‘সব ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণযোগ্য নয়’– প্রাক্তন সিজেআই ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড়ের এই রায় ‘ঐতিহাসিক’। ছয়-সাতের দশকের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা যে এখনকার ভারতে অচল, সে ইঙ্গিতও স্পষ্ট। সিঙ্গুর আন্দোলনেও বামপন্থীরা গোষ্ঠীর স্বার্থে সম্পত্তি গ্রহণের তাৎপর্য ধরতে পারেননি। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড় কতটা সফল হলেন, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। তিনি যত দিন পদে থাকলেন, তত দিন সময় সাম্প্রতিক কালের অধিকাংশ প্রধান বিচারপতি-ই পাননি। ফলে তাঁর আমলে বেশ কিছু ‘ঐতিহাসিক’ রায় হবে বলে অনেকের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে তেমন কোনও হইচই ফেলা রায় গত দু’বছরে দেখা যায়নি। তাঁর শেষবেলায় এসে আর্থিক তছরুপ তথা ‘পিএমএলএ’ মামলায় জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা প্রদর্শন করতে দেখা গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। দিল্লি আবগারি দুর্নীতি মামলায় বিচারাধীন সব বন্দি মুক্তি পেয়েছে।
‘পিএমএলএ’ মামলায় দু’-বছর পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্তদের জামিন হয় না। কিন্তু দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ শিসোদিয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে বলতে শোনা গেল, জামিন পাওয়াটাই নিয়ম। জেলে বন্দি রাখাটাই ব্যতিক্রম। তবে ‘ইউএপিএ’ বা ‘পিএমএলএ’ মামলায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দিনের-পর-দিন বিনা বিচারে বন্দি করে রাখার যে অভিযোগ রয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে তার কোনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের আমলে। আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলা ঝুলে থেকেছে তাঁর সময়কালে।
আর. জি. কর মামলা তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করার পরে একটা প্রত্যাশা ছড়িয়েছিল চারিদিকে। এই মামলায় প্রধান বিচারপতি হিসাবে চন্দ্রচূড় এমন কোনও মন্তব্য করে যাননি, যা আগামিদিনে বারবার উদ্ধৃত হবে। একমাত্র একেবারে অবসরের ৭২ ঘণ্টা আগে, সদ্যপ্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় ৯ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের মাথায় বসে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে যে-রায় দিয়ে গেলেন, তা আগামী দিনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে রায়ের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বেঞ্চের অন্য দুই সহ-বিচারপতির যে-ধরনের আক্রমণের মুখে পড়েছেন, তা-ও সুপ্রিম কোর্টে একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
সংবিধানের ৩৯বি অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে কোনও সম্পত্তি গোষ্ঠী উন্নয়নের জন্য জনস্বার্থে সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে। এটি সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতি। এই নির্দেশমূলক নীতিকে অাইনি সুরক্ষা দেয় সংবিধানের ৩১সি ধারা। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন ৯ জন বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে, গোষ্ঠী উন্নয়নের জন্য জনস্বার্থে সব ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে না। কারণ, ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা সব সম্পত্তিকে গোষ্ঠীর সম্পত্তি হিসাবে দেখা যায় না। কোন কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে গোষ্ঠীর সম্পত্তি হিসাবে দেখা যাবে, তার একটি মাপকাঠি রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি। কী ধরনের সম্পত্তি, তার বৈশিষ্ট্য কী, গোষ্ঠীর উন্নয়নে সেই সম্পত্তির প্রভাব কতটা, ওই ধরনের সম্পত্তির অভাব রয়েছে কি না ইত্যাদি অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিটি অধিগ্রণযোগ্য কি না।
জনস্বার্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ নিয়ে চূড়ান্ত বিতর্ক আমরা এ-রাজ্য প্রত্যক্ষ করেছি। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে এই বিতর্ক ঘটেছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর বাম সরকার শিল্প তৈরির জন্য ব্যক্তিমালিকানায় থাকা কৃষিজমি অধিগ্রহণ করতে গিয়েছিল। তাতে জনস্বার্থের কথা বলা হয়েছিল। শিল্পায়নের মাধ্যমে গোষ্ঠী উন্নয়নের জন্য কৃষকের তথা গ্রামবাসীর সম্পত্তি অধিগ্রহণ প্রয়োজন বলে জানিয়েছিল বাম সরকার। কৃষিজমি রক্ষার জন্য সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে ঐতিহাসিক আন্দোলন দেখেছিল। রাজ্যের তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আন্দোলনকে একটি বিশাল রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিতে সফল হয়েছিলেন।
সেই আন্দোলনের জেরে যে-রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটেছিল, তা নিয়ে কোনও স্তরে কোনও বিতর্ক নেই। শিল্পের জন্য কৃষি জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আড়ালে কিন্তু গোষ্ঠী উন্নয়নের নামে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণের নীতির বিরোধিতার বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক ছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে গোষ্ঠী সম্পত্তি হিসাবে দেখার বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সে-সময় সমস্যাটি দেখার চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা। যার ফলে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের মাত্রাটিকে সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারেননি। সে-কারণে ওই জমি অান্দোলনই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের পতন ত্বরান্বিত করেছিল।
সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ নিয়ে রায়েও এই বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির বিতর্কটি সামনে এসেছে। ১৯৭৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের সাত সদসে্যর বিচারপতির বেঞ্চের সদস্য হিসাবে বিচারপতি কৃষ্ণ অাইয়ার তঁার সংখ্যালঘু রায়ে জানিয়েছিলেন, সংবিধানের ৩৯বি অনুচ্ছেদের অাওতায় সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তিই গোষ্ঠী সম্পত্তির মধে্য পড়ে। অর্থাৎ, জনস্বার্থে সরকার সব ব্যক্তিগত সম্পত্তিই অধিগ্রহণ করে নিতে পারে। বিচারপতি কৃষ্ণ অাইয়ার ঘোষিত বামপন্থী ছিলেন। তিনি কেরলের বাম সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে বাম-সমর্থিত প্রার্থীও হয়েছিলেন কৃষ্ণ আইয়ার। সদ্যপ্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় তাঁর ঐতিহাসিক রায়ে মন্তব্য করেছেন, বিচারপতি আইয়ার ১৯৭৭ সালে ‘বিশেষ আর্থিক ভাবনায় প্রভাবিত’ হয়ে তঁার রায় দিয়েছিলেন। বিচারপতি চন্দ্রচূড় এই বিশেষ আর্থিক ভাবনা বলতে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার কথা বলেছেন। ছয় ও সাতের দশকের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা যে এখনকার ভারতে অচল, সে-কথাও সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান বেঞ্চ তাদের রায়ে স্পষ্ট করেছে। কিন্তু বিচারপতি অাইয়ারকে যে-কটাক্ষ বিচারপতি চন্দ্রচূড় ছুড়ে দিয়েছেন, তার বিরোধিতা করেছেন বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি বি. ভি. নাগরত্ন ও বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া। তাঁরা বিচারপতি আইয়ার সম্পর্কে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মন্তব্যকে ‘রূঢ়’ এবং ‘অনাবশ্যক’ বলে মন্তব্য করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে কোনও রায়ের ক্ষেত্রে এভাবে প্রধান বিচারপতিকে সমালোচনা একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে রইল।
‘সব ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণযোগ্য নয়’ রায় দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চন্দ্রচূড় ভারতীয় সংবিধানের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন বলে উচ্ছ্বসিত কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি। তারা ফের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছে। ভবিষ্যতে যদি কোনও দিন ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ইন্দিরা গান্ধীর আনা ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি বাদ যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নামটি উচ্চারিত হবে। প্রধান বিচারপতি পদে থেকে এই অবদানটি শেষ মুহূর্তে তিনি রেখে গেলেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.