Advertisement
Advertisement

Breaking News

Language and Terminology

ভাষা ও পরিভাষা, ইংরাজির বিকল্প কোথায়?

ইংরাজির ‘বিকল্প’ হয়ে উঠতে পারেনি কোনও আঞ্চলিক ভাষা।

Editorial on Language and terminology
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:February 20, 2025 4:39 pm
  • Updated:February 20, 2025 4:41 pm  

যে-শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনও বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় রাজশেখর বসু তাকেই ‘পরিভাষা’ বলেছেন। সাম্প্রতিকতম জ্ঞানের চর্চায় ইংরাজির ‘বিকল্প’ হয়ে উঠতে পারেনি কোনও আঞ্চলিক ভাষাই। পারেনি যে, তার কারণ যথার্থ পরিভাষার ভীষণ অভাব। ভাষা দিবসের প্রাক্কালে বিশেষ নিবন্ধ। লিখছেন আশিস পাঠক।

“মাছদের কানের ভিতরে কয়েক টুকরা পাথরের মতো জিনিস থাকে। এগুলিকে ‘কর্ণশিলা’ (Statolith) বলা হয়। মোটা কই মাছের মাথার ভিতরে এরকম বড় বড় পাথর পাওয়া যায়। এগুলি মাছদের কি কাজ করে, তাহা ঠিক্ জানা যায় নাই। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, মাছদের কান হইতে ঐ পাথরগুলি বাহির করিলে তাহারা সোজা-সুজি সাঁতার না কাটিয়া যেন টলিতে টলিতে চলে।”

Advertisement

প্রায় ১০০ বছর আগে জগদানন্দ রায় তাঁর ‘মাছ ব্যাঙ সাপ’ বইয়ে লিখেছিলেন। এ-ভাষা এখনও সকলে বুঝতে পারবে। কিন্তু পরিভাষা? খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন ‘স্ট্যাটোলিথ’-এর ওই যে-পরিভাষাটি কোনওরকম দ্বিধা না-করে জগদানন্দ করে দিলেন, তা ওই ধারণাটিকে মাছের কানের মধ্যেই আটকে ফেলল। কিন্তু ‘মূল’ শব্দটিতে এমন কানাকানি ছিল না। কারণ স্ট্যাটোলিথ গাছের থাকে, শামুকেরও থাকে। মূল শব্দটায় সেই ব্যাপ্তিটা ছিল। ‘স্ট্যাটো’ কথাটি ‘স্ট্যাটিক’ বা ভারসাম্য থেকে এসেছে আর ‘লিথ’ এনে দেয় পাথরের অনুষঙ্গ।

জগদানন্দ রায়ের ওই লেখার পরে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা আরও শতবর্ষ পেরিয়েছে। আর তার মোটামুটি শতবর্ষ আগে ভারতে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান পড়ানোর পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন রামমোহন রায়। ১৮২৩ সালে এ বিষয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখছেন গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে। সে-চিঠিতে ইংরাজি ভাষার মাধ্যমেই সেই বিজ্ঞানশিক্ষা দিতে হবে, এমন কথা বলা নেই। বাংলা ভাষার কথা তো নেইই। থাকার কথাও ছিল না। বাংলা গদ্যের সেই শিশু-দশায় আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারণা প্রকাশের প্রশ্নই ওঠে না।

২০০ বছর পেরিয়ে, বাংলা ভাষা যখন ‘ধ্রুপদী’ ভাষার মর্যাদা পেল, তখনও কি তা বিবিধ বিদ্যার যথার্থ চর্চায় সাবালক হল? না। এখনও সাম্প্রতিকতম জ্ঞানের চর্চায় ইংরাজির ‘বিকল্প’ হয়ে উঠতে পারেনি কোনও আঞ্চলিক ভাষাই। পারেনি যে, তার কারণ যথার্থ পরিভাষার ভীষণ অভাব।

‘পরিভাষা’, অর্থাৎ ‘টার্মিনোলজি’। আমরা যখন বাংলা ভাষার কথা বলি, তখন কথ্য বা লেখ্য ভাষা, অর্থাৎ বাকনির্ভর ভাষার কথাই বলি। চিত্রভাষা বা সংগীতের ভাষার কথা বলি না। কিন্তু একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, চিত্রভাষা বা সংগীতের ভাষা যেমন চিহ্ন, প্রতীক, সংকেত ও ইঙ্গিত-নির্ভর, আমাদের কথ্য ভাষাও তা-ই। উচ্চারিত ধ্বনি বা লিখিত অক্ষরের সাহায্যে আমরা পূর্বনির্দিষ্ট কিছু ধারণাকেই সংকেতিত করি।

কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা সাধারণ কথ্য বা লেখ্য ভাষার ক্ষেত্রে খুব নমনীয়। মানুষের ব্যবহারের বহমান ধারায় ভাষা বদলে বদলে যায়। শব্দের অর্থও বদলাতে থাকে। ‘কালি’ বলতে একদা শুধু ‘কালো কালি’ বোঝাত, এখন লাল, নীল, সবুজকেও বোঝায়। শব্দের যে তিনরকম অর্থ– বাচ্যার্থ, লক্ষ্যার্থ ও ব্যঙ্গ্যার্থ– তার নিয়ত পরিবর্তন ঘটতে থাকে চলমান, জীবন্ত ভাষায়।

কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনায় ‘পরিভাষা’-য় ওই পরিবর্তনটা ঘটতে থাকলে চলে না। যে-শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনও বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় রাজশেখর বসু তাকেই ‘পরিভাষা’ বলেছেন। আর এই সুনির্দিষ্টভাবে বলা নিয়েই বাংলা পরিভাষায় যত কাণ্ড!
এবং কাণ্ডজ্ঞান! বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সম্ভাব্যতা নিয়ে যে মনীষীর কথার আশ্রয় আমরা প্রায়ই নিয়ে থাকি, সেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু ক্লাসে ‘আপেক্ষিকতা’ বা ‘relativity’ পড়িয়েছিলেন বাংলাতেই। তাই বলে, তাঁর সরাসরি ছাত্র বিশ্বপ্রিয় মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘তিনি interference, charge, charged প্রভৃতি সব বিদেশী বিশেষ্য বিশেষণকে বাংলা করে বলার চেষ্টা করেন নি, যদিও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকলিত পরিভাষায় এই অনূদিত শব্দগুলি তালিকাভুক্ত হয়েছে আগেই।

তঁার উদ্দেশ্য ছিল এই কঠিন বিষয়টিকে বাঙালি ছাত্রের কাছে সহজে বোধগম্য করা। বস্তুত যে-ছাত্ররা অমিশ্র ইংরাজি বক্তৃতায় কখনো কখনো অসুবিধা বোধ করত, তারা বিদেশী শব্দমিশ্রিত বাংলা বক্তৃতা সহজে বুঝেছিল। পরে কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়ানোর সময় আমারও এই ধরণের অভিজ্ঞতা হয়। ইংরেজি বক্তৃতার মধ্যে মধ্যে ছাত্ররা ব্যাখ্যা চাইত বাংলা বাক্যে (sentence), বাংলা পারিভাষিক শব্দে (terms) নয়। অনূদিত পারিভাষিক শব্দগুলি উটকোভাবে ব্যবহার করলে তাদের অসুবিধাই হত।’

দোষটা কিন্তু পরিভাষার নয়, দুর্বল পরিভাষার। নানা বিদ্যাচর্চায় যাকে সবল করে তোলার দায়িত্বটা ছিল সেসব বিদ্যার বিশিষ্ট বাঙালির। সে-কাজটা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কোনও একটি জীবনের নয়, এবং সে কাজে অহংবোধেরও কোনও জায়গা নেই। কারণ, পরিভাষার মূল কথাটাই হল ‘সর্বজনগ্রাহ্যতা’ বা ‘standardisation’. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পরিভাষা নিয়ে বেশ কিছু কাজ আট-নয় দশক আগে হয়েছে বটে, কিন্তু তাকে সর্বজনমান্যতা দেওয়া যায়নি।

সহজ, প্রচলিত শব্দকে অনেক সময়ই পাণ্ডিত্যের অভিমানে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কৃত শব্দের প্রতি অন্ধ ভক্তি পরিভাষাকে প্রায় অবোধ্য করেছে। বাংলা ভাষায় যেমন খুব সহজে আরবি-ফারসি-ইংরেজি নানা ভাষার শব্দ ঢুকেছে– তেমনই পরিভাষাতেও তা খুব সহজে ঢুকতে পারে। সে-চেষ্টা অবশ্য কেউ-কেউ করেছেন। ‘brain’ ও ‘digestion’-এর পরিভাষা ‘মস্তিষ্ক’ ও ‘পরিপাক’ বা ‘পাচন’ না-করে ‘মগজ’ ও ‘হজম’ বলেছেন। ৫০ বছর আগে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় পরিভাষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন ‘লেইসেজ ফেয়ার’-এর বাংলা করতে চেয়েছিলেন: ‘ছাড়া-গরু নীতি’!

পরিভাষার প্রচলন নিয়ে অবশ্য ছাড়া-গরু নীতি নিলে হবে না। বিষয়ের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক, ভাষাবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক, পড়ুয়াদের প্রতিনিধি– সবাইকে নিয়ে য-পরিভাষা তৈরি হবে তা-ই ব্যবহার করতে হবে সমস্ত পাঠ্যবইয়ে। সে পরিভাষা পরে প্রত্যেকে মিলে বদলালে তখনই তা নতুন করে পাঠ্য বইয়ে ব্যবহার হবে।

ভাষা ধ্রুপদী শুধু স্বীকৃতির জোরে হয় না, তার ব্যবহারের জোরে হয়। সে-ভাষায় মন আর মননের নানা চর্চা হতে থাকলেই তার জোর বাড়ে। উপন্যাসে, ব্যঙ্গরচনায়, আর নানা সমালোচনায় বাংলা ভাষার জোর যিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বহু গুণ সেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’-এর ১৮৮২ সালের একটি সংখ্যায় লিখেছিলেন: ‘দেশটাকে বৈজ্ঞানিক করিতে হইলে যাহাকে তাহাকে যেখানে সেখানে বিজ্ঞানের কথা শুনাইতে হইবে। এইরূপ শুনিতে শুনিতেই জাতির ধাতু পরিবর্তিত হয়। ধাতু পরিবর্তিত হইলেই প্রয়োজনীয় শিক্ষার মূল সুদৃঢ়রূপে স্থাপিত হয়। অতএব বাঙ্গালাকে বৈজ্ঞানিক করিতে হইলে বাঙ্গালীকে বাঙ্গালা ভাষায় বিজ্ঞান শিখাইতে হইবে।’

ব্যবহারিক বাংলার সর্বাত্মক উপযোগিতা বিষয়ে আমাদের নেতিবাচক মনোভাবের ধাতু কবে বদলাবে?

(মতামত নিজস্ব)
লেখক উপ-পরিচালক (প্রকাশনা ও বিক্রয়),
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ
gulgule.ashis@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement