২০২৪ সালে বহু দেশে নির্বাচন। এই প্রেক্ষিতে বেশি নজরে কাড়ছে ভোটব্যবস্থায় ‘এআই’ ব্যবহার। বিপদ ও ঝুঁকি– শাসক এবং বিরোধী উভয় দলের ক্ষেত্রেই। লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল।
‘টাইম’ ম্যাগাজিন ২০২৪-কে বলেছে, ‘চূড়ান্ত নির্বাচনী বর্ষ’ (আলটিমেট ইলেকশন ইয়ার)। শুধু ভারত তো নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভোটপর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তাইওয়ান, মেক্সিকো, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই বছর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। বহু বিশেষজ্ঞ বলছেন, ২০২৪-এর বিভিন্ন ভোটে যেভাবে ‘কৃত্রিম মেধা’-কে ব্যবহার করা হচ্ছে বা হবে, তা ভয়ংকর। কৃত্রিম মেধার জন্য নির্বাচনী ঝুঁকিও বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে।
কিন্তু ভোটে কৃত্রিম মেধার অপব্যবহার রোধ করতে আমরা কী করেছি? ইতিমধে্য নানা দেশে কৃত্রিম মেধার ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমের কাজেও কৃত্রিম মেধা ব্যবহার হচ্ছে। এআই-নির্মিত রোবট খবর পড়ছে, ভিজুয়াল ফুটেজ প্রদর্শিত হচ্ছে সিনেমার মতো। ভোট রাজনীতিতে এর সুফল ও কুফল দুই-ই আছে। পাক সেনাবাহিনী ইমরান খানকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করল, তঁার দলের ভোটে লড়ার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হল, তবু নির্দল প্রার্থী দিয়েও ইমরান প্রচুর ভোট পেলেন। অনেকের মত, সরকার যে-ই বানাক, সাধারণ মানুষের সেনা-বিরোধী অসন্তোষে ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,ইমরান এআই ব্যবহার করে দারুণ সুফল পেয়েছেন। বড় বড় পর্দায় রাস্তাঘাটে দেখা গিয়েছে ইমরান বক্তৃতা দিচ্ছেন। ইমরানের কণ্ঠস্বর, ছবি সব তৈরি হয়েছে কৃত্রিম মেধার অ্যালগরিদম্ দিয়ে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হলেও ইমরানের এআই বুদ্ধিকে ঠেকাতে পারেনি পাকসেনা।
আবার বাংলাদেশের ভোটের একটি ঘটনার কথা টাফট্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লেচার স্কুলের বিশ্ববাণিজ্য বিভাগের ডিন ভাস্কর চক্রবর্তী জানিয়েছেন। বিএনপি নেতা তারিক রহমানের একটি ভিডিও ফুটেজ ‘ভাইরাল’ হয় বাংলাদেশ। সেখানে তিনি বলছেন, গাজায় আক্রান্তদের বেশি সমর্থন না-করতে। পরে জানা যায়, এটি কৃত্রিম মেধা দিয়ে ম্যানিপুলেটেড। ভাস্করবাবু জানান, ফেসবুকের মালিক ‘মেটা’-র কাছে অভিযোগ জানানো হলেও এই ফেক ভিডিও সরাতে তারা অনেক সময় নেয়। ভাস্করবাবু আরও জানান, টেলর সুইফটের ‘ফেক পর্ন’ বানানো হয়। সেই নিয়ে পরে টেলর অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে মেটা কনটেন্ট সরিয়ে নেয়।
কাজেই কোনটা সরবে কোনটা থাকবে, তা নিয়েও রাজনীতি-অর্থনীতি আছে। চেন্নাইয়ে স্টালিন তঁার প্রয়াত পিতা করুণানিধির ভিডিও ফুটেজ তৈরি করেছেন এআই ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে। সেখানে করুণানিধির ভিডিও ফুটেজটি পুরনো, কিন্তু তিনি ২০২৪ সালের রাজনীতি ও বিজেপির অপকীর্তির কথা মানুষকে বোঝাচ্ছেন। আর, মানুষকে ভোট দিতে বলছেন নিজেকে।
তবে ভারতে এআই এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সবার শীর্ষে বিজেপি। বিজেপির আইটি সেল তো আছেই, আবার প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিমও আছে। সম্প্রতি দেখা গিয়েছে মোদি– মহম্মদ রফি ও কিশোরকুমারের গাওয়া গান শোনাচ্ছেন, কণ্ঠস্বর মোদির, মূলত দেশাত্মবোধক জনপ্রিয় গান, যা নতুন ভারত নির্মাণচিন্তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক।
কৃত্রিম মেধা ব্যবহার করে ঠিক এভাবেই হচ্ছে ডিপফেক, ডিসইনফর্মেশন, রোবোকল্স। মার্কিন মুলুকে বাইডেন প্রশাসন এ ব্যাপারে বিরাট শঙ্কা প্রকাশ করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ নিয়ে ট্রাম্পও সিদ্ধহস্ত। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দক্ষতা বৃদ্ধি ও শিল্পোদে্যাগ বিষয়ক রাষ্ট্রমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর সংসদের ভিতরে ও বাইরে এআইয়ের বিপদ নিয়ে শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে সরকার কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে। কড়া আইনও হচ্ছে। ইউরোপ তো আইনের নিয়ন্ত্রণ ভালইবাসে, সেখানেও শোরগোল চলছে। আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, কিন্তু এখন তারাও কড়া আইনের নিয়ন্ত্রণ চাইছে।
গণতন্ত্র সহজলভ্য বিষয় নয়। গণতন্ত্রর শত্রুও অনেক। কৃত্রিম মেধার সাহাযে্য ভোটের সময় যদি দেখানো হয় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এমন কিছু বলছেন, যা অনুচিত এবং তা ম্যানিপুলেটেড এবং অসত্য– তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রত্যাহার করতে করতে রাজে্য কিন্তু বড় হাঙ্গামা হয়ে যেতে পারে।
সাম্প্রদায়িক বৈষম্য কীভাবে অতীতে বাড়ানো হত তা আমরা টেলিভিশনের পর্দায় ভীষ্ম সাহানির ‘তামস’ সিরিয়ালে দেখেছিলাম। সিপাহি বিদ্রোহের সময়ও ব্রিটিশরা গুজব ছড়ায় কীভাবে তা-ও আমরা জানি। কৃত্রিম মেধায় তা আরও ফুলে-ফলে বিকশিত। অধ্যাপক মারেক কোয়াইকিউইচ সম্প্রতি তঁার বই ‘দ্য ইকোনমি অফ অ্যালগরিদম্স: এআই অ্যান্ড দ্য রাইস অফ দ্য ডিজিটাল মিনিয়নস্’-এ একটা মজার ঘটনা বলেছেন। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ’ একটা নতুন মেসেজ সিস্টেম পরীক্ষা করছিল। একটা বাক্য লেখে– ‘গুগ্ল অ্যাপেল কিনে নিল।’
এটি পরীক্ষামূলক ছিল। ব্যস। দু’-সেকেন্ডের মধে্য বার্তাটি স্টক এক্সচেঞ্জ প্রত্যাহারও করে নেয়। কিন্তু ওই বার্তার ভিত্তিতে গোটা দেশ ও দেশের বাইরেও শেয়ার বাজারে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। কী করে? কেন? জানা গেল– ওই দু’-সেকেন্ডে অ্যালগরিদম্ ওই তথ্যকে দিয়ে কোটি কোটি মানুষের বাজারে চলে যায়।
আবার বিভিন্ন সময়ের কথা বলা– রেকর্ড করে কৃত্রিম মেধা দিয়ে ওই কণ্ঠস্বরের নকল হয়ে যায়, আলাদা টেক্সট তৈরি করে তার ভিডিও ফুটেজ খুব সহজ কাজ। আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রকের উপদেষ্টারাও স্বীকার করছেন, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কৃত্রিম মেধার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। অতএব, বিনিয়োগ ও ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রেও ভয় আছে। ভয় সর্বক্ষেত্রে। সবচেয়ে বড় ভয়– সৃজনশীল সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। ‘আই অ্যাম নট আ রোবট’ শুধু এই কথা বললে হবে না, যেভাবে চলচ্চিত্রে নায়ক রোগা-মোটা, ফরসা-কালো হয়ে যাচ্ছে, বয়স কমানো-বাড়ানো হচ্ছে মেক-আপ ছাড়াই, ঠিক সেভাবেই রাজনীতিতে প্রভাব পড়তে বাধ্য।
এই বিপদ, এই ঝুঁকি শাসক দল ও বিরোধী দল দু’ক্ষেত্রেই। কিন্তু শাসক দল যখন ডিপফেক ও কৃত্রিম মেধার অপপ্রয়োগ রুখতে ব্যবস্থা নেবে, তখন এই প্রশ্ন ন্যায্যভাবেই থাকে যে, এই প্রশাসনিক ক্ষমতা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না তো? তাছাড়া বিজেপি কেন্দ্রে শাসক দল। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের গবেষণা জন্য বাজেট অনেক বেশি। পৃথিবীজুড়ে কৃত্রিম মেধার উপর কাজ করছে কতিপয় সংস্থা। বলা যায় মাত্র তিনটি সংস্থা– ‘ওপেন এআই’, ‘অ্যানথ্রপিক’ এবং ‘ইনফ্লেকশন’। এইক্ষেত্রে টাকা ঢালছেও তিনটি কোম্পানি– ‘মাইক্রোসফ্ট’, ‘গুগ্ল’ ও ‘অ্যামাজন’। বিশ্ব বাজারের জন্য এই সংস্থাগুলো পৃথিবীর নানা রাষ্ট্রে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে।
অতএব ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে যেভাবে শাসক দল কৃত্রিম মেধাকে ব্যবহার করবে সেভাবে কি বিরোধীরা পাল্টা মোকাবিলার পথে যেতে পারবে? আশার কথা, এখনও মানুষের মন সমস্ত অ্যালগরিদমের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.