Advertisement
Advertisement
Bangladesh

সম্পাদকীয়: সোনালি অধ্যায় ও অস্বস্তির কাঁটা

‘সোনালি অধ্যায়’-এর ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে ঢাকায় যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।

Exploring the various sides of Bangladesh-India relation | Sangbad Pratidin

ফাইল চিত্র

Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:March 24, 2021 5:14 pm
  • Updated:March 24, 2021 5:15 pm  

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে অনেকগুলো জিনিস হতে চলেছে। যেমন, আজ, ২৪ মার্চ লকডাউনের প্রথম বর্ষপূর্তি। দু’দিন আগে জনতা কারফিউ ও থালা বাজানোর মধ্য দিয়ে যার আগমনি বার্তা, বছর ঘোরার মুখে সেই করোনা দ্বিগুণ তেজে ফিরেছে। দু’দিন পর ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতার এটা সুবর্ণজয়ন্তী। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেরও দেখতে-দেখতে পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। একই সঙ্গে উদ্‌যাপিত হচ্ছে বাংলাদেশের জাতির পিতা ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে ‘মুজিব বর্ষ’। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’-এর ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে শুক্রবার ঢাকায় যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ঋতিকা ফোগাটের আত্মহত্যা এবং নির্মম সত্য]

যে কোনও সম্পর্কে জোয়ার-ভাটা থাকে। টানাপোড়েনও। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা সত্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য– বিগত এক দশকে এই দুই দেশের বন্ধুত্বের প্রসার ও সম্পর্কের ব্যাপ্তি যেভাবে ঘটেছে, যেভাবে দুই দেশ একে-অন্যের কাছাকাছি এসেছে, পরিপূরক হয়ে উঠেছে, আর কোনও দেশের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। করোনা-কালের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে তাই প্রথম সেই দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশীকেই মর্যাদা দিলেন। ভারতের ‘লুক ইস্ট’ নীতি (পরবর্তীতে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’) রূপায়ণের সদর বাংলাদেশ। দুই দেশের সার্বিক সহযোগিতার ক্ষেত্র যেভাবে বিস্তার-লাভ করছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক উন্নয়ন ঘটা স্রেফ সময়ের ব্যাপার। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে পূর্ব এশিয়ার ‘আসিয়ান’ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সেতু-রচনায় ভারত আগ্রহী। সেই আগ্রহ সঞ্চারিত বাংলাদেশেও। কারণ, বাণিজ্যের প্রসার ঘটলে তার সুফল তারাও পাবে।

Advertisement

ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কজনিত বাণিজ্যিক প্রসারের ছবিটা কেমন হতে পারে, গত ৯ মার্চ বিশ্ব ব্যাংক এক রিপোর্টে তার একটা রূপরেখা প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন পরিবহণ ব্যবস্থা চালু ও জারি থাকলে ভারতের জাতীয় আয় বাড়বে ৮ শতাংশ, বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ। ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলার প্রকৃত আয় বাড়বে যথাক্রমে ৬৭ ও ৫৯ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর প্রকৃত আয় বাড়বে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ। মুক্ত বাণিজ্য ও নিরবচ্ছিন্ন যানচলাচলে দ্বিপাক্ষিক রফতানি বাড়বে ৩০০ শতাংশেরও বেশি। এককথায়, সম্ভাবনা অপার।

সুসম্পর্কের এই প্রবাহ, যা কিনা ২০০৯ সাল থেকে শুরু, সুখের কথা– ভারতে শাসক বদল সত্ত্বেও তার ধারাবাহিকতায় ছেদ তো পড়েইনি, বরং গতিবৃদ্ধি ঘটেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের দমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ অশান্ত তল্লাটকে শান্ত করেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই অঞ্চলের সন্ত্রাসী অপকর্ম ৮০ শতাংশ কমেছে। শান্তির অপর নাম সমৃদ্ধি। দুই দেশের একের পর এক পদক্ষেপ সম্পর্কের বন্ধনকে শুধু দৃঢ়-ই করেনি, বিশ্বাসের ভিতও মজবুত করছে। ৮ মার্চ উদ্বোধন হল দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম ও বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড় সীমান্তে ফেনি নদীর উপর তৈরি মৈত্রী সেতু। এই সেতুই হবে দক্ষিণ এশিয়ার ‘গেটওয়ে’। কেননা, এর দরুন ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব কমে হচ্ছে মাত্র ৮০ কিলোমিটার! আগরতলা থেকে সাব্রুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ‘সেভেন সিস্টার্স’-এ পণ্য সরবরাহের খরচ কমে যাবে অর্ধেকের বেশি। অথচ, ভাবতে অবাক লাগে, দেড় দশক আগেও বাংলাদেশে ‘ট্রানজিট’
শব্দটি ছিল প্রায় নিষিদ্ধ ও ঘৃণ্য। শেখ হাসিনার ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে ক্রমেই যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আন্তরিকতা জন্ম নেয়, তাতে সেই শব্দ ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। ‘ট্রানজিট’-এর জায়গা নিয়েছে ‘কানেকটিভিটি’ বা ‘সংযুক্তি’ শব্দটি, যা সর্বজনগ্রাহ্য। খুলনা-কলকাতা ট্রেন চালু হয়েছে। ঢাকা-গুয়াহাটি বিমান চলছে। কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হওয়ার কথা শিলিগুড়ি-ঢাকা ট্রেন। ভারতের অভ্যন্তর দিয়ে নেপাল ও ভুটানে যাওয়া-আসার আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে। ঢাকা-শিলিগুড়ি-গ্যাংটক ও ঢাকা-কাঠমাণ্ডু বাসের পরীক্ষামূলক ‘ট্রায়াল রান’ হয়ে গিয়েছে। মোংলা বন্দরের সার্বিক ব্যবহার আঞ্চলিক অর্থনীতিকে কোন পর্যায়ে তুলে দেবে– তা অনুমানসাপেক্ষ। ব্যবহৃত হচ্ছে দুই দেশের অভিন্ন নৌ-পথ। দিন যত এগবে, ততই বাড়বে নৌ-সংযুক্তি। বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের কথায়, ‘পার্টনারশিপ ৩৬০ ডিগ্রির।’ কোভিডের টিকা-কূটনীতি তারই প্রমাণ। বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে।

সম্পর্ক যে মাখনের মতো মসৃণ, তেমন ভাবাটা অবশ্য অন্যায়। সত্য এটাই, এত অগ্রগতি সত্ত্বেও কিছু কিছু বিষয় গলার কাঁটার মতো খচখচে, ঘাড়ের ব্যথার মতো অস্বস্তিকর। বাংলাদেশের কাছে সীমান্ত-হত্যা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। কিছুতেই তা শূনে্য নামানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশি পণ্যের উপর চাপানো অশুল্ক বাধাও আরেকটা অশান্তি। ভারত এমন ৫১৩টি পণ্য রফতানিতে ছাড় দিয়েছে, যার ৩৫০টি বাংলাদেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

সবচেয়ে বড় অস্বস্তি, তিস্তা। বিড়ম্বনাও। তিস্তার জলবণ্টনের দীর্ঘ প্রতীক্ষায় বাংলাদেশ হতাশ। ভারত-বিরোধিতার আগুনের ধুনোও আদতে এই অমীমাংসিত চুক্তি। তিস্তার অসাফল্যের কারণ অজানা নয়। দিন কয়েক আগে দিল্লিতে দুই দেশের জলসম্পদ মন্ত্রকের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ভারত স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ভোট না মিটলে তিস্তা-সহ অভিন্ন ছয় নদী মনু, মুহুরি, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার ও খোয়াইয়ের অববাহিকা ম্যানেজমেন্ট বা জলবণ্টন নিয়ে কোনও অগ্রগতি সম্ভব নয়।

এই স্বীকারোক্তির নেপথে্যই লুকিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতাসীন হওয়ার একান্ত আগ্রহের বিষয়টি। মোদির বাংলাদেশ সফরের অনুচ্চারিত ও প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য সেটাই। অনুচ্চারিত, কারণ, প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে ১৬ মার্চ বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে এসবের বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। সফরের দ্বিতীয় দিন, ২৭ মার্চ, তিনি যে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে শ্রদ্ধা জানাবেন (প্রথম ভারতীয় নেতা হিসাবে) তা বলা হয়নি। একই দিনে ওই জেলাতেই ওড়াকান্দিতে মতুয়া ধর্মগুরু হরিচঁাদ ঠাকুর ও তঁার পুত্র গুরুচঁাদ ঠাকুরের মন্দিরে যাবেন ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ঈশ্বরীপুর গ্রামে ৫১ পীঠের অন্যতম যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে (সতীর করকমল যেখানে পড়েছিল) প্রার্থনা জানাবেন। এক্ষেত্রেও মোদি প্রথম ভারতীয় নেতা। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী একাধিকবার এই সফরসূচির কথা জানিয়েছেন। যদিও ভারতের বিদেশ মন্ত্রক এ বিষয়ে এখনও ‘স্পিকটি নট’। হিন্দুত্ববাদী ও জাতীয়তাবাদী দলের একমেবাদ্বিতীয়ম নেতা হিসাবে এই সফর মোদির কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের ৮৩ আসনে মতুয়া সমর্থন জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক মনে করা হচ্ছে। কাকতালীয়ভাবে ২৭ তারিখ থেকেই শুরু হচ্ছে ভোট।

হেফাজতে ইসলাম, ভারত-বিরোধী শক্তি এবং মৌলবাদী কিছু সংগঠন মোদির সফরে ক্ষুব্ধ। শাসক দল ও সাধারণ মানুষ এই মহলের বিরোধিতাও করছে। কিন্তু সেদেশের ভারতপ্রেমীরাও সফরসূচির এই ধর্মীয় দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দ্বিধান্বিত নন। এনআরসি ও সিএএ নিয়ে সে দেশের বিক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মহলে প্রশ্ন উঠেছে, দ্বিপাক্ষিক সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সুবিধা করে দিতে বাংলাদেশের শাসক দল কেন এত আগ্রহী? কেন তারা ভারতের নির্বাচনে কোনও এক বিশেষ পক্ষের সাহায্যকারী হয়ে উঠছে?স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব বর্ষ উদ্‌যাপনের মুহূর্তে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়ের বিস্তারের সম্ভাবনা ছাপিয়ে ভারতের ভোট-রাজনীতি প্রাধান্য পেলে তাকে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কীই-বা বলা যেতে পারে?

[আরও পড়ুন: বাংলায় জন্মেই শিশুর মাথায় ৫০ হাজার টাকার ঋণ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement