‘ডিউটি রুম’, মানে, যেখানে কাজের ফাঁকে চিকিৎসকরা ক্ষণিকের জন্য জিরিয়ে নেন, সেই জায়গাটাকে বরাবর ‘সেফ’ ভেবে এসেছি। আর. জি. কর কাণ্ডে সেই ধারণা ধাক্কা খেল। এবার মহিলা চিকিৎসকরা নাইট ডিউটি করতে না চাইলে, কী বলব, তা-ও জানি না। লিখছেন অর্পণ চক্রবর্তী।
আমার মেয়েও ডাক্তারি পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। আর. জি. কর কাণ্ডের কথা ও জানে। এ-ই নিয়ে আলাদা করে ওর সঙ্গে কথা বলিনি। বলেছি, সাবধানে থাকতে। কিন্তু এরপর যদি আমার মেয়ে আমাকে কোনও কারণে বলে– ও আর ডাক্তারি পড়বে না, বা ওর আর এই প্রফেশনে থাকতে ইচ্ছা করছে না– আমি সত্যি জানি না, কোন যুক্তিতে ওকে বলব যে, সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করে দেখ।
আর-পাঁচজন বাবার মতো আমিও চাই– আমার মেয়ে পড়াশোনা করুক, প্রতিষ্ঠিত হোক। তবে এই মুহূর্তে মেয়ের নিরাপত্তা ছাড়া আর কোনও কথা মাথায় আসছে না। মেয়ে যদি বলে পড়বে না, আমিও সায় দিয়ে বলব, পড়তে হবে না, বাড়িতে থাক। চোখের সামনে থাকলে অন্তত সসম্মানে বেঁচে তো থাকবে!
চাকরি চাকরির মতো চলবে। ব্যক্তিগত জীবন চলবে ব্যক্তিগত শর্তে। এমন একটা শ্রেণিকরণে অনেকেই আমরা অভ্যস্ত। পেশাগত জীবনকে যারা ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে রাখতে চায়– তাঁদের যুক্তিতে নিশ্চয়ই সারবত্তা আছে। তবে, কিছু পেশায় কখনও কখনও ব্যক্তিগত জীবনের অভ্যাস ঢুকেই পড়ে। চিকিৎসকের জীবন যেমন। ২৪ ঘণ্টা, বা তার বেশি সময় ধরে যখন ডিউটি করতে হয় একজন চিকিৎসককে, তখন হসপিটালই তাঁর ঘর-বাড়ি। ‘সেকেন্ড লিভিং রুম’ নয়, বরং সেটা হয়ে পড়ে কার্যত ‘ফার্স্ট লিভিং রুম’। সেখানেই খাওয়াদাওয়া। সেখানেই বিশ্রাম, ঘুম। একজন চিকিৎসক, একজন স্বাস্থ্যকর্মী এসব রেস্ট রুমে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন, এ-ই স্বাভাবিক। কিন্তু যা ঘটে গেল আর. জি. কর-এ, এরপর নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, অবহেলা করে এড়িয়ে যাওয়া যাবে কি?
হসপিটালে, বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে তো বটেই, নাইট ডিউটি হয় অনেকগুলো ‘টায়ার’-এ। ইনটার্ন থাকেন, হাউস স্টাফ থাকেন, ‘পি. জি. টি.’ (‘পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি’) থাকেন, থাকেন ‘এস. আর.’ (সিনিয়র রেজিস্ট্রার)। এঁরা দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেন। এটাই পন্থা। এমন-ই হয়ে আসছে দীর্ঘ কাল ধরে। প্রশ্ন হচ্ছে– এঁরা কোথায় থাকেন, কোথায় দু’-দণ্ড বসে জিরিয়ে নেন? কারণ, আগেই বলেছি, ডিউটি চলে কম করে ২৪ ঘণ্টা, প্রয়োজনে আরও বেশি। সাধারণত এমার্জেন্সির পাশে, বা অপারেশন থিয়েটারের লাগোয়া একটি ঘর থাকে। যেটার পোশাক নাম “রেসিডেন্ট ডক্টর’স রুম”। সেখানে তাঁরা বিশ্রাম নেন। হয়তো পাঁচজনের জন্য দু’টি খাট, আর ওয়াশ রুম। খুবই ছিমছাম, বাহুল্যবর্জিত বন্দোবস্ত। সকলে তো এক সময়ে বিশ্রাম নেন না। কেউ হয়তো রাতের শেষ ভাগে একটু বিশ্রাম নিলেন, কেউ-বা হয়তো প্রথমার্ধে জিরিয়ে নিয়ে শেষের দিকে ডিউটি করলেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি– এই ‘ডিউটি রুম’-কে আমরা এতটাই ‘সেফ’ মনে করতাম যে, নির্দ্বিধায় সেখানে এসে বিশ্রাম নিতাম। কয়েক সেকেন্ড লাগত, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। এর কারণ, সবসময় মনে হত সহকর্মীরা, বন্ধুরা আমাকে ঘিরে রেখেছে।
প্রসঙ্গত জানাই, আমিও আর. জি. কর-এর প্রাক্তনী। আমাদের ব্যাচের যাঁরা মহিলা সহপাঠিনী, তাঁরা-ও রেস্টরুমে বিশ্রাম নিতেন ডিউটি করার ফাঁকে-ফাঁকে, কেউ-বা বইয়ের পাতায় ডুব দিতেন। তাঁদের মুখে কখনও নিরাপত্তাহীনতার কথা শুনিনি। ‘নাইট ডিউটি’ নিয়ে তাঁদের সেভাবে আতঙ্কে ভুগতেও দেখিনি। সত্যি বলতে, এই ঘটনা ঘটার আগে– যদি কেউ আমাকে এমনটা ঘটতে পারে কি না জিজ্ঞেস করত– আমি হয়তো আমলই দিতাম না, বা বলতাম– ধুস! কিন্তু এখন আর অত সহজে প্রশ্নটাকে ছেড়ে দিতে পারছি না। তাছাড়া, আর. জি. করের প্রাক্তনী বলেই জানি, রাতের বেলা সেখানটায় কেমন জনসমাগম থাকে। এই এমার্জেন্সিতে পেশেন্ট ঢুকছে, এই সাইরেন বাজছে, রোগীর পরিবারের লোকদের আনাগোনা, চিকিৎসক-সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘোরাফেরা– গমগমে জ্যান্ত আবহ। অথচ, এমন পরিবেশে যে-কাণ্ডটি ঘটল, তার নিরিখে প্রশ্ন উঠবেই– তাহলে কোন জায়গাটি ‘সেফ’?
মাঝে মাঝেই শোনা যায়, সাধারণ মানুষের হাতে ডাক্তারদের হেনস্থা হওয়ার ‘খবর’। এই চড়াও হয়ে গায়ে হাত দিল, এই কেউ কলার চেপে ধরল। সেসব ঘটনায় কি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি দেওয়া হয়েছে, হয়? চিকিৎসকের কলার ধরে যদি পার পেয়ে যাওয়া যায়, তাহলে সাহস তো জন্মাবেই– চিকিৎসককে যৌন নির্যাতন করার, খুন করার।
ওয়ার্ক প্লেসে একজন মহিলা চিকিৎসককে নিয়োগ করার সময়ে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। প্রথমত, তিনি কোথায় নিজের ব্যাগপত্তর রাখবেন, এমন একটা জায়গা যা ‘সেফ’। দ্বিতীয়ত, ওয়াশ রুম কতখানি স্বাস্থ্যকর ও ব্যবহারযোগ্য। তৃতীয়ত, সেই মহিলা চিকিৎসক কোথায় ‘চেঞ্জ’ করবেন, কোথায় বিশ্রাম নেবেন। নিজে যখন-যখন ইন্টারভিউ নিয়েছি, গোড়াতেই একজন তরুণ চিকিৎসকের কাছে জানতে চেয়েছি– ‘আপনি চাকরিতে জয়েন করার সময় প্রথমে কোন বিষয়গুলি জানতে চাইবেন?’ আসলে সেসব ‘এসেনশিয়াল’ বিষয় হল, ওই পূর্বকথিত পয়েন্টস– ওয়াশ রুম ভাল তো, চেঞ্জ করার জায়গা নিরাপদ তো ইত্যাদি। কর্তৃপক্ষকেই এগুলি দিতে হবে। না দিতে পারলে, প্রশ্ন উঠবে। গত শুক্রবার রাতে, আড়াইটে নাগাদ যখন আমি বাড়ি যাচ্ছি, দেখলাম, আমার বিভাগের নাইট ডিউটি টিমে ছ’জন মহিলা রয়েছেন। আর. জি. কর কাণ্ডের পরে যদি তাঁরা সমবেতভাবে আমাকে বলেন– ‘আর নাইট ডিউটি করব না’– আমি কি পারি তাঁদের কথা নাকচ করে দিতে?
এই শহরে নাউট ডিউটি করতে-করতে একজন মহিলা চিকিৎসক ধর্ষিতা হলেন, খুন হলেন– তারপরে আর কী বলার থাকে? পেরিফেরাল মেডিক্যাল সেন্টারে কর্মরত অনেক মহিলা চিকিৎসকের কথা জানি– যাঁরা পকেটে লঙ্কার গুঁড়ো রেখে ডিউটি করেন, বা কোনও পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেন। এঁরা হয়তো দূরবর্তী স্থানের জনবিরলতার কথা মাথায় রেখে আগাম সতর্ক থাকেন। অন্যদিকে, আমাদের ‘ধারণা’-য় গাঁথা ছিল, মহানগরের মহিলা চিকিৎসকরা ঢের নিরাপদ, তাঁদের কখনও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না। সেই ‘ধারণা’ এবার যে বদলাতে হবে– সন্দেহ নেই। সবার উপরে নাকি মানুষ সত্য। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো নাকি পাপ। আর. জি. করের ঘটনা চিকিৎসকদের না ‘সত্য’-ভ্রষ্ট করে দেয়! চিকিৎসকরা না গভীর পাপে আচ্ছন্ন হন!
(মতামত নিজস্ব)
লেখক চিকিৎসক, অ্যাপোলো হসপিটাল
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.