স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে স্বনির্ভরতার প্রতীক ও রাজনীতিবিদদের ধ্রুপদী ইউনিফর্ম ছিল খাদি। সেই খাদি এখন ভারতের ফ্যাশন হাউসের অন্যতম প্রিয় উপকরণ হয়ে উঠছে। মহাত্মা গান্ধীর ‘গ্রাম স্বরাজ’ ভাবনার এই উপাদানটি নতুন রূপে বাজারে ফিরে এলে মন্দ কী! ২ অক্টোবরে বিশেষ প্রবন্ধ। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
বাপু রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে বাদ দিতে চাননি। জাতিগঠনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রতীক হিসাবে খাদির ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর জীবন, চিন্তাধারা, বিভিন্ন আন্দোলনে চরকা এবং খাদি উভয়ই রীতিমতো গুরুত্ব পেয়েছিল। খাদি আসলে যে কোনও প্রাকৃতিক কাপড়কে (তুলো বা সিল্ক) বোঝাতে পারে, যা হাতে-কাটা সুতো এবং হাতে-বোনা হয়ে থাকে। ‘খাদি’ নামটি এসেছে ‘খদ্দর’ থেকে, এবং এটি ভারতের প্রাচীন হস্তনির্মিত বয়ন-ঐতিহ্যের উদাহরণ।
সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে, ভারতীয় কাপড়গুলি এতটাই উন্নত ছিল যে, তা ইউরোপীয় বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছিল। ক্রমশ দেখা যায়, ইউরোপের নিজস্ব কাপড় বাজারি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। তখন ফরাসি ও ব্রিটিশদের দ্বারা সেসব কাপড় ‘নিষিদ্ধ’ করার খেলা শুরু হয়। আর, গান্ধীজি ভারতীয় বস্ত্রবয়নের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন খাদি পরতে বলে। গান্ধীজির অর্থনৈতিক ভাবনার মূল বিষয় ছিল– ‘গ্রাম স্বরাজ’। এর অর্থ: প্রতিটি গ্রামকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে, যার দু’টি মৌলিক চাহিদা– খাদ্য ও বস্ত্র। পরিবারের প্রতিটি সদস্য চরকা চালাবে, সুতো কাটবে। সেই সুতো থেকে গ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় উৎপাদন করা হবে। একইভাবে গ্রামকে নিজের চাল, শাক-সবজি ইত্যাদি উৎপাদন করতে হবে। যাতে খাদ্য ও বস্ত্র বাইরে থেকে গ্রামে আমদানি করতে না-হয়।
যেহেতু তাঁর ধারণার মূল বিষয় গ্রাম স্বনির্ভরতা, তাই তিনি সর্বদা খাদি ও গ্রামীণ শিল্পের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতেন। গান্ধী ভারতের গ্রামে বসবাসকারী দরিদ্র এবং জনসাধারণের কথা ভেবেই চরকায় সুতো কেটে ১৯১৮ সালে খাদি আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তবে ১৯১৫ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে আসার পর, তখনই ‘চরকা’ সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা হয়েছিল মোহনদাস করমচঁাদ গান্ধীর। যদিও এর বেশ কয়েক বছর আগে, ১৯০৮ সালে, তিনিই ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ লেখেন, ভারতে দিন-দিন যেভাবে গরিবি বাড়ছে সেটা চরকা দিয়েই মিটতে পারে। ব্রিটিশ বিরোধিতা করতে হলে স্বদেশি উৎপাদন করা দরকার, সেটা ভালভাবেই বুঝেছিলেন ‘জাতির জনক’। আর তাই তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে খাদি আন্দোলনকে মিশিয়ে দিতে চাইলেন।
এই পথে ব্রিটিশদের শুধু ধাক্কা দেওয়া হবে না, পাশাপাশি দেশের মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব বলে বুঝেছিলেন বাপু। গান্ধীজির ‘স্বদেশি’ ধারণা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। ভারী শিল্প গড়ে তোলার পরিবর্তে অতীতে ভারতে থাকা শুধুমাত্র কৃষিভিত্তিক কুটিরশিল্পের দিকেই গান্ধীজি ঝুঁকেছিলেন, কারণ সেটাই তো একটা সময়ে জনগণকে উদ্যোগী বানিয়েছিল। গান্ধীজিও সেই ভাবনা প্রচার করছিলেন খাদি প্রচারের মাধ্যমে। স্বরাজের প্রতীক রূপে খাদিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরে, দেশে কাপড়ের উৎপাদনের বিকাশে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ‘খাদি অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ কমিশন’ (কেভিআইসি) গঠিত হয়েছিল। তবু খাদি যেন জনগণের কাছে প্রতীকী হয়ে ওঠে। খাদি বছরের-পর-বছর প্রতিটি দেশপ্রেমিক ভারতীয়ের হৃদয়কে টানলেও তাদের টাকার ব্যাগে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। খাদিকে যেন কখনওসখনও পরিধানের জন্য বাছা হয়েছে। এর বিপ্লবী ডিএনএ কয়েকটি ক্যাম্পাসে বিরাজ করত, লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি এবং ‘ঝোলা নেওয়া’ যুবকদের মধ্যে।
বিশেষত উদারীকরণের পরবর্তী সময়ে জনগণের বিদেশি পণ্যের প্রতি আকর্ষণ খাদিকে প্রায় সমাহিত করে। দরজা খুলে দেওয়ায় অত্যাধুনিক পশ্চিমি পোশাক নিজের শহরের স্টোরে এসে যাওয়ায় এ-দেশের ক্রেতারা রোমাঞ্চিত হল। বিদেশি ব্র্যান্ডের নাগালে এসে অনেকেই তখন আর ‘খাদি’ পরতে চায় না। যদিও এটা পুরোপুরি পণ্যের দোষ নয়, বরং না-পাওয়ার আকাঙক্ষা মেটানোর অভিব্যক্তি।
খাদি বহুমুখী কাপড়ের একটি। পরিধানকারীকে শীতকালে উষ্ণ এবং গ্রীষ্মে শরীরকে শীতল রাখতে সক্ষম। খারাপ-ভাল সময় তো ঘুরে-ফিরে আসে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু বিশৃঙ্খলা (অপ্রত্যাশিত বন্যা, দাবানল, সর্বত্র ক্রমবর্ধমান দূষণ) পরিস্থিতি বদলে দিচ্ছে। প্রতিটি কেনার সিদ্ধান্ত কীভাবে দুনিয়াকে প্রভাবিত করছে– সেও জরুরি উপলব্ধি। উপভোক্তারা ধীরে-ধীরে বুঝতে পারছে একটি ‘সস্তা টি-শার্ট’ পরিবেশের জন্য আসলে কতটা ব্যয়বহুল। এভাবেই খাদি ফের ফিরছে বাজারে। এটি সম্পূর্ণরূপে হাতে তৈরি, এবং এর ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’ নগণ্য। জল-ব্যবহারে সচেতনতা এসেছে। ১ মিটার খাদি কাপড় মাত্র ৩ লিটার জল লাগে, যেখানে ১ মিটার মিলের কাপড়ের জন্য লাগে ৫৫ লিটার। সচেতন ফ্যাশন উপভোক্তারাও পশ্চিমি জামাকাপড়ের বদলে ইদানিং খাদিবস্ত্রকেও গ্রহণ করছে।
‘ভারতীয়’ হওয়াও যেন এখন ফ্যাশনেবল হয়ে উঠেছে। মহিলারা গর্বের সঙ্গে তঁাতের শাড়িগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রদর্শন করে। খাদি এখন সংগ্রহ-চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বড়-বড় পোশাক উৎপাদনকারী সংস্থা ‘খাদি ও গ্রামীণ শিল্প কমিশন’-এর সঙ্গে নতুন ধরনের পণ্যে খাদি ব্যবহার করতে সহযোগিতা করছে। তরুণ এবং বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনাররা খাদিতে তাদের উদ্ভাবনী চেতনা প্রয়োগ করে খাদিকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরছে। কখনও-বা ডিজাইনাররা উদ্যোগী হচ্ছেন খাদি এবং ‘গ্রামীণ শিল্প কমিশন’-কে সঙ্গে নিয়ে জমকালো খাদি শোকেস করতে। রঙের মিশ্রণকে প্রসারিত করে, পশ্চিমি স্টাইলে কাপড় কেটে, তা থেকেও পোশাকের নব রূপ দিয়ে পোশাক তৈরি করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে। যা ইঙ্গিত করে– খাদি আগামী দিনে কাপড় হিসাবে আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের জগতে বড় জায়গা দখল করে নিতে পারে। অর্থাৎ খাদি হয়ে উঠতে পারে ‘ভবিষ্যতের কাপড়’।
স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে রাজনীতিবিদদের ইউনিফর্ম এবং স্বনির্ভরতার প্রতীক ছিল খাদি। সেই খাদি এখন ভারতের ফ্যাশন হাউসের অন্যতম প্রিয় বস্ত্র উপকরণ হয়ে উঠছে। বর্তমানে একটি সমৃদ্ধ, আধুনিক ব্র্যান্ডের সমস্ত প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে দিতে সক্ষম খাদি। ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের চেয়ে অনুপ্রেরণামূলক ব্র্যান্ডের উদ্দেশ্য আর কী হতে পারে? ‘জাতির জনক’-এর চেয়ে মহান ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর আর কোন সংস্থা পেতে পারে? খাদি নতুন প্রজন্মের অনুরাগী তৈরি করছে, এবং বর্তমানে এটি শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ– জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করছে। খাদি ‘ব্র্যান্ড’ তো নিছক গল্প নয়– এটা যেমন ইতিহাস, তেমনই ভবিষ্যৎ-ও।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.