উপস্থাপনার স্বভাবজ লিরিসিজম ভেঙে প্রথম পর্বেই সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছিলেন এক অনন্য ব্যতিক্রমী ছবি, ‘দেবী’, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘stark’। উনিশ শতকের রনেসাঁস-ইতিহাস ছেনে সোশ্যাল সাইকিয়াট্রির এক নিবিড় পাঠ। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো টানটান কাঠামোয় এত নির্মমভাবে তা প্রকাশিত যে, প্রবহমান ইতিহাসে আজও তার সত্যতা অব্যাহত থাকে। সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ। লিখছেন চিন্ময় গুহ।
সত্যজিৎ রায়ের যে-দু’টি সিনেমার মুখোমুখি হতে আমরা সবচেয়ে ভয় পাই, আমার মতে, তা হল– ‘দেবী’ (১৯৬০) আর ‘সদগতি’ (১৯৮১)। যেখানে তিনি আবহমান ভারতীয় সমাজবাস্তবের দু’টি ভয়ংকর দিক তুলে ধরেছেন: কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা এবং জাতপাত। এখনকার ঘনায়মান অন্ধকারে ছবি দু’টি আলোর বর্শার মতো বুকে এসে বেঁধে।
চিত্রভাষাকে যিনি রবীন্দ্রনাথ-কথিত আপন শিল্পমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেন, তিনি উপস্থাপনার স্বভাবজ লিরিসিজম ভেঙে প্রথম পর্বেই নির্মাণ করেছিলেন এক অনন্য ব্যতিক্রমী ছবি, ‘দেবী’, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘stark’। উনিশ শতকের রনেসঁাস-ইতিহাস ছেনে সোশ্যাল সাইকিয়াট্রির এক নিবিড় পাঠ। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো টানটান কাঠামোয় এত নির্মমভাবে তা প্রকাশিত যে, প্রবহমান ইতিহাসে এখনও তার সত্যতা অব্যাহত থাকে।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় ছোটগল্পের (যার একটি উপাদানকেও বাদ দেননি সত্যজিৎ, যুক্ত করেছেন বিভিন্ন নতুন মাত্রা) আখ্যানভাগ, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পাওয়া। রবীন্দ্রনাথ কি ভাবতে পারতেন এই শক্তিশালী আখ্যানকে কীভাবে পূর্ণ সমাজচিত্রের রূপ দেবেন সুকুমার-পুত্র? আমরা চোখ বুজে দেখতে পাই কয়েকটি চিত্রকল্প: দুর্গাপ্রতিমার কাঠামো পড়ে আছে নদীর ধারে। সভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে দয়াময়ীর পায়ের আঙুল। অথবা উন্মাদিনী মেয়েটি দৌড়ে যাচ্ছে অপাবৃত কুয়াশায়।
ছবি শুরু ও বৃত্তাকারে শেষ হয় নিরাভরণ দেবীমুখ দিয়ে (‘জলসাঘর’-এর ঝাড়লণ্ঠনের মতো), যার উপর আমরা পরিয়ে দেব জটিল এক সমাজ-মনস্তত্ত্বের জাল। ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে কঠিন বাস্তবের এ এক কঠিন প্রকাশ, যেখানে উৎকীর্ণ থাকে সত্যজিতের সেরা বৈশিষ্ট্য: ‘Perspective’ নির্মাণ, যা ইউরোপীয় রনেসঁাসের শিল্প-ইতিহাস ও ভারতীয় রসশাস্ত্র থেকে তিনি আহরণ করেছেন। ‘কাইয়ে দু্য সিনেমা’-র বিশিষ্ট সমালোচক শার্ল তেসঁ-র মতে, এটি পল সেজানের ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। টুকরো নয়, সমগ্রের নির্মাণ।
ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ‘অপু ত্রয়ী’ (১৯৫৫-১৯৫৯) ও ‘জলসাঘর’-এর (১৯৫৮) চিত্রকর বদলে নিলেন ভাষা। বঙ্গীয় রনেসঁাসে দু’টি জগতের স্রোত-প্রতিস্রোতের টানাপোড়েনকে না বুঝলে ‘দেবী’-কে বোঝা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। একদিকে কালীকিঙ্কর, তার সংস্কৃত জ্ঞান (মন্ত্রপাঠ ও ‘রঘুবংশ’ থেকে দীর্ঘ আবৃত্তি), গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতা; অন্যদিকে আলোকপ্রাপ্ত ইংরেজি শেখা নতুন প্রজন্ম, কনিষ্ঠ সন্তান উমাপ্রসাদ, অধ্যাপক সরকার, বন্ধু ভূদেব যে একটি বিধবা মেয়ের প্রেমে পড়েছে।
২২ বছর পরে ১৯৮২ সালে সত্যজিৎ রায় লেখেন– ‘দেবী’ ছবিকে বুঝতে হলে পশ্চিমি চিত্ রসমালোচকদের কয়েকটি জিনিস জানা দরকার: ‘19th century Renaissance and how it affected the values of the orthodox Hindu society; …the position of the Hindu bride in an upper-class family, and the relationship between father and son in the same family. All the turns and twists of the plot grow of one or more of the factors.’ অর্থাৎ এতগুলি বিষয় মাথায় রেখে ছবি করেছিলেন তিনি।
‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’-র সত্যজিৎ-জীবনীকার শার্ল তেসঁ-র ভাষায়, এ হল ‘un film violemment iconoclasté’ (‘ভয়ংকরভাবে প্রতিমাচূর্ণকারী একটি ছবি’)। ‘দেবী’-র সাদা মুখমণ্ডল দিয়ে দৃশ্যপট শুরু, অবশেষে পূর্ণ সুসজ্জিত রূপ। ঝড়ের আওয়াজ। দেবীপূজা, ঢাকের শব্দ। পূজারত কালীকিঙ্কর (ছবি বিশ্বাস) ও বড় ছেলে তারাপ্রসাদ। ‘সবাই বলির জন্য উদগ্রীব’ (চিত্রনাট্য)। কালীকিঙ্কর ও তারাপ্রসাদ বলি দেখে। অতঃপর উমাপ্রসাদ (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) ও ভ্রাতুষ্পুত্র খোকা আতসবাজি দেখছে। পাশে দয়াময়ী (শর্মিলা ঠাকুর)। সংগীতে ভিন্ন সুর, কাউন্টারপয়েন্ট– কারণ দু’টি আলাদা জগৎ। প্রতিমা বিসর্জন। নদীর জলে দুর্গার মুখ ডুবে গেল। প্রতিটি অনুপুঙ্খ প্রতীকী: প্রতিমার নগ্নতা ও পোশাক, বলি ও বিসর্জন। এক যুগসন্ধিতে দুই প্রজন্ম।
দয়া: কেন যাচ্ছ?
উমা: বা-রে– কলেজ আছে, পরীক্ষা আছে না– পাশ করতে হবে তো–
দয়া: কী লাভ?… ইংরিজি পড়ে
তো চাকরির জন্য আর চাকরি
মানে রোজগার–
উমা: বেশ!
দয়া: আর রোজগার মানে টাকা।… তোমার বুঝি টাকার অভাব হয়েছে–
উমা: বড়লোকেরা বুঝি ইংরিজি পড়ে না! রাজা রামমোহনের কি টাকার অভাব হয়েছিল? (সত্যজিতের ইতিহাসচেতনা এখানে অসীম গুরুত্বপূর্ণ।)
দয়া: আহা– ইংরিজি না শিখলে বুঝি বিদ্যে হয় না– তোমার বাবার বুঝি বিদ্যে নেই?
উমা: আছে– সে তো পুরনো বিদ্যে। তঁার আর আমার মধ্যে এক যুগের ব্যবধান। বুঝেছ?
এর সঙ্গে যুক্ত হয় পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা।
উমা: তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
দয়া: বা-রে, যাব না– তুমি যেখানে যাবে সেখানেই যাব।
উমা: যাবে?
দয়া: তোমার বাবা যদি যেতে
না দেন!…
আমরা ছবির সেই ভয়ংকর ক্লাইম্যাক্সের আগের দৃশ্যে দেখি দয়াময়ী কালীকিঙ্করের পায়ে তেল মালিশ করছে। কালীকিঙ্কর একটি বাঘছালের উপর বসে, মুখে অপরিসীম তৃপ্তি। দয়াময়ীকে তার ব্যক্তিগত প্রশ্নে আমরা অস্বস্তি বোধ করি: ‘সে তোমার কদর বোঝে তো মা? নিয়মিত চিঠিপত্তর দেয় তো?… না ফঁাকি দেয়? কী, দেয়?… রোজ লেখে?’ দৃশ্যটিতে ফ্রয়েডীয় ইঙ্গিত স্পষ্ট।
অতঃপর কালীকিঙ্করের স্বপ্ন। প্রথমে তিনটি চোখ এগিয়ে আসছে। সেই চোখের সঙ্গে দয়াময়ীর চোখ মিশে যায়। সে-দৃশ্য মিলিয়ে গিয়ে পঞ্চপ্রদীপের আরতি দেখা যায়। প্রদীপ ঘুরতে-ঘুরতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। কালীকিঙ্করের ঘুম ভেঙে যায়। সে বিস্ময়বিমূঢ়ভাবে খাটের স্ট্যান্ড ধরে দেয়ালে টাঙানো কালীর ছবির দিকে তাকিয়ে ‘মা—মা—মা’ বলে ওঠে। দয়ার ঘর, সে এবং খোকা ঘুমচ্ছে। কালীকিঙ্করের খড়মের আওয়াজ।
কালী: মা!
দয়াময়ী দরজা খোলে।
কালী: মা– এত দিন কেন
বলিসনি মা–
কালীকিঙ্কর তাকে প্রণাম করে। ভীতসন্ত্রস্ত দয়াময়ীর পা কুঁকড়ে যায়। দেখাদেখি তারাপ্রসাদও তাকে প্রণাম করে। দেওয়ালে দয়াময়ীর অঁাচড়ের দাগ।
অতঃপর নাটমন্দিরে ক্লান্ত, মুহ্যমান দয়াময়ীর আরতি। ‘চরণামৃত’ খেয়ে একটি অসুস্থ শিশুর দৈবাৎ সুস্থ হয়ে
ওঠা এবং হিন্দুত্বের ‘mass hysteria’, যার চুলচেরা, নির্মম উপস্থাপনা করেন ত্রিশের ঘরের চলচ্চিত্রকার।
তারাপ্রসাদ ধর্মান্ধতায় অবিশ্বাসী স্ত্রীকে বলে, ‘বাপের ধর্ম, বাপের কর্ম, বাপের যশ, বাপের টাকা!’ হিন্দু ধর্মান্ধতার এই নির্বোধ মাতলামির বিপরীতে সত্যজিৎ দেখান, রনেসঁাসের নতুন যুক্তিতে আলোকিত উমাপ্রসাদ ও বন্ধু ভূদেব (অনিল চট্টোপাধ্যায়) কলকাতায় ‘সধবার একাদশী’ নাটক দেখছে। মাতাল নিমচঁাদ বলছে, ‘পাজি, তুমি পাজি– তোমার বাবা পাজি– তোমার সাতপুরুষ পাজি– তোমার আদিশূরের সভা পাজি–’ এই নাটকের নির্বাচন বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই অসাধারণ মন্তাজ যেন ছুরি দিয়ে দু’টি জগৎকে পর্দায় খোদাই করে দেয়। বিষণ্ণ ভূদেবকে হ্যামলেটের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে কি উমাপ্রসাদ ভবিষ্যতে তার নিজের দ্বিধাদ্বন্দ্বের ছবিই তুলে ধরে? ভূদেব জানায় সে এক বিধবা মেয়ের প্রেমে পড়েছে।
লক্ষণীয় যে, বিধবা-বিবাহ আইন পাস হয়েছিল ১৮৫৬ সালে, আর ‘সধবার একাদশী’ প্রহসন প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে। ইতিহাসের এই চালচিত্র আমাদের সামনে রাখেন সত্যজিৎ। উমাপ্রসাদ ভূদেবের বাবাকে বোঝানোর দায়িত্ব নেয়। বলে ‘কনভিন্স করব। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সমস্ত argument আমার এইখানে– (সে হাতের আঙুলের নখ দেখায়)।’ ঘরে ফিরে শোনা যায় পিছনের বাড়িতে একটি ছেলে পরীক্ষার পড়া তৈরি করছে। ভৃত্যকে বলে, ‘কাল থেকে আমায় তুলে দিস তো, ভোরে পড়ব।’ অর্থাৎ শিক্ষার আলো, বিদ্যাসাগর এবং দীনবন্ধু মিত্র মিশে যায়। একদিকে, ‘stranglehold of Hindu orthodoxy in 19th century Bengal’ (সত্যজিতের ভাষা, ১৯৮২) অন্যদিকে এই নবোদ্গত আলো। পুরনো অন্ধবিশ্বাস ও বিকাশমান নতুন চেতনা। অতঃপর, পিতা-পুত্রের কথোপকথন ইতিহাসের অন্তঃশরীর থেকে উঠে আসে।
কালী: মা দয়াময়ী, তোমার স্ত্রী– দেবীর অবতার, দেবীর অবতার।
উমা: আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন!
কালী: কী বললে?
উমা: আপনি পাগল হয়ে
গিয়েছেন, বাবা!
কালী: আমি পাগল হয়ে গিয়েছি!
উমা: নইলে এমন অদ্ভুত ধারণা আপনার হল কী করে?… স্বপ্ন! আপনি স্বপ্ন দেখেছেন! এ সমস্তই আপনার স্বপ্নের পরিণাম!
দঁাড়ের চন্দনা পাখির দয়াময়ীকে দেখে ‘মা, মা, মা’ বলে ডেকে ওঠে, যা পরে এক ভয়াবহ আরোপিত দেবীত্বের বিপরীতে এক মানবমাত্রা পাবে। পরে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির মর্মবিন্দুতে এক অজানা পাখির ডাকের কথা মনে পড়বে আমাদের। ‘দেবী’-তে নাটকীয় মুহূর্তে বারান্দার পাখির ‘দয়াময়ী’ অথবা ‘মা’ ডাকের গুরুত্ব অসীম। কালীকিঙ্করের স্বপ্নাবিষ্ট, অপ্রকৃতিস্থ ‘মা, মা, মা’ ডাকের পাশাপাশি পাখিটির সহজ ‘মা’ ডাক দয়ার রক্তমাংসের সহজ অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
উমাপ্রসাদ দয়াকে বলে, ‘তুমি ভয় পেয়েছ, না? আমি জানি তুমি ভয় পেয়েছ– আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না– আমি জানি তুমিও করো না– তুমি ছেলেমানুষ, তাই কিছু বলতে পারো না। কিন্তু তাই বলে এভাবে আমি তোমাকে–’
‘আমরা পালিয়ে যাব দয়া, এক্ষুনি, কলকাতায়!… নৌকো অপেক্ষা করছে শুধু এই ঘাটের রাস্তাটুকু কষ্ট
করে যেতে হবে, দয়া, পারবে না? চলো, দয়া চলো–’
কাশবনে উমাপ্রসাদ ও দয়া। দয়া থমকে দঁাড়ায়। ‘কী হল?’ দুর্গা-প্রতিমার কাঠামো পড়ে আছে নদীর ধারে। সত্যজিৎ রায়ের মাস্টারস্ট্রোক। চরিত্রের মনের গভীরে প্রবেশ করার বিরল ক্ষমতা তঁার। দয়া বলে: ‘আমি যদি দেবী হই– যদি দেবী হই–’। শর্মিলা ঠাকুরের অভিনয় তঁার সমস্ত অভিনয়কে অতিক্রম করে যায়।
উমা: তুমিও কি পাগল হলে, দয়া? এভাবে চলে গেলে তোমার যদি অমঙ্গল হয়?
মনস্তত্ত্ব পাঠ কাকে বলে!
উমা: শোনো দয়া, এখন যদি তুমি দুর্বল হও, পরে অনুতাপ করবে। তখন তো আমি পাশে থাকব না! চলো দয়া– এখান থেকে চলে গেলে তোমার
সমস্ত সংকোচ কেটে যাবে। চলো,
দয়া, চলো–
উমা দয়াময়ীকে জড়িয়ে ধরে।
দয়া: আমার ভয় করছে–
দয়া কঁাদতে থাকে। তারা ফিরে আসে।
বিয়ের দিনে উমাপ্রসাদের স্বপ্ন ভেসে আসে: ‘তুমি কি মাটির পুতুল?’
দয়ার ঘরে বল ঢুকে গেলে খোকা ঢুকতে সাহস পায় না। দয়াকে বারান্দায় দেখে খোকা পালায়। এসব সূক্ষ্ম তুলিটান বিশ্বচলচ্চিত্রে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের পক্ষেই সম্ভব। গভীরতা ও পরিমিতি
তঁার অধিগত।
‘দেবী’ ছবিতে তারাপ্রসাদের স্ত্রী দেবীত্বে অবিশ্বাসী হরসুন্দরী ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র– প্রফেসর সরকার (অভিনেতা কালী সরকার, ‘জলসাঘর’ ছবির সেই অবিস্মরণীয় ভৃত্য)। ‘দেখো উমাপ্রসাদ,… সংস্কারবিরুদ্ধ কোনও কিছু করতে যাওয়া মানেই চোট খাওয়া– এটা নিয়ম ও হবেই–’… ‘তোমাকে একটা ডিসিশন নিতে হবে এবং তোমাকেই নিতে হবে।… গোটাকতক বাছাই করা দার্শনিক উক্তি হয়তো তোমাকে শোনাতে পারি। কিন্তু সমস্যাটা তো আমার নয়, বা প্লেটোরও নয়–’
খোকার অসুস্থতা, দয়ার হাতে সঁপে দেওয়া এবং উমাপ্রসাদের নৌকোয় আসা। খোকার মৃত্যু। ‘আপনি খোকাকে হত্যা করেছেন বাবা!’
দয়াময়ীর ঘর। সে আয়নার সামনে অলংকার পরে দঁাড়িয়ে।
‘তুমি এসেছ?’
উমা: দয়া–
দয়া: (হার নিয়ে দঁাড়িয়ে) এটা পরিয়ে দাও না লক্ষ্মীটি– এটা পরিয়ে দাও না!
দয়া: দাও, দাও– শিগগির দাও– আমরা যাব যে, দাও–
উমা: কোথায় যাব দয়া!
দয়া: পালিয়ে যাব– (ছুটে
চলে যাচ্ছে)।
নইলে এরা আমায় মেরে
ফেলবে– খোকাকে–
উমা: দয়া–
দয়া: চলো, শিগগির চলো–
উমা: দয়া– দয়া–
দয়া: ছাড়ো—–
সরষে খেত। দয়াময়ী দৌড়ে যাচ্ছে। এক অপার্থিব আলোয় এক উন্মাদিনী। সুব্রত মিত্রর পরামর্শ না মেনে যে এই আলো ব্যবহার করেন সত্যজিৎ।
আমাদের মনে পড়বে প্রথম দৃশ্যের বলি ও বিসর্জন। পুরনো ভাষ্যে দয়ার যে-মৃত্যুদৃশ্য ছিল, সত্যজিৎ পরে তা বর্জন করেন। এক অদ্ভুত আলোয় উন্মাদিনী দয়ার দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্য বিশ্ব চলচ্চিত্রে আমার দেখা সবচেয়ে গায়ে কঁাটা দেওয়া দৃশ্যগুলির একটি– যা সমাজের ভিত কঁাপিয়ে তোলে, আর ধর্মান্ধ উন্মাদনার জঠর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে, কেবলই গড়িয়ে পড়ে। শর্মিলা ঠাকুর আমাকে একাধিকবার বলেছেন, এটি তঁার সেরা কাজ। এখনও দেখলে বিন্দু বিন্দু রক্তঘাম ফুটে ওঠে।
ঋণ ঋদ্ধি গোস্বামী
(মতামত নিজস্ব)
লেখক এমিরেটাস অধ্যাপক,
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.