বিশ্বের কাছে মার্কিন সংস্থা ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির (Gautam Adani) সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল রহস্য ফাঁস করে দিয়েছে। এই উদ্ঘাটনের অভিঘাত এতটাই তীব্র যে, শেয়ার বাজারের ক্রমাগত ধস আদানিকে পৃথিবীর তৃতীয় ধনবানের আসন থেকে অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। সরকার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সম্প্রতি তোলপাড় ফেলা ইস্যু নিয়ে লিখলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্য়োপাধ্যায়।
আমি নিশ্চিত, আমার বহু পুরনো সাংবাদিক বন্ধু পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা এখন যথেষ্ট উৎফুল্ল। ছ’-সাত বছর আগে তিনি যেদিকে আলোকপাত করেছিলেন, সাংবাদিকতার ধর্ম মেনে যেসব তথ্য প্রকাশ্যে টেনে এনেছিলেন, মার্কিন সংস্থা ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ (Hindenburg Research) আজ তা আলোকিত করে তুলেছে। বিশ্বের কাছে তারা ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল রহস্য চিচিং ফাঁক করে দিয়েছে।
এই উদ্ঘাটনের (সত্যি-মিথ্যের বিচার এখনও অবশ্য অনেক দূর) অভিঘাত এত তীব্র যে, শেয়ার বাজারের ক্রমাগত ধস গৌতম আদানিকে পৃথিবীর তৃতীয় ধনবানের আসন থেকে অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। আপাতত ক্ষতি প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা! কিংকর্তব্যবিমূঢ় সরকার-সংসদ মোকাবিলার সাহস অর্জনে ব্যর্থ।
প্রধানমন্ত্রী (PM Narenda Modi) স্বাভাবিক কারণেই নির্বাক। ১০-১২ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে যে-নামটি উচ্চারিত, যাঁর ব্যবসায়িক উত্থানের প্রধান কারণ প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য, সপ্তাহকাল কেটে গেলেও সেই গুজরাটি শিল্পপতি গৌতম আদানির সপক্ষে একটি শব্দও মোদি উচ্চারণ করতে পারেননি। সংকটমোচন কীভাবে হবে কিংবা কতটা, এখনও অজানা।
পরঞ্জয় একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, কীভাবে ‘ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স’ গৌতম আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক দশক ধরে হীরে ও সোনা ব্যবসায় এক হাজার কোটি টাকার কর ছাড়ের তদন্ত করেই চলেছে। পরের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালের জুনে। তাতে লেখা হয়, মোদি সরকার ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ সম্পর্কিত নিয়মবিধি এমনভাবে বদলেছে, যাতে আদানি গোষ্ঠীর ৫০০ কোটি টাকা লাভ হওয়ার পাশাপাশি বেড়ে গিয়েছে ব্যবসার ব্যাপ্তি।
পরঞ্জয় তখন ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-র (ইপিডব্লিউ) সম্পাদক। আদানি গোষ্ঠী তাদের আইনি চিঠি পাঠিয়ে নিবন্ধ প্রত্যাহারের দাবি জানায়, কারণ তা ছিল ‘মানহানিকর’। ইপিডব্লিউ তা প্রত্যাহার করে। পরঞ্জয়ও পদত্যাগ করেন। আজ, এত বছর পর, হিন্ডেনবার্গ যেসব অভিযোগ তুলে ধরেছে এবং আদানি গোষ্ঠীর প্রতিবাদ ও হুমকি সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র না টলে মামলা করার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছে, অভিযোগ থেকে একচুলও তারা সরছে না, তাতে এই জল শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়াবে, কেউ জানে না।
হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে বেশ কিছু সংস্থার নাম রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ রিপোর্টে পরঞ্জয় ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনও সাংবাদিকের নাম তারা উল্লেখ করেনি। বন্ধুবর পরঞ্জয়ের কাছে এটা নিশ্চয়ই শ্লাঘার বিষয়। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ বুঝিয়ে দিল গুজরাট, রাজস্থান ও দিল্লির আদালতে যাঁর বিরুদ্ধে আদানি গোষ্ঠী ছ’টি মামলা ঝুলিয়ে রেখেছে, যাদের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত তাঁকে আড়াই বছর ধরে বাক্রুদ্ধ করে রেখেছে, সেই বঙ্গসন্তান সাংবাদিকের অভিযোগ অহেতুক, অসত্য ও অযৌক্তিক ছিল না।
শেয়ার বাজারে ‘ম্যানিপুলেশন’ বা কারচুপি-জালিয়াতির অভিযোগের জেরে আদানি সাম্রাজ্য হারিয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা। এই ধাক্কা সামলাতে তারা কী কী করতে পারে, সেই অনুমানে না গিয়ে বলা যায়, আইনের মতো ধনকুবেরদের হাতও বিরাট লম্বা হয়। অন্তত এ-দেশের মানুষ তা বিশ্বাস করে। আদানিদের হাতও দিকচক্রবালরেখা ছোঁয়ার মতোই দিগন্তবিস্তৃত। না হলে অস্ট্রেলিয়ার শক্তি বিশেষজ্ঞ টিম বার্কলেজ বছর কয়েক আগে গৌতম আদানিকে ‘প্রধানমন্ত্রী মোদির রকফেলার’ বলে অভিহিত করত না। যে-শিল্পপতির মোট সম্পদ গত পাঁচ বছরে ১৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, চার বছরে যাঁর বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারের দাম বেড়েছে ৮৫০ শতাংশ, যিনি দেশের ২২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বাণিজ্য বিস্তার করে ফেলেছেন, এই সংকট থেকে বাঁচতে তিনি যে কিছু না-কিছু করবেন, তা সহজেই অনুমেয়।
একইরকম সক্রিয় হতে হবে প্রধানমন্ত্রীকেও। ভারতকে (India) বিশ্বের দরবারে ‘শোকেস’ করতে যাঁর উপর তিনি সব বাজি ধরে রেখেছেন, তাঁকে তরাতে জান কবুল তো করতেই হবে। দু’জনই আপাতত উপযুক্ত সময়ের প্রতীক্ষায়।
মহাজ্ঞানী মহাজনরা যে-পথে গমন করেছেন, সেই পথে হেঁটেই বাঁচতে চেয়েছিলেন আদানি। বুদ্ধিটা তাঁর একান্ত নিজস্ব ছিল কি না, কে জানে! ভেবেছিলেন হয়তো গুরু-প্রদর্শিত পথে হাঁটলে বৈতরণি পেরনো সহজতর হবে। তাই নরেন্দ্র মোদির মতো জাতীয়তাবাদের নামাবলি তিনিও গায়ে জড়িয়ে নেন। হিন্ডেনবার্গের অভিযোগের ধার-কাছ দিয়েও না হেঁটে দীর্ঘ জবাবে পাল্টা অভিযোগ করে আদানি বলেছিলেন, এই আক্রমণ কোনও ব্যক্তি শিল্পপতির বিরুদ্ধে নয়। সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে ভারত, ভারতের অখণ্ডতা, তার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতা, দেশের উন্নয়ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে। তাতে অবশ্য চিঁড়ে ভেজেনি। হিন্ডেনবার্গ কুঁকড়ে যায়নি। বরং আদানিদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত।
জাতীয়তাবাদের নামাবলি চড়িয়ে মোদির সংকটমুক্ত হওয়ার শুরু পুলওয়ামা কাণ্ড থেকে। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় সিআরপিএফ-এর ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু হয়। ১২ দিনের মাথায় জবাব দেয় ভারতীয় বায়ুসেনা। নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ১২টি ‘মিরাজ ২০০০’ পাকিস্তানের বালাকোটে হামলা চালায়। ভোট প্রচারে সেটিই হয়ে ওঠে মোদির হাতিয়ার। যাঁরা প্রমাণ পেতে উন্মুখ ছিলেন, জাতীয়তাবাদের ত্রিশূলে তাঁদেরও তিনি বিদ্ধ
করেন। একদিকে জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া, অন্যদিকে পাকিস্তানকে ‘ঢিট’ করার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে মোদি লোকসভায় ৩০৩ আসন বাগিয়ে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেলেন। তারপর থেকে একবারের জন্যও তিনি ওই জাতীয়তাবাদী নামাবলি গা থেকে সরাননি। প্রয়োজন হলেই গায়ে জড়িয়েছেন।
ওটাই হয়ে ওঠে তাঁর বর্ম। ‘রাফাল বিতর্ক’ (Rafale) স্মরণ করলেও নামাবলি মাহাত্ম্য বোঝা যাবে। সুপ্রিম কোর্টকে সরকার সরাসরি বলে দিল, জাতীয় স্বার্থে কোনওভাবেই তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে কেনা ওই যুদ্ধবিমানের দাম ও তাতে ব্যবহৃত মিসাইলের চরিত্র উদ্ঘাটন করতে পারবে না। দেশের স্বার্থে ও নিরাপত্তার খাতিরে এই গোপনীয়তা আবশ্যিক। স্মরণ করুন, জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে তথ্য পেশে অরাজি হয়ে দুর্নীতির যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে মোদি সরকার কীভাবে সুপ্রিম কোর্টের অনুকূল অভিমত আদায় করে নিয়েছিল। রাফাল মামলা সেইদিক থেকে অনন্য।
‘পেগাসাস বিতর্ক’-ও (Pegasus Controversy) তেমন আরও এক নমুনা। সেখানেও কারচুপির অভিযোগ এড়াতে জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করেছিল মোদি সরকার। ইজরায়েলি স্পাইওয়্যার দিয়ে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারপতি, গণ আন্দোলন কর্মী কিংবা নাগরিক সমাজের বিশিষ্টদের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ সরকার নস্যাৎ করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা না-করার কারণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল জাতীয় স্বার্থকে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সরকার বলেছিল, শত্রুপক্ষ ও সন্ত্রাসীদের সুবিধা হয়, এমন কোনও কাজ তারা করতে পারবে না। সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সবার আগে।
এই হালে বিবিসি’র (BBC) তথ্যচিত্রর ধাক্কা সামলাতেও মোদি সরকার গায়ে জড়ায় জাতীয়তাবাদের পরিচিত নামাবলি। তথ্যচিত্রটি নিষিদ্ধ করার পিছনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে তুলে ধরে সরকার বলে, ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়ন রোধে ওই তথ্যচিত্র পশ্চিমি ষড়যন্ত্র। তথ্যচিত্রটি অসত্য, অপপ্রচার ও দুরভিসন্ধিমূলক। এবং তাতে রয়েছে ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন। বিজেপি প্রচার করছে, জি২০ সম্মেলনের প্রাক্কালে ইচ্ছাকৃতভাবে মোদির ভাবমূর্তি নষ্টের অপচেষ্টা চলছে।
গৌতম আদানিও সেই জাতীয়তাবাদকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের পাল্টা জবাব তাঁকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। তাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে আদানিরা মামলার রাস্তায় হাঁটবেন কি না জানা নেই। আপাতত অপেক্ষা অদূর ভবিষ্যতের। উৎফুল্ল বঙ্গজ সাংবাদিক কিন্তু হাসছেন। আজ তাঁর হাসার-ই দিন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.