১৪০ কোটির দেশে পোলস্টারদের ছত্রাক চাষ এক বৃহৎ ব্যবসা। সমীক্ষক সংস্থার ব্যবসায় মা লক্ষ্মীর কৃপা। সংবাদমাধ্যমের লাভ। কিন্তু গ্রাউন্ড জিরো-র মেঠো সাংবাদিকরা এসব বুথফেরত সমীক্ষা মানবেন কেন! লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল।
আমার সাংবাদিক জীবনের আদি গুরু বলেছিলেন, কখনও মনের মধ্যে এই অহংকার পোষণ করবে না যে, তুমি কোনও নেতা বা দলকে উপরে তুলতে পারো, বা আবার তাকে টেনে নিচে নামিয়ে দিতে পারো। মিডিয়া কখনওই তা পারে না।তাহলে মিডিয়া কী পারে? যে উঠছে– মিডিয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে আরও একটু উপরে তুলতে পারে। যে পড়ছে– তার পতনকে ধাক্কা দিয়ে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। এরপর সেই প্রবীণ সাংবাদিক আরও বলেন, মনে রাখবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে তুমি যার পতন হচ্ছে তাকে টেনে তুলতে পারো না, যে উঠছে তাকে টেনে নামাতে পারো না।
সিপিএম-বিরোধী লড়াইয়ে মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় (Mamata Banerjee) যখন ঊর্ধ্বমুখী শক্তি, তখনও তঁাকে ‘ফিনিশ’ করার জন্য কতিপয় সংবাদমাধ্যম সমালোচনা করতে ছাড়েনি। তাতে মমতাকে কি অাটকানো সম্ভব হয়েছে? হয়নি। বাম শাসনের পতনকে কেউ আটকাতে পারেনি। বেশ কিছু তথাকথিত জাতীয় ও বাংলা চ্যানেলের গত কয়েক মাসের কভারেজ, সন্ধের প্যানেল বিতর্ক এবং সর্বোপরি একজিট পোলের হিসাব দেখে, আর সবশেষে নির্বাচনের এই ফলাফল চাক্ষুষ করে মনে প্রশ্ন জাগছে– তবে কি জনমত গঠনে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ার ভূমিকাই নেই? মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাও কি সাধারণ মানুষের কাছে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গিয়েছে? ৪০ বছর সাংবাদিকতা করার পর সন্দিহান হচ্ছি এটা ভেবে যে, একজিট পোলের ভিত্তিতে তিনদিন ধরে আলোচনা চালানো কি অাদৌ উচিত কাজ? মিডিয়ার ভূমিকা নিয়েও ওঠা প্রশ্ন তাই আর অস্বাভাবিক ঠেকছে না। এটা কি ‘নিরপেক্ষ’ সাংবাদিকতা?
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনও এক বেসরকারি সংস্থার বুথফেরত সমীক্ষার ভিত্তিতে দিল্লির এক সম্পাদক আমাকে প্রস্তাব দেন– আপনি লিখুন, কেন মমতা পরাস্ত হলেন, কেন বিজেপির এত শ্রীবৃদ্ধি হল? ‘টেন ফ্যাক্টরস বিহাইন্ড দ্য সেটব্যাক’। আমি বললাম, দুঃখিত। এ-লেখা আমি লিখতে পারব না। তবে নিশ্চয়ই লিখতে পারি, কোন দশটি বিষয়ে বিজেপি মমতা-বিরোধী প্রচার গড়ে তুলতে চায়। একজিট পোল যা-ই বলুক, মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু ভোটের ফলাফল নয়। মমতারও ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’, পাল্টা প্রচার আছে। ৪ তারিখ জানা যাবে কে জিতবে আর কে হারবে। রাজে্য তৃণমূল-বিরোধী প্রতিকূল আবহ নেই তা নয়, কিন্তু সেই সব ফল্ট লাইন থাকা মানে তা ভোট ফলাফল নয়।
ভোটের (Lok Sabha Election 2024) ফলপ্রকাশের পর– আবার মনে পড়ল– সেই প্রবীণ সাংবাদিকের আপ্তবাক্য। আমরা এতটা ক্ষমতাশালী নই যে, আমাদের প্রচারের ভিত্তিতে গণদেবতার অভিমত নিয়ন্ত্রিত হবে। ২০১৪ সালের ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ২৮২টি আসন। ২০১৯ সালে ৩০৩টি। এবার সেই বিজেপি কিনা পেল ২৪০টি আসন! ৩০৩ সংখ্যা প্রাপ্তির পর বিজেপি নেতারা বলেছিলেন, মোদি সরকার হল ‘থ্রি নট থ্রি রাইফেল’। তখনই মনে হত, রাইফেলের উপমার মধে্য এক ধরনের দুর্বিনীত অহংকার আছে। এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে বলা হয় ‘ব্রুট মেজরিটি’।
২০১৪ সালে, যখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আশা করেছিল– মনমোহন সিংহ সরকারের নীতি-পঙ্গুতা দূর হবে, টুজি স্পেকট্রাম বা ‘কালা দুর্নীতি’ দূর হবে। কারণ, নরেন্দ্র মোদি নামক এক মুশকিল আসান অরণ্যদেব আবির্ভূত হচ্ছেন। শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠিত হবে হিন্দুত্বের মতাদর্শগত শক্তিতে।
সেই মোদি-মহিমা থেকে আমরা এসে পৌঁছলাম ‘মোদিত্ব’-য়। জোট সংস্কৃতির অবসানের পর এল একদলীয় শাসনের আধিপত্যকামিতা। প্রধানমন্ত্রী দশ বছরে কোনও সাংবাদিক বৈঠক করেননি। খোলামেলা প্রকাশ্য কথোপকথন অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির আইটি সেল নিয়ন্ত্রিত ‘টুইটার’-ই (পরে যার নাম হল ‘এক্স’) হয়ে উঠল সাংবাদিকদের প্রধান সংবাদ উৎস। ক্রমশ নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লক, সংসদ ভবন, এমনকী শাস্ত্রী ভবন বা অন্যান্য সরকারি দপ্তরেও সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেল। ‘প্রেস ইনফরমেশন বু্যরো’-র পরিচয়পত্র থাকলেও নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারি দফতরে কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দপ্তর থেকে আলাদা পাস নিতে হবে। সবই নাকি নিরাপত্তার জন্য জরুরি। পৃথিবীর অন্যান্য নামীদামি দেশেও নাকি এমনই হয়। গত দশ বছরে সংবাদপত্র ও চ্যানেলে উল্লেখযোগ্য ‘এক্সক্লুসিভ’ খবরের সংখ্যা অতীতের তুলনায় কমেছে। তার বদলে সংবাদমাধ্যমের পরিসর ব্যবহৃত হতে লাগল সরকারি প্রোপাগান্ডায়।
ভোটের প্রচারেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে শাসক দল বিজেপি ও মন্ত্রিসভার কুশীলব। যুক্তি ছিল, কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন। বিজেপি ‘লেভিয়াথন’, অতএব তার প্রচার তো অনিবার্য। ‘ছোটর দাবি’ থাকতে পারে, কিন্তু সংবাদমাধ্যমে তার টিআরপি নেই, বিজ্ঞাপন নেই। অতএব, চাহিদা ও জোগানের তত্ত্ব অনুসারে তারা অপ্রাসঙ্গিক। সংবাদপত্রে ঘন-ঘন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, এমনকী বিজেপি মুখপাত্রদেরও ঢাউস ঢাউস প্রবন্ধ ছাপা শুরু হল। বিরোধী দলের কিছু নেতা তঁাদের স্বরচিত প্রবন্ধ ছাপার প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন। আনুপাতিক হারের বিচারে অবশ্য তঁারা এখনও দুর্বল।
রাজনীতিকদের বিবৃতি, টুইট, প্রবন্ধ, বক্তৃতা সংবাদমাধ্যমের বড় পরিসর দখল করায় সাংবাদিকদের প্রবন্ধ ছাপার পরিসর সংকুচিত হল। সাংবাদিকের স্বাধীনতা বহু বছর ধরে সংবাদপত্র বা মাধ্যমের মালিকের স্বাধীনতায় পর্যবসিত। মালিকরাই বহু ক্ষেত্রে সম্পাদক হয়ে গেলেন। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে মালিক প্রত্যক্ষ দিনগত হস্তক্ষেপ না করলেও নীতিগত নিয়ন্ত্রণ রাখেন। সাংবাদিকরা প্রত্যেকে না হলেও অনেকে সেই সুরে সুর মেলালেন নিরাপত্তা রক্ষার তাগিদে। অভিযোগ উঠল ‘গোদি মিডিয়া’-র, কিন্তু এত সহজে কি ভারতীয় সাংবাদিকতা মহাপ্রস্থানের পথে চলে যাবে?
রজনী কোঠারি বলেছিলেন, নেহরুর সময়ের সেই ‘কংগ্রেস সিস্টেম’ থেকে এল ‘বিজেপি (BJP) সিস্টেম’। একনায়কতন্ত্র সেই একক দলের প্রাধান্যর প্রতিশব্দ হয়ে উঠল। কোনও রাজে্য ৩৫৬ ধারা জারি করার প্রয়োজন হল না। ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, তার বদলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে এল নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই শব্দ। এবার এল ভোট সমীক্ষা, তারপর বুথফেরত সমীক্ষা। বুথফেরত সমীক্ষা হল এক অ-সম্পূর্ণ বিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়েছিলাম, রাজনীতি শাস্ত্র হল আবহাওয়া বিজ্ঞানের মতো এক অ-সম্পূর্ণ বিজ্ঞান। পদার্থবিদ্যায় হাইজেনবার্গের ‘অনিশ্চয়তার তত্ত্ব’ আছে, ‘সম্ভাব্যতার তত্ত্ব’-ও নিশ্চিত নয়। তবে গণিত শাস্ত্রে ২+২=৪ অনেক বেশি নিশ্চিত। কিন্তু ভোট হল মানুষের রাজনৈতিক আচরণ। এই আচরণ সাদা-কালো সত্য। মানব-রাজনীতি মনস্তত্ব অনেক বেশি ধূসর। বুথফেরত সমীক্ষা হল এক ধরনের ‘এমপেরিক্যাল ইনভেস্টিগেশন’। কিন্তু এসব র্যান্ডম স্যাম্পল সমীক্ষায় অনেক ফ্যালাসি থাকে। শুধু দশটা লাল গোলাপ দেখে এ-সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, পৃথিবীর সব গোলাপ লাল। কারণ, একটা সাদা গোলাপ চোখে পড়লেই সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে।
১৪০ কোটি মানুষের দেশে তাই পোলস্টারদের ছত্রাক চাষ এক বৃহৎ ব্যবসা। সমীক্ষক সংস্থার ব্যবসায় মা লক্ষ্মীর কৃপা। সংবাদপত্র ও মাধ্যমের ব্যবসায়িক লাভ। কিন্তু ‘গ্রাউন্ড জিরো’-র রিপোর্টিং থেকে এসব সমীক্ষা ছিল অনেক দূরে। নিউজ রুমের মেঠো সাংবাদিকরা পোলস্টারদের বুথফেরত সমীক্ষা রিপোর্ট দেখে বলেছেন, এত আসন বিজেপি কীভাবে পেতে পারে? দক্ষিণ কলকাতা? তা-ও বিজেপি? এমনটা হয় না কি!
অতঃপর ফল প্রকাশ হওয়ার সময় দেখা গেল, খোদ অযোধ্যাতেই বিজেপি পরাস্ত! হিটলারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী বলেছিলেন, “This will always remain one of the best joke on democracy that it gave it’s deadly enemies the means by which it was destroyed.” তাই হালের এই মিডিয়া সংস্কৃতি বদলের জন্য ভোটের পর নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। ‘মিডিয়াটাইজ্ড ডেমোক্রাসি’ গড়ে তোলার শাসক-প্রচেষ্টা শুধু অর্থহীন নয়, বিপজ্জনকও।
‘পিপলি লাইভ’ ছবিতে গ্রামীণ বাস্তবতা তৈরির মিডিয়া খেলা মনে পড়ে যায়। বুঝতে হবে– সত্যি সত্যিই যদি আমরা, মিডিয়া, এত ক্ষমতাশালী হতাম, তবে তো ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন বা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধও থামিয়ে দিতে পারতাম। আর, তাই এহেন সশব্দ প্রচার, প্রধানমন্ত্রীর এত সাক্ষাৎকার, এত বিজ্ঞাপনের পর ‘চারশো পার’ অধরা মাধুরী, উলটে আবার দাও ফিরে সেই ‘জোট’-যুগ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.