স্বাধীনতার মধ্যযামে মহানগরের রাত দখলের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে আমাদেরই মহিলা সহ-নাগরিকদের কণ্ঠে। এই সাহসী পদসঞ্চার আমাদের গর্বিত করেছে। ‘রাত’ শব্দটির গায়ে জড়িয়ে থাকা পুরুষাভিমানের ঠুনকো আস্তর দীর্ণ হোক। আপনাদের উদ্যত অধিকার ভাঙুক লৌহ কপাট। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়।
আর. জি. কর হাসপাতালের নারী চিকিৎসকের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সামাজিক মাধ্যমে রাত্রি-দখলের আহ্বান জানিয়েছেন সহ-নাগরিকরা। “স্বাধীনতার মধ্যরাতে নারী স্বাধীনতার জন্যে ‘মেয়েরা, রাত দখল করো’”– এই পোস্টার-বাহিত ডাক খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
মেয়েরা এখানে কর্তা। মেয়েরা এখানে নিজেরা নিজের স্বাধিকার যাপন করতে চান– কারও কাছ থেকে রক্ষালাভের পরোয়ানা ও নিরাপত্তা-বেষ্টন গ্রহণ করতে তঁারা নারাজ। ‘মনু সংহিতা’-য় মেয়েদের বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর ও বার্ধক্যে পুত্রের অধীন থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষের আধিপত্যবাক্য তঁারা প্রত্যাখ্যান করছেন। পুরুষের সাপেক্ষপদ হতে চান না তঁারা। তঁাদের এই দাবির সঙ্গে এসেছে কালজ্ঞাপক চিহ্ন। কী দখল করবেন তঁারা? রাত।
আমাদের সামাজিকতা তো মেয়েদের পক্ষে রাত্রিকে ‘কালরাত্রি’ করে তোলে। এই কালরাত্রি এসেছিল বেহুলার বাসরে। সর্পদংশনে মৃত লখিন্দরকে নিয়ে বেহুলাকে উজান স্রোতে ভাসতে হয়েছিল, ছিন্ন-খঞ্জনার মতো স্বামীর প্রাণের জন্য নাচতে হয়েছিল ইন্দ্রর সভায়। এই কালরাত্রির প্রসঙ্গ আসে ঋত্বিকের ছবিতে। উদ্বাস্তু শিবিরের সচেতন পুরুষরা হুঁশিয়ার করে দেন। তঁাদের জেগে প্রহরা দিতে হয়। ছিন্নমূল পরিবারের মেয়েদের উপর নেমে আসতে পারে লোলুপ পুরুষের দৃষ্টি। রাত্রি তো ভয়ের, রাত্রি তো তাই মেয়েদের লুকিয়ে থাকার, রাত্রিবেলায় সহযোগী, অভিভাবক পুরুষরা মেয়েদের প্রহরা দেন।
এই কালরাত্রির, কালো রাত্রির সাংস্কৃতিক চিহ্নকে নতুন জাগরণের চিহ্নে মুছে ফেলার জন্য এই রাত্রি-দখলের ডাক। ‘মেয়েরা রাত দখল করো’– না, তঁারা অভিভাবকত্বের বেষ্টন চান না আর। নিজের স্বার্থে নিজের শর্তে তঁাদের উত্থান। সামাজিক দৃশ্যমানতার চরিত্রকে বদলে দিতে চান তঁারা। সামাজিক দৃশ্যমানতার স্থিতিশীল চরিত্রকে তো বারংবার ভাঙতে হয়েছে মেয়েদের। স্কুল-কলেজে মেয়েরা একসময় ছিল অদৃশ্য, সংখ্যালঘু। এখন ছবি বদলেছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের চোখে পড়ছে। পর্দানশিন নন আর। তঁারা ঘোরতরভাবে দৃশ্যমান– এখন। তাহলে রাতেই-বা দৃশ্যমান হবেন না কেন! কেন একজন মেয়েকে শুনতে হবে– ‘এত রাত্রি করে বাড়ি ফিরছ?’ জাতীয় প্রশ্নের অন্তরালে নিষেধের দাপট।
মৃণাল সেন তঁার সিনেমায় মেয়েদের বারবার জায়গা দিয়েছেন। বলতে দ্বিধা নেই– ঋত্বিক কিংবা সত্যজিতের থেকে তঁার ছবিতে মেয়েদের প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ ফিরে আসে তীব্র সংবেদন-সহ। সত্যজিতের ‘মহানগর’ (১৯৬৩) মুক্তি পাওয়ার আগেই মৃণাল সেনের ‘পুনশ্চ’ (১৯৬১) আত্মপ্রকাশ করেছিল। সেখানে কর্মরত মেয়েটিকে কীভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ভুল বোঝে, আটকাতে সচেষ্ট হয় তার কথা। ১৯৬১-তে ‘পুনশ্চ’ করেছিলেন যিনি, ১৯৭৯-তে ‘একদিন প্রতিদিন’ করতে পারেন তিনি-ই। আর, এই ছবিটি এখনকার এই রাত-দখলের দাবির সূত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর্মরত মেয়েটি রাতে বাড়ি ফেরেনি। রাতে কী হল তার?
বারো ঘর এক উঠোনের ভাড়া বাড়িতে মেয়েটির বাড়ি না-ফেরা নিয়ে যে কথাগুলি উঠে আসে, সেই কথাগুলি মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক আবহ ও সংস্কৃতিকে বড় করে তোলে। কী কর্কশ আর কটু সেই আবহ! মেয়ে বাড়ি ফেরেনি! তার চরিত্র নিয়ে ময়নাতদন্ত, ইঙ্গিতপূর্ণ কথা পুরুষের মুখ থেকে কী অনায়াসে নিঃসৃত হয়! কারণ মেয়েটি কর্মরত– পরিবারকে টেনে নিয়ে যাওয়া মেয়েটি রাতে বাড়ি ফেরেনি।
রাত, রাত্রি, অন্ধকার– সেখানে কেবল শ্বাপদ পুরুষের চলাচলের অধিকার। মেয়েরা চলতে পারেন– তবে তঁাদের শর্তে স্বাধীনতায় নয়। পুরুষের ভোগ্য ও ভোজ্য হতেই যেন তঁাদের রাত্রে বাইরে যাওয়ার অধিকার। সমাজ তঁাদের ‘নষ্ট মেয়ে’ বলে! রাতের স্বাধীনতার সঙ্গে, রাতে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকারের সঙ্গে পুরুষের আধিপত্যের সম্পর্ক যে বিপরীত এবং এই সম্পর্ক যে-সভ্যতা তৈরি করেছে, তা কি বঙ্কিমও খেয়াল করেননি! করেছিলেন। করেছিলেন বলেই তো ‘কপালকুণ্ডলা’-র সংসার জীবনে রাত্রি-প্রসঙ্গ এল।
বনচারিণী, স্বাধীনা কপালকুণ্ডলা বিবাহসূত্রে নবকুমারের সংসারে আবদ্ধ হল। নবকুমার পুরুষ হিসাবে আধিপত্যকামী নয়, নতুন পুরুষের ভদ্র-মূল্যবোধ তার আছে, তবু রাতে কপালকুণ্ডলাকে একা যেতে দিতে সে দ্বিধাগ্রস্ত। শ্যামাসুন্দরীকে কপালকুণ্ডলা বলেছিল, ‘শুনেছ ত, রাত্রে বেড়ান আমার ছেলেবেলা হইতে অভ্যাস। মনে ভেবে দেখ, যদি আমার সে অভ্যাস না থাকিত, তবে তোমার সঙ্গে আমার কখনও চাক্ষুষ হইত না।’ এই রাত্রি বেলায় বেড়াতে অভ্যস্ত ছিল বলেই তো নবকুমার দ্বীপভূমিতে কপালকুণ্ডলাকে পেয়েছিল। সংসারের নিয়মে সেই অভ্যাসই বদলাতে হবে? কপালকুণ্ডলা প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমিও কি মনে করিয়াছ যে, আমি রাত্রে ঘরের বাহির হইলেই কুচরিত্রা হইব?’ এই উপন্যাসে কপালকুণ্ডলা শ্যামাসুন্দরীকে এ-কথা জানাতে ভোলেনি, ‘বোধ করি, সমুদ্রতীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারিলে আমার সুখ জন্মে।’
নারীজীবনের সেই নিঃশর্ত পদচারণার অধিকার বঙ্কিম তঁার দ্বিতীয় বাংলা উপন্যাসে উত্থাপন করলেও তা নারীদের অর্পণ করতে পারেননি। নারীদের তা অর্পণ করতে চেয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। তখন বঙ্কিম বিগত। উনবিংশ শতক অতিক্রান্ত। বিশ শতকে প্রবেশ করেছে সময়। ‘দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হল রোকেয়া-র “Sultana’s Dream”। উনিশ শতকেই চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় একাকিনী চিকিৎসা করতে যান। প্রথমে ভারতীয় ও ইংরেজ পুরুষদের যে বিরোধিতা তঁাকে সইতে হয়েছিল, তা তিনি জয় করেছেন। তিনি ঘোড়ার গাড়িতে করে উপনীত হন রোগীর শিয়রে। তৈরি হচ্ছে নতুন দৃশ্য।
চিকিৎসাপ্রদানের অধিকার অর্জন করছেন কাদম্বিনী। মেয়েরা মেয়েদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন– নতুন এক সহোদরা সম্পর্কে তঁারা বেঁধে বেঁধে থাকতে চান। কাদম্বিনী কামিনী রায়কে উৎসাহ দেন। শ্রমিকদের জীবন সম্বন্ধে সচেতন হতে বলেন। নাহলে লেখা হবে কেমন করে! ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই ভয় থেকে বাইরে আসতে হবে। বেগম রোকেয়া এই উনিশ শতকীয় সহোদরাদের সাহসী পদসঞ্চারের কথা জানতেন বলেই তো লিখতে পারেন সুলতানার স্বপ্ন– “Sultana’s Dream”। সে-লেখা শুরু হয়েছিল রাত-দখলের কথায়। “All on a sudden a lady stood before me; how she came in, I do not know. I took her for my friend, Sister Sara. ‘Good morning’, said Sister Sara. I smiled inwardly as I knew it was not morning, but starry night. However, I replied to her, saying, ‘How do you do?’ ‘I am all right, thank you. Will you please come out and have a look at our garden?’ I looked again at the moon through the open window, and thought there was no harm in going out at that time.” সহসা এক রমণী এসে দঁাড়ালেন। ভগিনী সারা। এসেই বললেন সুপ্রভাত। স্মিত হাসিতে ভেবেছিলাম এ তো প্রভাত নয়, এ তো তারকা-খচিত রাত্রি। চন্দ্রালোকিত রাত্রিই হয়ে ওঠে যথার্থ সকাল।
যখন মেয়েরা রাত-দখল করেন, যখন তা লোলুপ পুরুষের ভয় ভেঙে বাইরে আসার রাত হয়– তখনই তা যথার্থ সকাল। আপনারা দখল করুন রাত। আমরা পুরুষরা নিজেদের বদল করার চেষ্টা করি। রাতে মেয়েদের পদসঞ্চার স্বাভাবিক সামাজিক বলে দৃশ্যমান ও স্বীকৃত হলে মেয়েদের উপর রাতের বেলায় এই মর্মান্তিক আক্রমণের হার ও অভিসন্ধি কমবে। আপনাদের উদ্যত অধিকার অনেক কিছুর নিরাময় সাধন করতে পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.