গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক আমার বন্ধু। লেখাপড়ায় ভাল, ডিবেটেও ভাল। আর, গানের গলার তো কোনও তুলনা হয় না। আমাদের স্কুলের সমস্ত অনুষ্ঠানে গায়ত্রী গান করত। মনে আছে– একবার গায়ত্রী গান করল, সঙ্গে শর্মিলা ঠাকুর নেচেছিল। গায়ত্রীর ‘হলবার্গ’ সম্মানপ্রাপ্তিতে আমি গর্বিত, আনন্দে আটখানা। লিখছেন সুপ্রিয়া রায়।
“সেন্ট জন্’স ডায়োসেশন গার্লস’ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল”-এ আমি আর গায়ত্রী একসঙ্গে পড়েছি। কেতকী কুশারী ডাইসন, শর্মিলা ঠাকুর– ডায়োসেশনে তখন আগামী দিনের নক্ষত্র। আমি আর গায়ত্রী– দু’জনেই প্রিন্সিপাল চারু দাসের স্নেহধন্যা ছিলাম। গায়ত্রীর সঙ্গে আমার বরাবরই খুব ভাব ছিল। ও প্রাথমিকভাবে আমার থেকে এক ক্লাস সিনিয়র ছিল। তবে ও পড়াশোনায় এতটাই ভাল ছিল যে, ডাব্ল প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে আমাদের থেকে অনেক ‘সিনিয়র’ হয়ে গেল। প্রথমেই তো আমার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে ছিল, ডাব্ল প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে অনেক ক্লাস উঁচু হয়ে গেল, তা’বলে আমি কখনও ‘গায়ত্রীদি’ বলিনি। ও প্রায় সব সাবজেক্টে ‘প্রথম’ হত।
ইন্টার-স্কুল ডিবেট হত তখন অনেক। বলা বাহুল্য, গায়ত্রী ডিবেটেও সবসময় ফার্স্ট প্রাইজ আনত। প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতকজীবন কেটেছে আমাদের– আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গায়ত্রী ইংরেজি। তবে সেখানেও গায়ত্রী সিনিয়র ছিল আমার। কলেজেও সবসময় প্রথম হত। বিএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তারপর হঠাৎ একদিন আমাকে বলল, স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছি।
তা, পরে একবার আমেরিকায় গিয়েছি। হঠাৎ নিউ ইয়র্কের রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা। ও কিন্তু বরাবর শাড়ি পরত। আমি শাড়ি ছাড়া ওকে কখনও কোথাও কিছু পরতে দেখিনি। আমেরিকাতেও ওকে শাড়িতেই আবিষ্কার করলাম। বলল, ‘সুপ্রিয়া, হাতে বেশি সময় নেই। এরপর ক্লাস আছে। এখানে দোকানে কতগুলো কাজও আছে। তুমি আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকো।’
৪৫ মিনিট একসঙ্গে কাটিয়ে ছিলাম আমরা সেদিন। সেই ৪৫ মিনিটের কথা আমি লিখে রেখেছি। ওই সময়পর্বে, আমার সঙ্গে গায়ত্রী গল্প করল পুরো বাংলায়– স্কুলের গল্প, কলেজের গল্প, পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ। একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেনি, সচেতনভাবে। খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। অভিভূতও।
প্রসঙ্গত, ও যখন বিদেশে ছাত্রী, ‘নিউজউইক’-এর কভারে ওর একটা ছবি বেরয়, অন্য দেশের পড়ুয়াদের সঙ্গে শাড়ি পরিহিতা গায়ত্রী চক্রবর্তী। সেই সংখ্যাটি ছিল ‘ফরেন স্টুডেন্টস: ডিপ্লোমা অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি’ নিয়ে। বাংলার প্রতি টান, শাড়ির প্রতি ভালবাসা
ছাড়াও দেশের আরও একটা শিকড়ের সঙ্গে নিজেকে ওতপ্রোত জড়িয়ে রেখেছিল। তা হল গান। অসম্ভব ভালো গান গাইত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, শ্যামাসঙ্গীত– কী না জানত! বিদেশি গানেও অসম্ভব পারদর্শী ছিল। ওর গায়কি এবং গানের কোনও তুলনা হয় না। আমাদের স্কুলের সমস্ত অনুষ্ঠানে ও গান করত। একবার ও গান করল, সঙ্গে শর্মিলা (ঠাকুর) নেচেছিল। শুনেছি, (এটা শোনা কথা-ই, আমি ভুলও হতে পারি) লখনউয়ের ভাতখণ্ডে সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ডিপ্লোমাও ছিল গায়ত্রীর।
ওর দেশের প্রতি টান, চেনা মানুষের প্রতি আন্তরিকতা, তার একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ
করি। আমার মেয়ে অনন্যা রায় , বার্কলে-তে পড়াত, বর্তমানে ‘ইউসিএলএ’-তে অধ্যাপনারত, একবার গায়ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে লেকচার দেওয়ার সুযোগ পায়। ও খালি একবার গিয়ে বলেছিল– আমি সুপ্রিয়া রায়ের মেয়ে, একঘর ভর্তি মানুষের সামনে ওকে জড়িয়ে সে কী আদর! এটা বলছি ওর দেশের প্রতি কতটা টান বোঝাতে। আমার স্বামী, আশীষ রায়, মারা যাওয়ার সময়ও স্মৃতি রোমন্থন করে ই-মেল পাঠায়। অত ব্যস্ততার মাঝেও এসব ভুল হত না।
এ-ই হল গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, আমাদের গায়ত্রী– বিশ্বের যতটা, ততটা এ মাটিরও।
আমাদের স্কুলের সেই বন্ধু আজ বিশ্ববন্দিত। গর্বে আমার মাটিতে পা পড়ছে না।
লেখক প্রাক্তন শিক্ষিকা, মর্ডান হাই স্কুল
supriyaliterature@gmail.com
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.