ফাইল ছবি
কোভিডের চোখরাঙানিতে কি অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে আমাদের প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো? এখনও পর্যন্ত অনেক ধর্মীয় উৎসব কাঙ্ক্ষিত জাঁকজমক নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটতে পারে? এ বছর, অন্যান্য বছরের মতোই দুর্গাপুজো করার পক্ষে সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে, সম্ভবত, মানুষের কোনও-কিছু-না-মানা জমায়েতকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা কীভাবে সম্ভব হবে? তাই, এখনই বিকল্প দুর্গাপুজো নিয়ে ভাবনা শুরু করতে হবে। লিখেছেন স্বাগতম দাস।
উৎসব, পার্বণে মেতে ওঠার ব্যাপারে বাঙালির সহজাত স্পৃহার কথা সুবিদিত। কিন্তু আমরা কি সত্যি কখনও ভেবেছিলাম যে, গোষ্ঠী সংক্রমণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কোভিডের চোখরাঙানিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে আমাদের প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো? অতি-সম্প্রতি ভারতের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য বলে পরিচিত বেঙ্গালুরু-র ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’ থেকে প্রকাশিত করোনা-সংক্রমণের একটি ছয় মাত্রিক গাণিতিক মডেলে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, তা ভয়ংকর বিরূপ এক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। ষষ্ঠী থেকে দশমী- ঠিক কীভাবে দিনগুলি কাটতে পারে, তা বোধহয় খুব গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
এই মডেল অনুযায়ী, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি, ২২ অক্টোবর, পাঁজি অনুযায়ী, যেদিন এ বছরের পুজোর মহাষষ্ঠী। সেদিন পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমিতের সংখ্যা হতে পারে ১ লক্ষ ৭০ হাজার ১৮৪। বলা বাহুল্য, এর সিংহভাগই হবেন কলকাতার বাসিন্দা। সুতরাং, এখনও যাঁরা ভাবছেন প্রায় আগেরবারের ঢঙেই ছড়িয়েছিটিয়ে কলকাতার বিভিন্ন সাবেকি মণ্ডপে নতুন আমদানি করোনা-থিমের আঙ্গিকে পুজো হবে, শুধুমাত্র মণ্ডপ চত্বর জীবাণুমুক্ত করেই তা সম্ভব, বা একেকবারে ২০-২৫ জন দর্শনার্থীকে ঢোকালেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না- সম্ভবত আসন্ন বিপদের মাত্রা সম্বন্ধে তাঁরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন।
কলকাতার দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, মণ্ডপে মণ্ডপে ভয়ংকর ভিড়, যা গরম, বৃষ্টি, যানবাহনের অপ্রতুলতা এসব অগ্রাহ্য করে পুজোর ৪-৫ দিন খবরের বিষয় হয়ে ওঠে, পুজোর উদ্যোক্তাদের সার্থকতার মাপকাঠি হয়। এ বছর, কলকাতার বিভিন্ন আলাদা আলাদা জায়গায় মণ্ডপ তৈরি করে অন্যান্য বছরের মতোই দুর্গাপুজো করার পক্ষে সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে, সম্ভবত, মানুষের এই কোনও-কিছু-না-মানা জমায়েতকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল যদি তৈরি হয়, যতই তাতে একেকবারে ১০ জন কি ২০ জন ঢুকতে পারুক, প্যান্ডেলের চারপাশে জনপ্লাবন অনিবার্য, এবং অনিবার্য সামাজিক দূরত্ববিধির সম্পূর্ণ নস্যাৎ হওয়ার সম্ভাবনা। বিশেষত সেটি যদি ‘সুরুচি সংঘ’ কি মুদিয়ালি বা বোসপুকুরের মতো হেভিওয়েট পুজো হয়। এর ফলে সংক্রমণের লেখচিত্রটি যে আকাশ স্পর্শ করতে চাইবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই মধ্য-জুলাইতেই যদি একের পর এক করোনা-আক্রান্তের হাসপাতালে বেড না পাওয়ার কথা শোনা যায়, তাহলে দুর্গাপুজো-পরবর্তী কলকাতায় কী অবস্থা হবে, ভেবেই শঙ্কা হয়!
গত তিন মাসের লকডাউন সফল কি ব্যর্থ, তা নিয়ে বহু যুক্তি-প্রতিযুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু এই লকডাউন একটা বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমজনতা নিজেদের ভালটা বুঝে কখনওই সমস্ত সরকারি বিধিনিষেধ পালন করে না। অনেক ক্ষেত্রে জনসংখ্যার বিরাট অংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা গরিব হওয়ার ফলে ছোট জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে অভ্যস্ত, অভ্যস্ত ভিড় করে পাড়ার কলে জল তুলতে, রাস্তায় আড্ডা দিতে। দারিদ্রদোষেই এদের পক্ষে এসব বিধিনিষেধ পালন করা হয়তো অনেক সময় সম্ভব হয় না। আবার স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা করা বা উপেক্ষা করার ব্যাপারটাও সত্যি। বালিগঞ্জ, নিউ টাউন, বা বেহালার অভিজাত আবাসনে বিত্তবান মানুষ নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো থাকতে পছন্দ করে অনেক সময়। কিন্তু নিম্নবিত্ত, হতবিত্ত মানুষরা ভিড় করতে ভালবাসে, ঘিঞ্জি জায়গাতেই হাতে হাত রেখে ‘আরেকটু বেঁধে বেঁধে’ থাকতে নিশ্চিন্ত বোধ করে, যা আবার করোনা-পরিস্থিতিতে জারি হওয়া স্বাস্থ্য-অনুশাসনের পরিপন্থী।
কিন্তু এদের মনস্তত্ত্বে করোনা-সংক্রমণের সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া সম্ভবত এই ভিড় ভেঙে একা হয়ে যাওয়ার ভয়। দুর্গাপুজো গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে এই ভিড়ে নামিয়ে আনে সমাজের অনেকটা অংশকে। তাতে মিশে যায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষের ঢল। মাসের পর মাস বাড়িতে আটকে বসে থাকা মানুষ, স্কুল-বন্ধু-খেলাধুলো ভুলে ঘরবন্দি কচিকাঁচার দল, কোনও রকমে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস এঁটে সাইকেলে অফিস ঠেঙানো মানুষের দল ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠছে। পুজোর সময় যদি আগের মতোই পুজোর ব্যবস্থা থাকে, তাহলে এরা যে মরিয়া হয়ে প্যান্ডেল হপিংয়ে মেতে উঠতে চাইবে, বলা বাহুল্য! ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার উপায় তখন কী হবে?
পৃথিবীর বহু উন্নত শহরে থাকে ‘কার্নিভাল গ্রাউন্ড’ বা উৎসব প্রাঙ্গণ, এবং সেটা শহরের একটি নির্দিষ্ট চৌহদ্দির মধ্যে, যেখানে বড় জনসমাগম হলেও তা নিয়ন্ত্রণে বা নজরে রাখা সহজ হয়। আয়তনে অনেক ছোট হলেও, ‘মিলনমেলা’-র মতো এরকম প্রাঙ্গণ কলকাতাতেও রয়েছে। মিলনমেলার মতো কোনও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে একেকটি রিপ্রেজেন্টেটিভ মণ্ডপ নির্মাণ করে নির্দিষ্ট কিছু ক্লাব কি এ বছরের মতো দুর্গোৎসব পালন করতে পারে না? সেক্ষেত্রে উৎসব প্রাঙ্গণের মূল গেটে ভিড়কে সামলানো, মানুষকে স্যানিটাইজার চ্যানেলের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া- এই কাজগুলো হয়তো অনেক সহজ হতে পারে। সারা শহরে বিভিন্ন থিমের নামী-দামি প্যান্ডেল ছড়িয়েছিটিয়ে না থাকলে, শহরের রাস্তাগুলোও অনর্থক জনজোয়ারে প্লাবিত হয় না। যে উদ্যোক্তা-রা বাদ পড়লেন তাঁরা না হয় ঘটপুজো এবং দুর্গোৎসবের সংকোচনের দরুন বেরোজগার হয়ে পড়া পরিবারগুলোকে ত্রাণ দিয়েই মাতৃপুজোর রসাস্বাদন করলেন একটা বছর! এটা আমার ব্যক্তিগত মত (এর চেয়ে ভাল বিকল্প থাকলে তা-ও গ্রহণ করা যেতে পারে)।
মোট কথা, যে হারে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এবং ভ্যাকসিন বাজারে আসার যে অনুমিত সময়সীমা দেখা যাচ্ছে, তাতে পুজোর সময়টায় বাঙালি একেবারে করোনা-কবলিত থাকবে না– তা জোর গলায় বলা যাচ্ছে না। এই অন্যরকম পুজোর রূপটা ঠিক কী হবে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় বোধহয় এখনই।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.