Advertisement
Advertisement

Breaking News

Pratul Mukhopadhya

প্রয়াত ‘গানমানুষ’, পৃথিবী প্রস্তুত ছিল ওঁকে পিঠে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য

সেই সুরে, বাচনে, অঙ্গভঙ্গিতে, শরীরী ভাষায় আর কেউ গাইবেন কি না, জানি না।

Editorial on Folk Singer Pratul Mukhopadhya
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:February 17, 2025 5:30 pm
  • Updated:February 17, 2025 5:32 pm  

চলে গেলেন ‘গানমানুষ’– প্রতুল মুখোপাধ্যায়। গানের নতুন যে-ঘরানা তৈরি করেছিলেন– সেই সুরে, বাচনে, অঙ্গভঙ্গিতে, শরীরী ভাষায় আর কেউ গাইবেন কি না, জানি না। ওঁর তো কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট ছিল না। নিজেই নিজের ইনস্ট্রুমেন্ট ছিলেন। লিখছেন রাহুল পুরকায়স্থ।

প্রতুল মুখোপাধ‌্যায়ের শবযাত্রা যখন টিভিতে দেখছি, মনে হচ্ছিল– এত কম লোক! এত ছোট জমায়েত! উনি যেভাবে মাঠের মানুষ, পথের মানুষের পাশে পাশে, মিছিলের মানুষের পায়ে পায়ে গোটা বাংলা তোলপাড় করেছিলেন, ওঁর গান দিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন, মনে হয়েছিল, হাজার-হাজার লোক, প্রতুলদার গান গাইতে-গাইতে ওঁর মরদেহ নিয়ে যাবে। সেটা হল না। আশাহত হলাম! সারাক্ষণ শুনে গেলাম ওঁর গলায় বাজছে– ‘আমি বাংলায় গান গাই’। শুনে মনে হচ্ছিল যে, ‘বাংলার গান গাই’-এর প্রতুল মুখোপাধ‌্যায় চলে গেলেন। একদিকে হয়তো ভালই হল যে, থেকে গেলেন সে-ই প্রতুল মুখোপাধ‌্যায় যিনি আবহমান গণসংগীতের এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, রয়ে গেলেন সেই প্রতুল মুখোপাধ‌্যায় যিনি মাঠে-ঘাটে গেয়ে বেড়াতেন ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’ কিংবা ‘লড়াই করো লড়াই করো লড়াই/ যতদিন না বিজয়ী হও।’

Advertisement

এটা কেন হল না জানি না। প্রতুলদা নিজস্ব শিবির ত‌্যাগ করেছিলেন বলে ‘শিবিরত‌্যাগী’ মানুষের শেষযাত্রায় থাকব না– এই মানসিকতা থেকে কি? এত কিছু ভাবতে মন চাইছে না। শুধু এটুকু বলতে পারি, প্রতুলদার মৃতু‌্যর সঙ্গে-সঙ্গে বাংলা গানের একটা ঘরানার মৃতু‌্য হল।
ওঁর গান প্রথম আমি শুনি, ১৯৯৫ সালে। ১১ জুলাই কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ‌্যায় মারা যান। ১২ জুলাই তঁার মরদেহ নিয়ে একটা শবযাত্রা বেরয়– ঢাকুরিয়া থেকে কেওড়াতলা শ্মশান পর্যন্ত। সেই শোভাযাত্রায় গান গাইছে অগণিত মানুষ, কবিতা পড়ছে। দেশপ্রিয় পার্ক থেকে কেওড়াতলা শ্মশান পর্যন্ত গাছে-গাছে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন এবং ছবি। সেই মিছিলেই প্রথম প্রতুলদার গান শুনি। তার কিছু দিন পরে বিরাট স্মরণসভা হয়, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল-এ। হল ছাড়িয়ে রাস্তা পর্যন্ত লোক উপচে পড়েছিল মনে পড়ে। সেখানে প্রতুলদা গেয়েছিলেন, কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ‌্যায়কে উদ্দেশ‌ করে লেখা, ‘ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ে/ আষাঢ়ের একদিনে/ শ্মশানের আগুন রে ভাই/ আগুন নিল চিনে…’। অসাধারণ গান!
বলা যায়, সেই সময় গান শোনার পর থেকেই আমি ব‌্যক্তিগতভাবে প্রতুলদার গানের প্রেমে পড়ি।

‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ‌্যায় স্মরণ কমিটি’-র সদস‌্য ছিলাম। উনিও সেখানে আসতেন। গান গাইতেন। উনি থাকতেন উল্টোডাঙা। আমি বেলঘরিয়া। এক রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতাম। আমাদের মধে‌্য যোগাযোগ তৈরি হয় আস্তে-আস্তে। তখন আমাদের গুটিকয় মানুষের মধে‌্য ওঁর জনপ্রিয়তা সীমাবদ্ধ ছিল। অনেকেই জানত না যে, ‘প্রতুল মুখোপাধ‌্যায়’ বলে কেউ আছেন, তিনি গান করেন। এবং গান গেয়ে জনতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেন। তাদের রক্তে জাগিয়ে তোলেন প্রতিবাদের আগুন। ওঁর খবর শুধু জানত ‘তৃতীয় শিবির’-এর লোকজন। অবশ‌্য এ-ও বলা যায় যে নকশাল আন্দোলনই জন্ম দিয়েছিল ‘প্রতুল মুখোপাধ‌্যায়’-এর। তবে পরিচিতি দেয়নি। প্রতুলদা তাহলে বিখ‌্যাত হলেন কখন? সুমনদা (কবীর সুমন) যখন গান লিখলেন, ‘লোকটা নিজেই একটা আস্ত গান’– তখন। সুমনদা গান বাঁধায় খুব খুশি হয়েছিলেন। ‘সুমনই তো আমাকে প্রথম চেনাল!’

এসব বলতেন। একদিকে প্রতুলদা, অন‌্যদিকে সুমনদা, সে-সময় বাংলা গানের জগতে একটা বেশ অন‌্যরকম পরিবেশ তৈরি হল। প্রতুল মুখোপাধ‌্যায় বাংলা কবিতায় নতুনভাবে সুরারোপ করলেন। সেই সুরারোপ লোকের মুখে-মুখে ঘুরত। সমীর রায়, রঞ্জিত গুপ্ত, অরুণ মিত্র, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ‌্যায়ের কবিতার গানে সুর দিয়েছেন চুটিয়ে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ‌্যায়ের তো অজস্র কবিতায় উনি সুরারোপ করেছেন। গুনে শেষ করা যাবে না। এছাড়া অরুণ মিত্রর গদ‌্যকবিতা– সেখানেও যে সুর বসতে পারে, আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না– উনি সুর দেওয়ার আগে! ‘আমি এত বয়সে গাছকে বলছি/ তোমার ভাঙা ডালে সূর্য বসাও’– এসব গদ‌্যকবিতায় প্রতুলদার দেওয়া সুর, আহা! লুই আরাগঁর কবিতায় সুর দিয়েছিলেন, সুর দিয়েছিলেন মিরোস্লাভ হোলুবের কবিতায়। এসব কবিতায় যে অমন সুর দেওয়া যায়, অকল্পনীয়!

প্রতুলদার প্রথম দিকের অধিকাংশ গান মাও জে দংয়ের বিভিন্ন বক্তৃতার অংশ। ‘রেড বুক’-এ পরবর্তীতে যে-যে প্রবন্ধ এসেছিল, সেসব থেকে সূত্র নিয়ে উনি গান তৈরি করতেন। সে আন্দোলনেও ওঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। পথে-প্রান্তরে-মাঠে-ঘাটে বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতেন।
ওঁর গান শুধু শোনার ছিল না, ছিল দেখারও। এককথায় বলতে গেলে, ‘অডিও-ভিজু‌্যয়াল পারফরম্যান্স’। কবিতায় সুরারোপের পাশাপাশি নিজেও গান লিখতেন, কবিতা ও ছড়া লিখতেন। অবশ‌্য সে সমস্তই ওঁর গান হয়ে যেত।

বেশ কিছু নাটকেও ওঁর লেখা, সুর দেওয়া গান আছে। যেমন, ‘কালিন্দী’। গানের বিরাট জগৎ তৈরি করলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাসদের মতোই গণগীতির একটা নিজস্ব জগৎ, বা বলা ভাল, গণগীতির এক্সটেন্ডেড রূপ। সেসব গান একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এমনও হয়েছে– ধরুন চম্পাহাটিতে, আমাদের বন্ধু কবি রত্নাংশু বর্গী, এখনও আছেন, তাঁরা একটা অনুষ্ঠান করেছেন। সে অনুষ্ঠানে মাঠের মধ্যে গানটান হচ্ছে। অনেক রাত। প্রায় শেষ ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে। প্রতুলদা বলছেন– এটা শেষ গান। এরপর আর ট্রেন পাব না। হঠাৎ চিৎকার পিছন থেকে! একজন রিকশাচালকের গলা। উনি চিৎকার করে বলেন, ‘প্রতুলদা, আমি পৃথিবী আছি। আপনাকে পিঠে করে পৌঁছে দেব।’ বস্তুত পৃথিবীর পিঠে চড়েই প্রতুলদা গান গেয়ে বেরিয়েছেন, পৃথিবী, মেহনতি মানুষের পৃথিবী– যে পৃথিবী তাঁকে মাথায় তুলে রেখেছিল, বুকে আগলে রেখেছিল। সেই পৃথিবীর মানুষগুলো হয়তো তাঁরা শেষযাত্রার মিছিলে ছিলেন না। হয়তো-বা ছিলেনও। কারণ প্রতুলদা যা-ই করুন, যে রাজনীতিই করুন, ওঁর গানগুলো তো রয়েই গেল সেই মানুষগুলোর জন‌্য।

মাস ছয়েক আগে কথা হয়। দুঃখ করতেন যে, পুরনো বন্ধুরা আর আমার কাছে আসে না। আবার এ-ও বলতেন, আমি কিন্তু কমিউনিস্টই আছি। মার্কসবাদে বিশ্বাস করি। এটাও বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়ই কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট। কিন্তু এই বিশ্বাস-প্রতিবিশ্বাস ছাড়িয়ে আসলে গানগুলো রয়ে গেল। বলা ভাল ‘মানুষের গানগুলো’ রয়ে গেল। খেতমজুর, রাস্তা সারাই করা মানুষ, ছাদ পিটানো শ্রমিক শ্রেণির গান রয়ে গেল।

প্রতুলদার গানের অন‌্যতম বৈশিষ্ট‌্য ছিল– গানের মধে‌্য থাকা গল্প। ‘আমি বাংলায় গান গাই’-ই ধরুন। ওঁর জনপ্রিয়তম গান। এই গানের গায়ক প্রতুল মুখোপাধ‌্যায় যেমন সত‌্য, তেমন ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি/ সেদিন সুদূর নয় আর’-এর প্রতুল মুখোপাধ‌্যায়ও সত‌্য। এই দুটোর মধ্যে কোনও বিরোধ আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না। ‘বিরোধ’ হচ্ছে সেখানেই– যেখানে তঁাকে শুধু ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর গায়ক হিসাবে আপামর বাঙালির সামনে তুলে ধরা হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহলে ওঁর গান বাজবে কাদের কাছে? আমার মনে হয়– বাজবে, অনেকের কাছেই বাজবে। যে-মাটি উনি তৈরি করেছিলেন, এবং যার জন‌্য প্রতুল মুখোপাধ‌্যায় ‘প্রতুল মুখোপাধ‌্যায়’ বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন, তাদের কাছে।

ওঁর প্রথম রেকর্ড। নাম ছিল ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’। সেটা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ‌্যায় স্মরণসভা থেকেই উদ্যোগ নিয়ে করা হয়েছিল। বিপুল চক্রবর্তী, অনুশ্রী চক্রবর্তী, অমিত রায়, কেয়া চট্টোপাধ‌্যায়, মৌসুমী ভৌমিক– এঁরা ছিলেন। ওখানকার বেশিরভাগ গানই ছিল প্রতুলদার। অ‌্যারেঞ্জ করেছিলেন বিখ‌্যাত শিল্পী দীপক চৌধুরী। ১৯৯৬-’৯৭ এর কথা বলছি। প্রতুলদা তার আগে কখনও রেকর্ডিং করেননি। উনি অফিসে বলে গিয়েছেন, এ-ই এক ঘণ্টা ঘুরে আসছি। ওঁর তো ধারণাই ছিল না যে এত সময় লাগে! বেহালার এক স্টুডিওয়ে রেকর্ডিং হয়। ওঁর গান গান তো গান ছিল না। গানের সঙ্গে হাত-পা সঞ্চালন ছাড়াও ছিল বিভিন্ন নৃত‌্যভঙ্গি। তো ওখানে এসব কিছুই করতে পারছেন না। করতে গেলেই ওঁর মুখ মাইক্রোফোন থেকে সরে যাচ্ছে। তারপর সেই চারটে চেয়ারের মাঝখানে আটকে রেখে ওঁকে দিয়ে রেকর্ডিং করানো হল। অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা! গানগুলোও, বলা বাহুল‌্য, অসাধারণ। সে-সময় খুব হিট হয়েছিল। ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’ তখন মধ‌্যবিত্তর ড্রয়িং রুমে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতুলদা যে-গান গাইতে আরম্ভ করলেন, তা ‘গণসংগীত’-ই আমি বলব।

তৃতীয় শিবির, নকশাল আন্দোলন অনুপ্রাণিত তো ছিলই, তারপর সেই গান ছড়িয়ে পড়ল জেলের ভিতরেও। সেই সময় অনেক বন্দিই জানত না এই গানগুলি কার লেখা, কার সুর, কার গাওয়া। প্রতুলদার ভাই আবীর চট্টোপা‌ধ‌্যায়, তিনিও জেলে বন্দি ছিলেন। গান লিখতেন। সাতের দশকের গোটা সময়পর্বটা উজ্জীবিত হয়েছে প্রতুলদার গানে। ওঁর গণসংগীতের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল আন্দোলনে। আমি মনে করি, যত দিন মানুষের আন্দোলন থাকবে, ততদিন প্রতুলদার গান থাকবে। এবং দ্বিতীয় কোনও ‘প্রতুলদা’-র আর জন্ম হবে না। ওঁর তো কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট ছিল না। নিজেই নিজের ইনস্ট্রুমেন্ট ছিলেন। সেই বাদ‌্যযন্ত্র আমরা হারালাম।
গানের মানুষ তো হারালামই, গানমানুষকেও।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement