‘নায়ক’-এর মুখ্য চরিত্র যতই উত্তম কুমার হোন না কেন, ‘সত্যজিতের নায়ক’ বলতে এক কথায় তিনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরিচালকের সাতাশটা ছবির মধ্যে চোদ্দোটাতেই যে তাঁর খুব প্রিয় ‘পুলু’ ! মানিকদার শতবর্ষ তাঁকে ছাড়া সম্পাদিত হওয়া মানে দুধে পড়ে থাকা এক ফোঁটা চোনা। পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার বছরখানেক আগে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর জন্য মানিকদা সম্পর্কে তাঁর লেখা দিয়েই ‘সংবাদ প্রতিদিন’ ডিজিটালের সত্যজিৎ স্মরণ।
ফেলুদা চরিত্রে যখন আমি নির্বাাচিত হই, তখন আলাদা করে ফিজিক্যালি রেডি হতে হয়নি। শরীরচর্চায় আমার বরাবরের ঝোঁক। পেশার চাপে যখন খেলাধুলো করার সময় কমে গেল, তখন বাড়িতে এক্সারসাইজ করতে হালকা বারবেল, ডাম্বল নিতাম। বাড়িতে এক্সারসাইজ সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য মনতোষ রায় আসতেন। মনতোষ রায় ছিলেন বিশ্বশ্রী। আমার জীবনে ওঁর রোল ছিল ঠিক কতটা ব্যায়াম আমার জন্য জরুরি, সেটা স্থির করে দেওয়া। উনি সাধে কি আর বিশ্বশ্রী ছিলেন! ফুটবলার, অভিনেতা, রানার, হকি প্লেয়ার, কার জন্য ঠিক কী পরিমাণ এক্সারসাইজ দরকার সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতেন।
হকি প্লেয়ার বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল বিখ্যাত অভিনেতা অসিতবরণ ভাল হকি খেলতেন। ফার্স্ট ডিভিশনেও খেলেছেন। জহর গাঙ্গুলি তো হকিতে এত দক্ষ ছিলেন যে, মোহনবাগানের হয়েও খেলেছেন। আজকের মতো পাড়ায়—পাড়ায় জিম কালচার হয়তো তখন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ফিটনেস চর্চা যথেষ্ট হত। আর বাঙালি অভিনেতারাও অনেকেই শরীরসচেতন ছিলেন। যে কোনও চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য শারীরিক প্রস্তুতি একটা দিক। আর একটা দিক তার সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতি। ফেলুদা বা ব্যোমকেশ– এগুলো তো কোনও বিদেশি গোয়েন্দা উপন্যাসের চরিত্র নয়। মেড ইন ক্যালকাটা। তাই তৈরি হওয়ার জন্য চরিত্রটাকে বোঝা খুব জরুরি। সে কোথায় থাকে? কী ভাবে থাকে? তার রুচি কী? তার কথা বলার ধরন কী? আদ্যোপান্ত জানতে হবে।
ভাল অভিনেতা হতে গেলে মানুষের সঙ্গে মেশাটা ভীষণ ভীষণ জরুরি। মানুষকে জানতে হবে। তার জীবনকে জানতে হবে। প্রকৃত ভাল অভিনেতা হল সে—ই যে নিরন্তর পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। দিনের শেষে ভাই তুমি তো পর্দায় জন্তু জানোয়ারের অভিনয় করছ না। মানুষের অভিনয় করছ। তা হলে মানুষকে দেখো। তাকে জানো। আমি ‘অভিযান’—এ যে নরসিংহ চরিত্রটা করেছিলাম, মফস্বলের প্রাইভেট ট্যাক্সির ড্রাইভারের চরিত্র, তার এত সমাদর লাভ সম্ভব হয়েছিল, সেই জীবনকে কাছ থেকে দেখার সুবাদে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। হাওড়া ময়দানে সুনীলদা বলে এক দাদার সঙ্গে ট্যাক্সি ও বাস ড্রাইভারদের আড্ডায় ভিড়ে গিয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে তাদের গাড়িতেও ঘুরতাম। তাদের সঙ্গে এতটা সময় কাটিয়েছি যে, ওদের অভিব্যক্তিগুলো আমার ভীষণ রকম পরিচিত ছিল। অভিনয়টা সে জন্যই মানুষের এত বিশ্বাস্য লেগেছিল।
আমি সাহিত্যের ছাত্র। সাহিত্য মনপ্রাণ দিয়ে পড়লেও মানুষের মনের এক—একটা ছোট অলিন্দ জানা হয়ে যায়। যদি রেকর্ড ঘাঁটা যায়, সত্যজিৎ রায়ের করা সাতাশ ছবির মধ্যে চোদ্দোটার নায়ক আমি। কত বছর জুড়ে সেই কাজ চলেছে। ‘অপুর সংসার’ থেকে ‘শাখাপ্রশাখা’। একটা লম্বা সময়। অথচ কেমন যেন মনে হয় আমি একটাই কাজ করেছি টানা লম্বা সময় ধরে। মানিকদার সঙ্গে আসলে কাজ করার এমন মজা আর উন্মাদনা ছিল, জীবনকে দেখানোর যেন একটা দায় এসে যেত। আমার অভিনয়ে একটাই লক্ষ্য ছিল। তা হল, ওই মানুষটির শিল্পী—মন আর রুচির থেকে শেখা। মানুষটা সর্ব অর্থেই আন্তর্জাতিক ছিলেন। যে স্কেলে জীবনকে উনি ভাবতেন, সেটা একেবারে আলাদা। উনি শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকা শিখেছেন। ভারতবর্ষের দ্রষ্টব্য সব মন্দির বা অজন্তা—ইলোরায় গিয়ে আর্ট এক্সারশন করেছেন। তার ধ্যানধারণা আলাদা। এই যার ব্যাকগ্রাউন্ড, তার তো মানসিকতাই আলাদা।
ভাল শট দেওয়ার পর অনেক ডিরেক্টরকে দেখেছি উদ্বাহু হয়ে জড়িয়ে ধরতে বা প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়তে। সত্যজিৎ রায় এসব আমড়াগাছি পছন্দ করতেন না। উনি অনর্থক আবেগ দেখানোয় বিশ্বাসী ছিলেন না। অভিব্যক্তি প্রকাশে বরঞ্চ ব্রিটিশদের মতো আন্ডার স্টেটমেন্টে বিশ্বাসী। শট ভাল লাগলে জাস্ট ছোট করে বলতেন, বাঃ! অথবা এক্সেলেন্ট। এর বেশি কিছু না। যারা ওঁকে চিনত বা বুঝত তাদের জন্য এই ছোট কথাটাই যথেষ্ট ছিল। স্টুডিও ফ্লোর বা আউটডোর– যেখানেই কাজ হোক, মানিকদা অভিনেতাদের দারুন বুঝতেন। এক একজন হয়তো এক এক রকম মেজাজের। তাঁদের কী ভাবে ট্রিট করতে হবে, কীভাবে সেরাটা বার করে আনতে হবে, ঠিক জানতেন। ম্যান ম্যানেজমেন্টে এমন দক্ষতা ছিল যে খুব টেনশন—ফেনশন হত না। সবাই যার যার সেরাটা ক্যামেরার সামনে বার করে আনতে পারত। কামু মুখার্জিকে একমাত্র দেখেছি স্নেহের ধমক দিতে, “অ্যা—ই কামু। এতটা করতে হবে না। একটু কম রাখো।” কামু ছিল ‘সোনার কেল্লা’—র মন্দার বোস। মানিকদা ওকে কিন্তু দারুণ ভালবাসতেন। ছোটদেরও ম্যানেজ করতেন অদ্ভুত দক্ষতায়। এই যে তোপসে। তার সঙ্গে এমন ভাবে মিশতেন যেন সে প্রাপ্তবয়স্ক। টিনএজার নয়।
মানিকদার মধ্যে আরও একটা বড় গুণ লক্ষ করতাম। কখনও ধৈর্য হারাতেন না। ‘সোনার কেল্লা’—র শ্যুটিঁং শেষে একদিন সন্ধ্যেবেলা খুব ক্লান্ত হয়ে আমরা হোটেলে ফিরছি। রাস্তায় মুকুল মানে আমাদের কুশল নানা প্রশ্ন শুরু করল। ছোটবেলা থেকেই ওর মধ্যে একটা কৌতূহলোদ্দীপক মন ছিল। আমরা সাধ্যমতো ওর কৌতূহল মেটাতামও। কিন্তু সে দিন ওই ক্লান্তির মধ্যে ওর প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে আর শরীর চাইছিল না। তাই চুপ করে ছিলাম। মানিকদার নিশ্চয়ই শরীর আরও বিদ্রোহ করছিল। ধকল তো ওঁর ওপর দিয়ে সবচেয়ে বেশি গিয়েছে। অথচ উনি অক্লান্ত ভাবে সব প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন। শুধু হুঁ—হাঁ করে এড়িয়ে যাওয়া জবাব নয়। মুকুলকে বিস্তারিত বলে গেলেন, তারাদের রং কেন নীল, কেন দিনের বেলা তাদের দেখা যায় না এর নিবিড় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আজও সেই অভিজ্ঞতা ভুলিনি। যতবার ভাবি মনে হয় জিনিয়াসদের কষ্ট ধারণ ক্ষমতাও বোধহয় আর পাঁচজনের ওপরে।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন ফেলুদা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কোনও বিশেষ টেকনিক্যাল প্রস্তুতি আমি নিয়েছিলাম কি না? উত্তরটা কাউকে কাউকে অবাক করে কিন্তু সহজ উত্তর হল, না। গোয়েন্দা চরিত্র জীবন থেকেই উঠে আসা চরিত্র। জীবনের বাইরের আধিদৈবিক কিছু নয়। কলকাতা পুলিশের এক উচ্চপদস্থ অফিসার সম্প্রতি গোয়েন্দাগিরির ওপর একটা বই লিখেছেন– ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’। সেই বইটা পড়লে আরও বোঝা যায় সাধারণ জীবনধারা থেকেই উঠে আসে গোয়েন্দা আর তার পেশাগত দৌড়ঝাঁপ। মানুষ ফিল্মের গোয়েন্দাকে অতিমানব হিসেবে দেখতে পারে। সেটা তার দেখার প্রিজম। থাক না। অভিনেতার তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সে তার মতো করে বাস্তবসম্মত প্রস্তুতি নেবে গোয়েন্দাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। ফেলুদা চরিত্র আমি দুটো ফিল্মে করেছি। ‘সোনার কেল্লা’ আর ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। প্রথম ফিল্মটা ঘিরে অনেক স্মৃতি। অনেক মুহূর্ত জড়িয়ে রয়েছে। আজ তো জয়সলমেঢ়ের সেই দুর্গ সোনার কেল্লা নামে গোটা ভারতের পর্যটকের কাছে দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে। তার পর উটের পিঠে চড়ে সেই শ্যুটিং।
ফেলুদার ছবিতে স্মরণীয় মুহূর্ত বাছতে বললে, অবশ্য আমি এখুনি যে দুটো দৃশ্যের কথা বলব, তার দুটোই ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’—এর। এক মগনলাল মেঘরাজের ডেরায় জটায়ুর লাঞ্ছনার পর আমি গিয়ে বলছি লালমোহনবাবুকে, হয় আমি তার শোধ তুলব, নইলে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব। এই মুহূর্তটা অসম্ভব মানবিক। দুই, যেখানে বিপ্লব চ্যাটার্জির পিছনে রিভলবার ঠেকিয়ে যন্তর মন্তরের ছাদে নিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে আজও মনে রাখার মতো সিকোয়েন্স। আর উৎপল দত্তর সঙ্গে কাজ করাটা বরাবর খুব সুখস্মৃতি। যখন শ্যুটিং চলছে, তখনই মনে হয়েছিল মগনলালের ভূমিকায় উনি যা অভিনয় করেছেন তা লোকের মন কাড়বে। ছোরা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মগনলালের সহকারীর জটায়ুকে ভয় দেখানোটাই শ্যুট করা হয়েছিল কলকাতার স্টুডিওয়। কাশীতে নয়। তবে লাস্ট সিন সেই ঘাটের পাশে দৃশ্যটার অনেকটাই বারাণসী গিয়েই
তোলা।
ফিল্মে তো মনে রাখার মতো অনেক চরিত্র করেছেনই, আমি ওঁর সম্পর্কে আরও বেশি আপ্লুত উৎপলদার মঞ্চের কাজ নিয়ে। ভাবীকাল হয়তো তাঁকে থিয়েটারের প্রয়োগকর্তা বা মেকার হিসাবে বেশি মনে রাখবে। এই বিভাগে অসামান্য কাজ করে গিয়েছেন উৎপল দত্ত। সর্বকালীন বিচারে আমি আগে মঞ্চের উৎপল দত্তকে দেখছি। ব্যক্তিগতভাবে আমিও অনেকের মতোই প্রচুর বিদেশি গোয়েন্দা কাহিনি পড়েছি। শার্লক হোমস পড়তে অন্য অনেকের মতো আমারও ভাল লাগে। খুব সুন্দর করে লেখা। গল্প বোনা এবং রহস্যের ঘেরাটোপটা খুব আকর্ষণীয়। কিন্তু আমার নিজের প্রিয় গোয়েন্দা গল্প লেখক জর্জ সিমেনন। বেলজিয়ামের এই গোয়েন্দা গল্প লেখক আমার কাছে অতুলনীয়। উইলিয়াম ফকনারের মতো মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছিলেন, আমার সিমেননকে ভাল লাগে কারণ ওর লেখাগুলো আমাকে চেকভের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এর চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.