মন্দির-মসজিদ নিয়ে কোনও সমীক্ষা বা নতুন মামলা গ্রহণ করা যাবে না– জানিয়ে দিলেন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না। এদিকে সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন প্রাক্তন বিচারপতি ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ– সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
পদে থাকবেন মাত্র ১২০ দিন। অবসর নেবেন আগামী বছর মে মাসের ১৩ তারিখ। এত স্বল্প মেয়াদের জন্য দায়িত্ব পেয়েও সুপ্রিম কোর্টের ৫১তম প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না উগ্র-হিন্দুত্ববাদীদের উদ্ধত ফণার ফোঁসফোঁসানি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিলেন। তঁার সিদ্ধান্ত, আপাতত কোনও আদালত মসজিদের নিচে মন্দির আছে কি না খতিয়ে দেখতে কোনও সমীক্ষার নির্দেশ দিতে পারবে না। মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির দাবি নিয়ে নতুন কোনও মামলাও গ্রহণ করা যাবে না। ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান আইনের বৈধতার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত এই সংক্রান্ত কোনও মামলায় কোনও আদালত কোনওরকম কার্যকর রায় দিতে পারবে না।
প্রধান বিচারপতির এই নির্দেশ কট্টর হিন্দুত্ববাদী জনতাকে অবশ্যই আশাহত করেছে। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মনোভাবেও রাশ টানতে উদ্যোগী হয়েছে। ধর্মস্থান আইন নিয়ে এতকাল কেন্দ্রীয় সরকার চূড়ান্ত গড়িমসি করেছে। নির্দেশ সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টে ওই আইন নিয়ে সরকার তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেনি। এবার সলিসিটর জেনারেলকে প্রধান বিচারপতি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, চার সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রকে তার মনোভাব জানিয়ে হলফনামা পেশ করতে হবে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, পূর্বসূরিদের মতো অযথা কালক্ষেপ না-করে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না সম্ভবত এই জ্বলন্ত সমস্যার চূড়ান্ত মীমাংসা করে যেতে চাইছেন। পারবেন কি পারবেন না– সে অবশ্য অন্য বিষয়।
সঞ্জীব খান্নার এই নির্দেশের আগেই অবশ্য আতশকাচের তলায় চলে এসেছেন সদ্য প্রাক্তন হওয়া প্রধান বিচারপতি ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড়। উত্তরপ্রদেশের সম্বলের জামা মসজিদে সমীক্ষা চালানো নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যেদিন হস্তক্ষেপ করে, যেদিন জানিয়ে দেয়– হাই কোর্টের রায় না-আসা পর্যন্ত নিম্ন আদালত ওই মামলা নিয়ে কোনও নির্দেশ জারি করতে পারবে না, তার আগে থেকেই সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন চন্দ্রচূড়। কংগ্রেস একেবারে সরাসরি বলেছে, মন্দির-মসজিদ নিয়ে হিংসা ছড়ানোর জন্য পুরোপুরি দায়ী প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তিনিই ‘প্যান্ডোরার বাক্স’-র ডালা উন্মুক্ত করেছেন। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ ‘এক্স’ মারফত ওই মন্তব্য করে বলেছেন, চন্দ্রচূড় চাইলে জ্ঞানবাপী মামলা প্রথম দিনেই খারিজ করে দিতে পারতেন। ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান আইনের উল্লেখ করে বলতে পারতেন, কখনও কোথাও ওই ধরনের দাবি আমলে নেওয়া যাবে না। অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়া যেত এই ধরনের অপচেষ্টা। অথচ তা তিনি করলেন না। বরং তঁার যুক্তি দিকে দিকে পূজার্চনার আগল খুলে দিল।
একই কথা প্রতিধ্বনিত জম্মু-কাশ্মীরের পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি ও পিপল্স কনফারেন্সের নেতা সাজ্জাদ লোনদের কণ্ঠেও। আজমেঢ় শরিফ দরগার রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সারোয়ার চিশতিও রাখঢাক না-করে বলেছেন, দেশজোড়া উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য চন্দ্রচূড়-ই দায়ী। তিনি উদ্যোগী হলে আনাচকানাচে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটত না। সম্বলে পঁাচজনের মৃত্যু হত না। দুঃখের বিষয়, উদ্যোগী হওয়া তো দূরের কথা তঁার মন্তব্য দেশের মসজিদ ও দরগার নিচে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি খোঁজার ঢল নামিয়েছে।
কী মন্তব্য করেছিলেন চন্দ্রচূড়? তঁার এজলাসে জ্ঞানবাপী মসজিদে সমীক্ষা সংক্রান্ত মামলার শুনানির সময় বলেছিলেন, ১৯৯১ সালের আইনে উপাসনালয়ের চরিত্র বদল করা যাবে না বলা হয়েছে। কিন্তু চরিত্র নির্ধারণ করা যাবে না, তা বলা হয়নি। কীরকম যুক্তি ছিল সেটা? উপাসনালয়ের চরিত্র যখন বদলানো যাবে না তখন তার চরিত্র নির্ধারণের প্রয়োজন কেন? কোন মহাকার্য তাতে সাধিত হবে? তিনি কি বোঝেননি যে,
ওই মন্তব্য দিকে দিকে বিবাদের বহর বাড়িয়ে তুলবে? না কি জেনেবুঝেই ওই মন্তব্য করেছিলেন হিন্দুসত্তার উন্মেষ ঘটার কারণে?
এক-এক সময় কোনও কোনও ব্যক্তিকে পরলোক চিন্তা গ্রাস করে। কেউ আবার অবসরোত্তর জীবনযাপনের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হন। এক্ষেত্রে কী ঘটেছিল, বলা কঠিন। কারণ, রঞ্জন গগৈয়ের মতো উপহার এখনও তিনি গ্রহণ করেননি। যদিও এ-কথা অস্বীকারের উপায় নেই, ২০২২ সালে করা ওই মন্তব্য ১১টি উপাসনালয় ঘিরে ১৮টি মামলা রুজু হতে উৎসাহ জুগিয়েছে।
খই ফোটার মতো দাবি উঠছে এ-রাজ্য থেকে ও-রাজ্যে। বাদ যায়নি তাজমহল, কুতুব মিনারও। ১৯৯১ সালের রায়ের নিরিখে জ্ঞানবাপী মামলা খারিজ করে অমরত্বলাভের যে-সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, তা হেলায় হারিয়ে কৃতী চন্দ্রচূড় নিজেকে নামিয়ে আনলেন সাধারণের স্তরে। দেশের দুর্ভাগ্য এটাই।
অথচ, অশনিসংকেত অঁাচ করেছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। তঁাকে পর্যন্ত বলতে শোনা গিয়েছিল, সব মসজিদের নিচে শিবলিঙ্গ খোঁজার কোনও দরকার নেই। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। জল বইতে শুরু করেছে নাক বরাবর। মোহন ভাগবতদের বোঝা উচিত ছিল, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন সৃষ্টি হয়ে গেলে তাকে রোখার সাধ্য স্রষ্টার থাকে না।
নিজেকে এভাবে আতশকাচের তলায় টেনে আনার দায় চন্দ্রচূড় অন্য কারও উপর চাপাতে পারবেন না। সমকামিতাকে যিনি অপরাধমুক্ত করেছেন, গোপনীয়তার অধিকারকে মান্যতা দিয়েছেন, ইলেক্টোরাল বন্ডের বিলুপ্তি ঘটিয়ে নিজের উচ্চতা বাড়িয়েছেন, তিনিই ধর্মস্থান আইনের বিস্ময়কর ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিতর্কের আসনে বসালেন! তঁার মতো মেধার কাছে এই অবস্থান নিতান্তই বেমানান। অযোধ্যা মামলার রায় যে-বেঞ্চ দিয়েছিল, চন্দ্রচূড় ছিলেন সেই বেঞ্চের সদস্য। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর তিনি নিজেই জানান, স্বয়ং রামচন্দ্র নাকি তঁাকে রায়ের পথ বাতলেছিলেন! দিশা দেখিয়েছিলেন! অদ্ভুত ব্যাপার না! তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ নির্ভর ন্যায়বিচারের কথা যঁারা চিরকাল শিখে ও শিখিয়ে এসেছেন, তঁারাই যদি ঈশ্বরাশ্রিত হয়ে ওঠেন, তাহলে কী প্রমাণিত হয়?
ইলেক্টোরাল বন্ড মামলায় রায় দিতে গিয়ে যিনি ‘ক্যুইড প্রো কুও’, অর্থাৎ, কিছু দেওয়ার বিনিময়ে কিছু পাওয়ার কথা বলেছিলেন, সেই তিনি কি এইভাবে নিজের অবসরকালীন জীবনের সুপ্ত বাসনাটুকু প্রকাশ করে দিলেন? কারণ যা-ই হোক, সমালোচনায় বিদ্ধ তঁাকে হতেই হবে। নিস্তারের পথ তিনি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন। কেমন সমালোচনা? সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী দুষ্যন্ত দাভে রাখঢাক না রেখে বলেছেন, জ্ঞানবাপী মসজিদে সমীক্ষার নির্দেশ জারি রেখে চন্দ্রচূড় দেশ ও দেশের সংবিধানের মারাত্মক ক্ষতি করেছেন।
যঁারা দিনের পর দিন আদালত অবমাননার জন্য সাধারণ নাগরিক, রাজনীতিক ও আমলাদের তিরস্কার করেছেন, তঁারা নিজেই কিনা সর্বোচ্চ আদালতের রায় লঙ্ঘন করলেন! নতুন ব্যাখ্যা ও বিধান দিলেন! রায় অবমাননা ও আইনের শাসন লঙ্ঘন করলেন! দাভের অভিযোগ, চন্দ্রচূড় বিজেপির সুরে নাচলেন। বিজেপির অ্যাজেন্ডা তুলে ধরলেন। নিজে তা বুঝিয়েও দিলেন বাড়ির পুজোয় শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরাধ্য দেবতার আরতি করে। এবং তার ফলাও প্রচার করে।
প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না শান্তিপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ মানুষজনের মনে নিশ্চিতই কিছুটা আশা জাগিয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে জল্পনা। আশা জাগিয়েও তিনি কি পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন, না কি আইন ও সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অটুট রাখার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন? পারবেন কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই অল্প সময়ে পূর্বসূরিদের ছাপিয়ে যেতে? প্রশ্নগুলো উঠছে কারণ, ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এস. এ. বোবদে, এন. ভি. রমানা, ইউ. ইউ. ললিত ও ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড়। তঁাদের কেউ-ই ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান আইনের নিরিখে মন্দির-মসজিদ বিতর্কের চূড়ান্ত অবসান ঘটাননি। সঞ্জীব খান্না পারলে সেটা হবে নতুন ইতিহাস।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.