলে কাঁদুক!
অথচ, এই প্রধানমন্ত্রীই এক দেশ, এক নীতি, এক বাজার, এক কর ইত্যাদির প্রবক্তা। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছে, তাহলে ‘এক দেশ এক টিকা-নীতি’ নয় কেন? কেন কেন্দ্র-রাজ্য পৃথক নীতি? নানারকম দাম? সরকারের মুখে কুলুপ। শাসনের সাত বছর পূর্ণ হওয়ার সময়টায় প্রধান সেবক তাই কিছুটা দুর্বল। কিন্তু তাই বলে ‘কোর অ্যাজেন্ডা’ থেকে তিনি পিছিয়ে যাবেন, তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই। বরং, কিছুদিন ধরে যেসব কাণ্ডকারখানা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, যা যা তিনি করতে চান, ২০২৪-এর আগে তা করেই ছাড়বেন। কে কী মনে করল, ভাবমূর্তির হাল কী হল, তার তোয়াক্কা না করেই। বিশেষত, যতদিন না তাঁর বিকল্প কোনও জবরদস্ত মুখ বিরোধীরা খুঁজে পাচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কিঞ্চিৎ কোণঠাসা হিন্দুত্বমার্কা জাতীয়তাবাদ নতুন করে জাগিয়ে তোলাটাই হতে চলেছে বিজেপির কৌশল। নইলে পরপর গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে এইরকম সামঞ্জস্য থাকত না।
নরেন্দ্র মোদির নিরীক্ষণকারীরা এতদিনে নিশ্চয় বুঝেছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি তিনি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাশীল নন। তিনি চান এমন এক শক্তিশালী কেন্দ্র, যা দেশকে এক রাখতে পারবে। সব বিচ্ছিন্নতা বা আলগা-আলগা ভাব ধুয়ে দেশকে এক সুরে বাঁধবে। যা হবে ‘এক মন, এক প্রাণ, একতা’। তা করতে গেলে প্রয়োজন ‘এক দেশ, এক দল, এক নেতা, এক বিধান’-এর মতো এক রামধুন, যা হবে আসমুদ্রহিমাচল একীকরণের ‘থিম’।
দিল্লিতে নিত্য বেসুরো গাওয়া অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে বশে আনতে তাই দিন কয়েক আগে আইন করে মনোনীত উপ-রাজ্যপালকে নির্বাচিত সরকারের সমকক্ষ করা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) টাইট দিতে নারদ ও আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে হাতিয়ার করা হয়েছে। দিল্লির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ-কাণ্ডের মিল খুঁজে দেখুন। দেখবেন, যা তিনি করতে চাইছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করারই ছক। সর্বত্র সুগ্রীব-দোসর রাজ্যপাল।
একটু দক্ষিণে যাওয়া যাক। কেরলের কিনারে, কেন্দ্রশাসিত লাক্ষাদ্বীপে। শান্ত এই দ্বীপমালা পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার অছিলায় সেখানকার প্রশাসক প্রফুল্ল খোড়া প্যাটেল তুমুল অশান্তি বাধিয়ে তুলেছেন। এতটাই যে, কেরল বিধানসভা প্রশাসকের অপসারণে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। মুসলমান-প্রধান এই দ্বীপপুঞ্জে প্রশাসক গোমাংস নিষিদ্ধ করতে চান, দীর্ঘ ঐতিহ্য ভুলে মদ বিক্রির অনুমতি দিতে চান, অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও গুন্ডা-দমন আইন চালু করতে চান এবং দুই সন্তানের বেশি জনক-জননীদের পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ানো বন্ধ করার নিদানও দিয়েছেন। লাক্ষাদ্বীপের সঙ্গে কেরলের সম্পর্ক আদ্যিকালের। কোঝিকোড়ের বেপুর বন্দর এই দ্বীপমালার সঙ্গে সমুদ্র-যোগাযোগের নার্ভ সেন্টার। প্রশাসক তা বিজেপি-শাসিত কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরুতে নিয়ে যেতে চাইছেন। প্রফুল্ল খোড়া প্যাটেল এক সময় ছিলেন গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেরলকে জব্দ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করতে আপাতত তিনিই মোদির (Narendra Modi) হাতিয়ার।
এই মনোভাবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাজের স্টাইলকে মিলিয়ে দেখুন। সাত বছরে একবারও সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেননি। মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে ডেকেছেন কালেভদ্রে, কিন্তু কদাচিৎ কাউকে বলতে দিয়েছেন। প্রশ্ন শুনতে পছন্দ করেন না বলে মুখ্যমন্ত্রীদের বলতে না-দেওয়াটা রেওয়াজ করে তুলেছেন। এটা তিনি ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের সঙ্গে করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও করলেন। উদ্দেশ্য এক ও অকৃত্রিম। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করে একদেশদর্শী নীতি প্রতিষ্ঠা, যেখানে তাঁর কথাই হবে প্রথম ও শেষ।
শক্তিশালী কেন্দ্র গড়তে গেলে গণতান্ত্রিকতার জলাঞ্জলি দেওয়া আবশ্যক। স্বৈরতান্ত্রিকতার ইতিহাস তাই শেখায়। সেই পথে হাঁটতে গেলে শাসকের কঠোর-কঠিন মানসিকতার পরিচয় দেওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে দরকার উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটারের মতো নেট-মাধ্যমকে বাগে রাখতে সেজন্যই ডিজিটাল আইনে নতুন নিয়ম-বিধি চালু করা হয়েছে। সরাসরি হুমকি, এদেশে ব্যবসা করতে গেলে দেশের আইন মানতে হবে। শাসকের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের সরকার যেটা অন্যায় মনে করে, তোমাকেও তা অন্যায় বলে মানতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপ মামলা করেছে। হয়তো করতে হয় বলেই। কিন্তু শাসককে চটিয়ে ভারতের এত বড় বাজার হারানোর ঝুঁকি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার বা ইনস্টাগ্রাম কি নিতে চাইবে? সন্দেহ আছে।
জাতীয়তাবাদী উন্মেষ ঘটানোর চেষ্টায় সাত বছরে সরকারকে কখনও নিশ্চেষ্ট দেখা যায়নি। তা আরও একবার জাগানোর জন্য হুট করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ‘অ-মুসলমান’ শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্যোগে বাতাস দেওয়া হচ্ছে। নানা কারণে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) নিয়মবিধি চালু করা যাচ্ছে না। অথচ বছর ঘুরলেই উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে ভোট। বছর-শেষে গুজরাত-সহ আরও দুই রাজ্যে। প্রধান সেবকের কাছে বলার মতো কিংবা দেওয়ার মতো অবশিষ্ট আর কীই-বা আছে? প্রতিশ্রুতির ভাঁড়ারও যে উপুড়! অগতির গতি একটাই। হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে রাখা। মুশকিল হল, নাগরিকত্বের পুরনো নির্দেশ নতুনভাবে চালু করার উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়কে সন্দিহান করে তুলেছে। মতুয়ারা নিজেদের প্রতারিত মনে করলে তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না।
স্বস্তির কথা, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের এই বেলাগাম জিগির নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। বলেছে, দেশদ্রোহের সংজ্ঞা নতুনভাবে চিহ্নিত হওয়া দরকার। জাতীয়তাবাদী হিড়িকে ‘দেশদ্রোহ’ অথবা ‘রাজদ্রোহ’ আজকাল মুড়ি-মুড়কির চেয়েও সহজলভ্য। এতদিন পর সুপ্রিম কোর্টের চোখেও তা ধরা পড়েছে!
ভারতের শক্তির প্রমাণ হিসাবে নরেন্দ্র মোদি দুনিয়ার কাছে এতদিন যেসব বড়াই করে আসছিলেন, এই যেমন ‘আত্মনির্ভর ভারত’, কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ ও টিকা-নীতি তাঁর সেই বাড়া ভাতে ছাই ফেলেছে। ‘বিশ্ব গুরু’ তকমা পেতে উৎসাহী জননেতাকে দুনিয়া আজ কীভাবে ‘অপরাধী’ ঠাওরাচ্ছে, দাতা কীভাবে গ্রহীতা হয়ে গিয়েছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সেই উপস্থিতি জ্বলজ্বল করছে। সওয়া তিন লাখের বেশি ভারতীয়ের মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে (এখনও পর্যন্ত সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বেসরকারি হিসাব উচ্চারণের জন্য রাহুল গান্ধীকে ‘শকুন’ বলে ডাকা হচ্ছে) কোভিড-পরিস্থিতি মোকাবিলাকে ‘সার্থক’ বলার হিম্মত তবু তিনি ও তাঁর পারিষদবৃন্দ রাখতে পারছেন। সপ্তম বর্ষপূর্তির দলীয় কর্মসূচিই তার প্রমাণ। গণতন্ত্রের এ যাবৎ সংজ্ঞায়িত ধ্যানধারণাকে পাশে সরিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়ে, অর্থনীতির পাতাল-প্রবেশের পাশাপাশি দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাওয়া আরও কয়েক কোটি নাগরিকের হাহুতাশ অগ্রাহ্য করে প্রাসঙ্গিক থাকতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন মরিয়া। দেশের দৃষ্টি তাঁর টিকে থাকা অথবা ভেসে যাওয়ার দিকেই স্থির।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.