‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম সূচক’-এর তালিকায় ভারতের স্থান দশম। বিলিয়নেয়রের তালিকাতেও ভারত বিশ্বের প্রথম সারিতে। সৌজন্য: ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বাড়বাড়ন্ত। লিখছেন গৌতম সরকার।
কোনও এক প্রজন্মের কক্ষপথ কী হবে, তা বহুলাংশে নির্ভর করে উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপর। সেই নিয়ম মেনে ধনীর সন্তান আরও ধনী হয়, আর দরিদ্রর সন্তান দরিদ্রতর। সম্প্রতি “ইনকাম অ্যান্ড ওয়েলথ্ ইনইকুয়ালিটি ইন ইন্ডিয়া, ১৯২২-’২৩, দ্য রাইজ অফ দ্য বিলিওনেয়ার রাজ” শীর্ষক প্রতিবেদনে ভারতের আয় ও সম্পদের বৈষম্যমূলক ভাগাভাগির হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।
এই সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০২২-’২৩ সালে দেশের বিত্তশালী ১ শতাংশর হাতে কুক্ষিগত হয়েছে মোট উপার্জনের
২২.৬ শতাংশ, এবং মোট সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। ১৯৫১ সালে জাতীয় আয়ে ধনীতম ১ শতাংশর শেয়ার ছিল ১১.৫ শতাংশ, আটের দশকে যা ছিল ৬ শতাংশরও কম। শীর্ষস্থানীয় ১০ শতাংশের শেয়ার ১৯৫১ সালে জাতীয় আয়ের ৩৬.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-এ ৫৭.৭ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৫১ সালে নিচের
৫০ শতাংশর উপার্জন ছিল জাতীয় আয়ের ২০.৬ শতাংশ, যা ২০২২ সালের হিসাবে কমে হয়েছে ১৫ শতাংশ। মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশের জাতীয় আয়ে যোগদান ১৯৫১ সালের ৪২.৮ শতাংশ থেকে কমে ২০২২-এ দঁাড়িয়েছে মাত্র ২৭.৩ শতাংশে। এই তথ্য থেকে প্রমাণিত– ধনীদের আর্থিক কৌলিন্য ক্রমবর্ধমান, আর দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের আয় টাকার অঙ্কে বাড়লেও তার শ্লথ গতি ক্রমশ ধনী-দরিদ্রের আর্থিক বৈষম্য বাড়িয়ে পাহাড় ছুঁয়ে ফেলেছে।
লোকসভা ভোটের আবহে প্রকাশিত এই তথ্য নিয়ে রাজনৈতিক মহল সোচ্চার হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী বন্ড ইস্যু নিয়ে সারা দেশ তোলপাড় হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এই বন্ডকে ‘অসাংবিধানিক’ সাব্যস্ত করে বাতিল করে দিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, মোদি সরকার দেশে ‘বিলিয়নেয়র রাজ’ লালনপালনের ব্রত নিয়েছে।
উপরোক্ত রিপোর্ট জানাচ্ছে, এই অসমতার উত্থান বিশেষ করে ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ঘটেছে। বিরোধীরা সরব হয়েছে, এর জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত নীতিগুলিই মূলত দায়ী। তাদের মতে, সরকারের তিনটি নির্দিষ্ট পলিসি এই অসাম্যকে ত্বরান্বিত করছে। সেগুলি হল– ধনীর সমৃদ্ধি, দরিদ্রের বঞ্চনা ও তথ্য গোপন। সরকারের পক্ষে ‘নীতি আয়োগ কমিটি’ তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, ভারতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য শতাংশর হিসাবে ২০১৩-’১৪ সালে ২৯.১৭ থেকে কমে ২০২২-’২৩-এ হয়েছে ১১.২৮।
প্রশ্ন, এই চরম বৈষম্যের আবহে আমাদের দেশে সার্বিক দারিদ্র্য ও ক্ষুধার মাত্রা কি আদৌ কমেছে?
অর্থনীতিবিদদের একাংশের আশঙ্কা, ভারতীয় অর্থনীতি আস্তে আস্তে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এ আক্রান্ত হচ্ছে, যেখানে ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের একটা অসাংবিধানিক অঁাতাত তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এদের নির্দেশেই সরকার চালিত হবে। কারণ ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, ‘চন্দা দো ধন্দা লো’।
অর্থনীতিবিদ সুনেত্রা ঘটক বলেছেন, বিষয়টির সম্যক ধারণার জন্য আটের দশকে ফিরে যেতে হবে। সে-সময় কংগ্রেস জমানায় অন্যান্য রাজনৈতিক দল আস্তে-আস্তে মাথাচাড়া দিচ্ছে। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার কারণে রাজনৈতিক কাজকর্ম ও প্রচারের জন্য অর্থব্যয় জরুরি হয়ে পড়ে। তখন থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়তে শুরু করে। ধীরে ধীরে পরিবেশ বদলাতে থাকে এবং ব্যবসার জগতে এই বিশ্বাস জন্মায়, কিছু অর্থ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কিছু সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তিনি আরও বলেছেন, ‘গ্লোবালাইজেশন ও মার্কেট ওপেননেসের যে সুবিধা সমস্ত দেশবাসীর পাওয়ার কথা ছিল, সেই সুবিধার ফল মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষমতাশালী মানুষের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।’
হিসাব বলছে, গত ২৫ বছরে বিশ্বব্যাপী ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের সম্পদ ৩১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বৈশ্বিক জিডিপি-র ১ শতাংশ) থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৩ ট্রিলিয়নে পৌঁছেছে (বৈশ্বিক জিডিপি-র ৩ শতাংশ)। এই বর্ধিত সম্পদের ৬০ শতাংশের বেশি এসেছে আমেরিকা, চিন, রাশিয়া এবং ভারত থেকে। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের রমরমা লক্ষ্য করে ৪৩টি দেশের মধ্যে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম সূচক’ মাপা হয়েছে, সেই তালিকায় ভারত অনেকটাই উপরে, দশম স্থানে। চিন (২১তম), আমেরিকা (২৬তম),
জাপান (৩৬তম), জার্মানি (৩৭তম)।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অাশঙ্কা প্রকাশ করেছে এই মর্মে যে, ভারতের গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক কাঠামো ক্রমাগত ক্ষয়ের মুখে পড়ছে। যার জন্য ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বাড়বাড়ন্ত অনেকটা দায়ী। বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ, এই প্রবণতা দেশের শাসনব্যবস্থাকে আস্তে আস্তে প্লুটোক্রেসির দিকে ঠেলে দেবে। প্লুটোক্রেসি এমন এক শাসন ব্যবস্থা যেখানে দেশের শাসনভার চলে যাবে সবচেয়ে অর্থবান এবং ক্ষমতাবান মানুষদের দখলে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, ভারত হল পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক বিলিয়নেয়রের চারণভূমি। এই মুহূর্তে ভারতে বিলিয়নেয়রের সংখ্যা ১৬৯। আমাদের আগে রয়েছে আমেরিকা (৭৩৫ বিলিয়নেয়র) এবং চিন
(৫৬২ বিলিয়নেয়র)। নিম্ন-মধ্য আয়ের একটা উন্নয়নশীল দেশ হলেও বিলিয়নেয়রের হিসাবে ভারত বিশ্বের প্রথম সারিতে। পিছনে ফেলে দিয়েছে কানাডা, ব্রিটেন, সুইৎজারল্যান্ড, জাপান, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াকে। এই তথ্যগুলো থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় দেশের জাতীয় সম্পদ কীভাবে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে।
ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের সমীক্ষা-ই একমাত্র নয়, এর আগে বেসরকারি সংস্থা ‘অক্সফ্যাম’-ও বৈষম্যের এই চিত্র সামনে আনো। কিন্তু সরকারি তরফে সেসব তথ্য অস্বীকার করা হয়েছে। অস্বীকার করতেই হত, তা না-হলে মোদিজির ভবিষ্যতের রোডম্যাপ, ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ জোরদার ধাক্কা খেত। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এই প্রকল্পের হাত ধরে ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারত ‘উন্নত দেশ’-এর তকমা পাবে। সমগ্র দেশবাসীকে
তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে শামিল করবেন। এখন লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে এই ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে, বলাই বাহুল্য।
সরকারের তরফে নীতি আয়োগের সাবেক কর্তা জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে মধ্যবিত্ত মানুষের যথেষ্ট অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। সেক্ষেত্রে বৈষম্য কমার কথা। এছাড়াও তিনি জানিয়েছেন, শুধু বিজেপি সরকারই নয়, সমস্ত সরকার নয়ের দশকে থেকে দারিদ্র্য-বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করায় দারিদ্র্য সীমারেখার নিচে থাকা বহু মানুষ উপরে উঠে এসেছে। বিজেপি এটাও দাবি করেছে, এই ১ শতাংশ ধনী মানুষদের সাফল্য অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে! দেশের সম্পদ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
যদিও এই সমস্ত দাবি বিরোধী, অর্থনীতিবিদ এবং বিদ্বজ্জনদের সেভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। তঁাদের সম্মিলিত মত, দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হওয়ার আগে এই বৈষম্যের আশু সমাধান জরুরি। তার জন্য সরকারকে চলতি কর-কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য সংস্কার ঘটাতে হবে। সেক্ষেত্রে বিত্তশালী ব্যক্তিদের সম্পদের বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। বিত্ত কর, উত্তরাধিকার কর, এবং অতিরিক্ত কর ধার্য করতে হবে। সেই সমস্ত কর উদ্ভূত রাজস্ব যাতে সঠিক ক্ষেত্রে পুর্নবণ্টন ঘটে সেদিকেও দৃষ্টি রাখা জরুরি।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক যোগমায়া দেবী কলেজের
অর্থনীতির অধ্যাপক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.