ইজরায়েলের দিকে ড্রোন ও দূর-নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র হানল ইরান। ইজরায়েলও পালটা দিল, তবে পরমাণু চুল্লি রয়েছে এমন কোনও ইরানীয় শহর ক্ষতিগ্রস্ত হল না। নিন্দুকরা বলছে, এ আসলে ‘সাজানো’ যুদ্ধ। কেন এমন চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে? লিখছেন সুমন ভট্টাচার্য।
আল পাচিনো-র ‘স্কারফেস’ অনুকরণে তৈরি অমিতাভ বচ্চনের আইকনিক ছবি ‘অগ্নিপথ’-এর সংলাপে বাবা তার ছেলেকে বলেন যে, ক্ষমতা সেটাকেই বলে, যেটা লোকে আন্দাজ করে, এবং সেই আন্দাজের ফলে সমীহও করে। কিন্তু একবার ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে গেলে, পরে আর কেউ তঁাকে ‘ক্ষমতাশালী’ বলে মনে রাখে না। ‘ক্ষমতা’ ও ‘ক্ষমতাশালী’-র সম্পর্ক-নির্মাণের এই ‘পারসেপশন’-কে কূটনৈতিক পরিসরেও টেনে আনা যায়। যেমন ইরান এবং ইজরায়েলের দ্বন্দ্ব। যুযুধান দু’-পক্ষই কিন্তু একে-অপরকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে মূলত। মানে, হেলমেটে বাউন্সারের চুম্বন অঁাকছে। তার বেশি রণকাতর হচ্ছে না। অভিযোগ, পুরোটাই চিত্রনাট্য অনুসারে।
সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে ইজরায়েলের হামলা, তেহরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কম্যান্ডারদের মৃত্যুতে ইরান পালটা শিক্ষা দেওয়ার শপথ নেয়। ‘সহবৎ’ শেখানোর সেই দায় থেকেই ইজরায়েলের উপরে তিনশোরও বেশি ড্রোন নিক্ষিপ্ত হয়, দূর-নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আক্রমণের চেষ্টাও করা হয়, যা আবার পশ্চিমি মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী– ইজরায়েলের ‘অসামান্য’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে আটকে যায়। কী করে এমন হল, তা নিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় মিম-রসিকতা চলছে। তেহরান কী কৌশলে আক্রমণ করেছিল বা তার আক্রমণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ‘অন্য’ কাউকে জানিয়ে দিয়েছিল কি না, তা নিয়েও রয়েছে অনেক জল্পনা।
আবার, ইরানের হামলার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ইজরায়েল এমন হামলা করল যে শিয়া ‘সুপার পাওয়ার’-এর দেশটিতে পরমাণু চুল্লি রয়েছে সেরকম শহর আক্রান্ত হল বটে, কিন্তু তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হল না! যারা ‘সেটিং’ তত্ত্বে বিশ্বাস করে, তাদের অনুমান, সব-ই ‘চিত্রনাট্য’ অনুযায়ী এগিয়েছে। সাপও মরেছে, লাঠিও ভাঙেনি। অর্থাৎ ইজরায়েল ও ইরান, দু’-দেশের নেতারাই স্বদেশের জনগণকে অগ্নিগর্ভ ভাষণ দিয়ে বোঝাতে পেরেছেন, তঁারা প্রতিপক্ষকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন! এমন ‘সাজানো’ চিত্রনাট্য হয়তো বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর শাসনব্যবস্থায় যুদ্ধ নিয়ে তিতিবিরক্ত ইজরায়েলের জনগণের জন্য যতটা দরকার ছিল, ততটাই জরুরি ছিল ইরানের কট্টরবাদী একনায়কতন্ত্রের জন্য। মনে রাখতে হবে, ইজরায়েল ও তার সহযোগী আমেরিকা, যারা বুক বাজিয়ে গোয়েন্দা-ব্যবস্থা ও ‘এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ নিয়ে বড়াই করে, তারা কিন্তু গত বছরের ৭ অক্টোবরে হামাসের আক্রমণ সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারেনি, ঠেকাতেও পারেনি। এ-ই যদি ইজরায়েলের সামরিক বীরত্বগাথার চাদরের ফুটিফাটা অবস্থা হয়, তাহলে ইরানকেও সম্প্রতি ‘আইএস’-এর (খোরশান) ভয়াবহ আগ্রাসনের শিকার হতে হয়েছে। শতাধিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল।
তাহলে আসল সত্য কী? আসলে, নিজেদের ‘সুপার পাওয়ার’ বলে পরিচয় দিতে অভ্যস্ত ইজরায়েল বা ইরান ভালমতো জানে, তারা ঠিক কোন বালুকাবেলায় দঁাড়িয়ে রয়েছে। আর, সে কারণেই আমেরিকার মদতপুষ্ট ইজরায়েল, অন্যদিকে রাশিয়া এবং চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক অক্ষ তৈরি করা ইরান, কেউ-ই বড় যুদ্ধের ঝক্কি নিতে চায় না। দু’-পক্ষই জানে, এতে দেশের অর্থনীতিতে কতটা চাপ পড়বে। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে যেমন নিজের দেশে কট্টরপন্থী ইহুদিদের সঙ্গে নিয়ে সরকার চালাতে হয়, তেমনই ইরানকেও হিজাব বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন সামলানোর পাশাপাশি বাক্স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার নাগরিকদের সামনে এমন এক শত্রুকে সবসময় টিকিয়ে রাখতে হয়, যার সঙ্গে হামলা ও পালটা হামলার প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
পশ্চিম এশিয়া বিশ্ব রাজনীতির ভিসুভিয়াস, কখন আগ্নেয়গিরি ফেটে লাভার উদ্গিরণ সবকিছু ভাসিয়ে দেবে, বোঝা দায়! মজা হচ্ছে, রাজনীতির এই চিত্রনাট্যের রচয়িতা বা পরিচালক কিন্তু শুধুমাত্র পশ্চিম এশিয়া নয়।
সে-চিত্রনাট্যে ওয়াশিংটন আছে, মস্কো আছে, বেজিংও আছে। কেউ ‘মেন্টর’ হয়ে। কেউ গুরুত্বপূর্ণ ‘ক্যামিও’ চরিত্রে। এই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘অপরাধী’ হিসাবে সাজা পেয়ে নির্বাচন থেকে ছিটকে যাবেন কি না তা নিয়ে যতটা চর্চা হচ্ছে, ততটাই মার্কিন সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোড়িত করছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালেস্তাইনের সমর্থনে চলতে থাকা বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভ ফ্রান্সের সবচেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। শ্বেতাঙ্গ সমাজ মানেই ইহুদিদের বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ‘জিওনিস্ট’ দর্শনের সমর্থক, প্রচলিত সে-ধারণাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার নবীন প্রজন্ম। গাজাতে ইজরায়েলের চালিয়ে যাওয়া ‘গণহত্যা’ যে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা অস্ট্রেলিয়াকেও এইভাবে সামাজিক বিভাজন এবং আদর্শগত লড়াইয়ের মুখোমুখি ফেলে দেবে তা কেই-বা জানত! পশ্চিমের দেশগুলি, যারা স্বভাবগতভাবে অশ্বেতাঙ্গদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তারাও স্বীকার করে নিচ্ছে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরে সারা বিশ্ব আর কখনও এইরকম ছাত্র আন্দোলন বা প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখেনি।
যদি গাজা ও ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আমেরিকার ছাত্রসমাজকে এইভাবে রাস্তায় নিয়ে আসতে পারে, তাহলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কোন ভরসায় ইজরায়েলকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে উৎসাহ দেবেন? ভোটমুখী আমেরিকায় ডেমোক্র্যাটদের মন ও মতামত যেরকম ঘূর্ণি পিচের মতো ক্ষণে-ক্ষণে বদলাচ্ছে, সেখানে ওয়াশিংটন কতটাই বা পশ্চিম এশিয়ায় আগ্রাসী মনোভাব নিতে পারবে? একইরকমভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে চাওয়া বেজিং কেনই-বা চাইবে পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধের অনিশ্চিত বাতাবরণ সৃজিত হোক, কারণ তাহলে তেলের দাম বাড়বে, আর তেলের দাম বাড়লে চিনেরও রক্তচাপ বাড়ে।
অতএব, ইজরায়েল ও ইরান বদলা নেওয়ার বক্তৃতা দেবে, এমন হামলার কথাও বলবে যাতে আসলে ক্ষয়ক্ষতি হবে না। ক্ষমতাশালী হয়ে থাকার নির্মাণ যত জরুরি, তা ধরে রাখাও ততখানি গুরুত্বপূর্ণ।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.