ঈশ্বরদত্ত প্রতিভার অধিকারী। নির্দিষ্ট স্ট্রোক পরিষ্কারভাবে পড়ত কাগজে। যেন অবয়বটা আগে থেকেই আঁকা আছে। ছিল অনবদ্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, নিমিষে ধরতে পারতেন শারীরিক গঠন, অঙ্গভঙ্গি। তাই অল্প আয়াসেই ফুটে উঠত ইন্দিরা গান্ধী থেকে জ্যোতি বসুর মুখচ্ছবি। তিনি চণ্ডী লাহিড়ী। ক্ষণজন্মা কার্টুনিস্ট। ১৩ মার্চ ছিল তাঁর জন্মদিন। লিখছেন অগ্নিভ চক্রবর্তী।
এক শিকারি জঙ্গলে গিয়েছিল। ঠিক যখন বন্দুক বাগিয়ে বসেছে, শুনল এক অদ্ভুত আওয়াজ। চমকে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে– একটি বুনো ষাঁড় রাগে গরগর করতে-করতে, নাক-মুখ দিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের মতো বাতাস ছাড়তে-ছাড়তে, শিং বাগিয়ে তেড়ে আসছে তার দিকে। ভয়ে দিশাহারা হয়ে জঙ্গল ভেদ করে দৌড় লাগাল শিকারি। পিছু-পিছু ছুটতে থাকল ষাঁড়টাও। শেষমেশ শিকারি প্রাণ বাঁচাতে উঠে পড়ল গাছে। ষাঁড়টাও এসে আছড়ে পড়ল গাছটার গোড়ায়। থরথর করতে লাগল গাছ, আর সেই গাছের মাথায় ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল শিকারি।
দেখতে-দেখতে সন্ধে হয়ে এল। চাঁদের আলোয় থইথই হয়ে গেল অরণ্য। ততক্ষণে ষাঁড়টাও চলে গিয়েছে। আস্তে-আস্তে নেমে এল শিকারি। কিন্তু এ কোথায় এসে পৌঁছল সে! এ তো অন্য রাজত্ব! এক পা, এক পা করে গাছের তলা ছেড়ে এগিয়ে এল সে। আশ্চর্য এক অন্য পৃথিবীতে এসে পড়েছে। উলটোরাজার দেশ। এ যেন অরণ্যদেবের স্বর্গদ্বীপ! খাদ্য-খাদক সম্পর্ক যাদের, তারা এখানে মিলেমিশে থাকে। নাচে-গায়, গায়ে-গা লাগিয়ে দিন কাটায়। বারবারই শিকারিকে চোখ কচলাতে হয়। যা দেখছি, তা সত্যি তো!
হঠাৎ তার কানে এল বাঁশির শব্দ। তাকিয়ে দেখে এক সাপিনীর পিঠের উপর বসে ঠোঁটে একটা ফুল বাগিয়ে প্রাণ খুলে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে একটা ব্যাং, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে চলেছে সেই সাপিনী। রেশ কাটতে-না-কাটতেই আর এক ছবি। চাঁদের আলোয় বাঘিনির নাচ। দোহার জুটেছে বাঘ আর ছাগল। বাঘ তবলা বাজাচ্ছে, আর ছাগল বেহালা, ছড় একটা শুকনো গাছের ডাল। খরগোশ, বানর, কাঠবিড়ালি এমন ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা– সব এক জায়গায় হয়েছে। কিন্তু শিকারি মানুষ। তার মধ্যে থেকে হিংসা-দ্বেষ মুছে যায়নি। এমন স্বর্গদৃশ্য দেখেও তার হাত বন্দুকের দিকে চলে যায়। কিন্তু হলে কী হবে, তার নিজের বন্দুকও জেহাদ ঘোষণা করে। পশুপাখির দিকে তাক করা বন্দুকের নলও ঘুরে দাঁড়ায় তার দিকে। বন্দুক থেকে ছোড়া গুলি খোলা মাঠে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে। শেষকালে বন্দুকটা শিকারির হাত থেকে ছিটকে গিয়ে মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ফুলে-ফুলে ভরে যায় বন্দুকের গা।
এই ‘অরণ্যদেবের স্বর্গদ্বীপ’ গল্পটিকে ‘আন্ডার দ্য ব্লু মুন’ শীর্ষক ১০ মিনিটের একটি অ্যানিমেশন ফিল্ম হিসাবে তৈরি করেছিলেন চণ্ডী লাহিড়ী। এ-ছবির সংগীত এবং ক্যামেরার দায়িত্ব ছিলেন তাঁর ভাই তুলসী লাহিড়ী। পরিচালক এবং চিফ আর্টিস্ট চণ্ডী লাহিড়ীর নিজে হাতে ফ্রেমের-পর-ফ্রেম এঁকে নির্মাণ করা এই ছবিতে তুলে ধরেন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের বার্তা। এই অ্যানিমেশন ফিল্ম তৈরির জন্য কিনেছিলেন ১৬ এমএম বিদেশি ক্যামেরাও। ফিল্মটি চণ্ডী লাহিড়ী তৈরি করেন ‘ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক’-এর জন্য। নির্বাক ছবিটিতে শুধু মিউজিক আর এফেক্ট সাউন্ডের মধ্য দিয়ে ভাষার অভাব পুষিয়ে দেন তিনি। দূরদর্শনে পাঠানোর আগে ‘আন্ডার দ্য ব্লু মুন’-এর স্ক্রিপ্ট তিনি পাঠিয়েছিলেন চিলড্রেন্’স ফিল্ম সোসাইটিতে। সেখানে বাতিল হলে, সেই স্ক্রিপ্ট পাঠান মান্ডি হাউসে। মান্ডি হাউস তৎপরতার সঙ্গে স্ক্রিপ্ট অ্যাপ্রুভ করে, এবং কাজ শুরু করার জন্য অ্যাডভান্স টাকাও দিয়ে দেয়।
তিনি ও তাঁর ভাই একযোগে তৈরি করেন ‘The Biggest Egg’, ‘Be A Mouse Again’ ও ‘Under The Blue Moon’– নামের তিনটি অ্যানিমেশন ফিল্ম। নিজস্ব বিনিয়োগে তৈরি ছবি তিনটির প্রথম দু’টি প্রভাস ফদিকার সংস্কৃতিমন্ত্রী থাকাকালীন কিনে নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। যথোপযুক্ত টাকাও পেয়েছিলেন তার জন্য। সেই সময় দাঁড়িয়ে– বম্বেতে দু’টি, দিল্লিতে দু’টি, ও মাদ্রাজে একটি সংস্থা ছাড়া চণ্ডী লাহিড়ীর ‘ফিল্ম অ্যানিমেশন ইন্ডিয়া’-ই ছিল কলকাতায় অ্যানিমেশন ফিল্ম তৈরির একমাত্র সংস্থা। ২০০৯ সালে চণ্ডী লাহিড়ী যখন ‘আমেদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইন’-এর অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র উৎসব ‘চিত্রকথা’-য় গিয়েছিলেন, সে-সময় সেখানেরই শিক্ষক শেখর মুখোপাধ্যায় ‘আন্ডার দ্য ব্লু মুন’ ছবিটি সংরক্ষণ করেন। এই রঙিন অ্যানিমেশন ফিল্মগুলি শুধু প্রশংসিত হয়েছেই নয়, দূরদর্শন সেগুলি পরে সংগ্রহ করে সম্প্রচারিতও করেছে। শুধু কার্টুনিস্ট নয়, বাংলায় অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের পুরোধা চণ্ডী লাহিড়ী।
সাল ১৯৬১, বর্ষার কলকাতা নিয়ে গোটা দশেক কার্টুন এঁকে একদিন ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ধীরেন দাশগুপ্তর সঙ্গে দেখা না-করেই তাঁর টেবিলে রেখে আসেন চণ্ডী লাহিড়ী। ধীরেনবাবুর সঙ্গে ওঁর তখনও পরিচয় হয়নি। পরদিন সকালে কাগজ খুলতে দেখা গেল ‘থার্ড আই ভিউ’ নামে একটি কার্টুন কাগজে ছাপা হয়েছে। এই নামকরণটিও চণ্ডীবাবুর করা। পরপর দশ দিনে দশটি কার্টুন ছাপা হয় ওই সংবাদপত্রে। এরপর আরও দশটা আঁকা নিয়ে ধীরেন দাশগুপ্তকে জমা দিলে, তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে, নিয়মিত কার্টুন জমা দিতে বলেন চণ্ডী লাহিড়ীকে। এক বছর ধরে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ইংরেজি দৈনিক ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’-এ চলেছিল এই ‘থার্ড আই ভিউ’। বাংলায় ‘পকেট কার্টুনের’ জনক তিনি। এর আগে ১৯৫২ সালে সাব এডিটর রূপে যোগদান করেন ‘দৈনিক লোকসেবক’ পত্রিকায়। তাঁর কথায়– ‘রাত্রে লোকসেবকের সাব-এডিটর। দিনে টো টো করে ঘুরে বেড়াই। উদ্দেশ্যহীনভাবে স্কেচ করে যাই। কার্টুন ছিল নিছকই সখের ব্যাপার। কিন্তু মাঠে ঘাটে ঘুরে ছবি আঁকার উৎসাহ ছিল প্রথম থেকেই। নামে সাব এডিটর হলেও রিপোর্টারদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি এবং রিপোর্টিংও করেছি। লোকসেবকের মোটে আঠার টাকা বেতন, তাও দুমাস বকেয়া থেকে যেত। তাতে খাওয়া কুলোত না, কিন্তু ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে যাওয়া চলত।’ অতীতের বাংলা কার্টুনের সমৃদ্ধির যুগে যেসব মানুষ স্থপতির কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে চণ্ডীবাবু যে একজন– বলার অপেক্ষা রাখে না।
সবে তখন একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রের দফতরে চাকরি করছেন। তাঁর কার্টুন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে কাগজে। বরানগরের একটি গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণ এল। তাঁর সঙ্গেই সংবর্ধনা পাবেন অভিনেতা বিকাশ রায়, ফুটবলার শৈলেন মান্না, সঁাতারু আরতি সাহা প্রমুখ বিখ্যাত মানুষ। গাড়ি করে সভায় নিয়ে গেলেন আয়োজকরা ও যথারীতি ফুল-মানপত্র ইত্যাদি প্রদানের পর ভাষণ শুরু হল। অনুষ্ঠানের সভাপতি ‘যুগান্তর’ প্রত্রিকার সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। সে ভাষণ আর থামে না। বিকাশ রায় আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘বাড়ি ফেরার ইচ্ছে আছে? তাহলে চলুন আমার সঙ্গে। নইলে অনেক রাতে পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে।’ তিনি তো অবাক! উদ্যোক্তাদেরই তো গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা। হাসলেন বিকাশ রায়, ‘আপনি সবে গুণীজন হয়েছেন। নতুন এ লাইনে। এরা অনুষ্ঠানের আগে গাড়ি করে নিয়ে আসে। ফেরার দায়িত্ব কেউ নেয় না।’ হতভম্ব চণ্ডীবাবু সেদিন বিকাশ রায়ের গাড়িতে চুপি-চুপি অনুষ্ঠান থেকে কাটলেন। এরপর দেখা হলেই বিকাশ রায় তঁাকে ‘কঁাচা গুণী’ বলে ডাকতেন। নিজের জীবনের স্মৃতিচারণায় ঘটনা উল্লেখ করে রসিক চণ্ডীবাবু লিখেছেন, ‘গুণীজন হতে পারিনি। গুণীনও হইনি, হতে চেয়েছিলাম কার্টুনিস্ট, হয়েছিলামও কার্টুনিস্ট। নবদ্বীপের মতো অতি ক্ষুদ্র এক শহরে জন্মে, পেডিগ্রিবর্জিত দারিদ্র্যসম্বল বালক আমি, অজানা অচেনা মহানগরীতে যেটুকু অর্জন করেছি এবং যঁাদের সান্নিধ্য পেয়েছি, তাতে অনায়াসে বলতে পারি, ধন্যোহং কৃতকৃতেহং। আমি ধন্য। আমি কৃতকৃতার্থ।’
বাঙালির খুব কাছের ত্রয়ী ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘তির্যক’ আর ‘চণ্ডী লাহিড়ী’। তঁার কথায়, “যখন আনন্দবাজারে এলাম, তখন চারিধারে কেবল ‘নেই’ ‘নেই’ ডাক। আমি কাজ শুরু করলাম সেই ‘নেই’ ‘নেই’-এর পশ্চাৎপটে। সাধারণ মানুষ এতই কষ্ট পেতেন যে কার দরজায় যাবেন ভেবে পেতেন না।”
ওঁর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় চাকরি হওয়ার গল্পটাও বেশ মজার। ‘লোকসেবক’ পত্রিকার দফতরে সেদিন উনি নাইট ডিউটিতে। আর কিছুক্ষণ পরেই প্রিন্ট অর্ডার দিয়ে শুয়ে পড়বেন, এমন সময় ফোনটা এল। তখন রাত প্রায় দুটো। অপর প্রান্ত থেকে গলা ভেসে এল, ‘চণ্ডী লাহিড়ীকে চাই।’ প্রতি-উত্তরে সেই কণ্ঠ বলল, ‘সন্তোষ ঘোষ বলছি, আনন্দবাজার থেকে।’ সেই সময় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় দু’জন সন্তোষকুমার ঘোষ ছিলেন। একজন সাব-এডিটর সন্তোষকুমার ঘোষ, যার সঙ্গে চণ্ডীবাবুর পরিচয় ছিল। আর-একজন বিখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষকুমার ঘোষ– ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র নিউজ এডিটর। ভুল করে তাঁকে সাব-এডিটর ভেবে ঠাট্টা করে বলেন, ‘কী সন্তোষদা, ছোট কাগজ কী লিড নিউজ দিল সেটা জানাতে চাইছ?’ সামান্য নীরবতার পর গুরুগম্ভীর গলায় উত্তর এল, ‘আমি নিউজ এডিটর সন্তোষকুমার ঘোষ বলছি।’ শুনে তো চণ্ডীবাবুর হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়! কোনওরকমে ‘বলুন’ বলার পরেই প্রশ্ন, ‘আর কতক্ষণ কাজ করবেন?’ শুনে চণ্ডীবাবুর বললেন, ‘আড়াইটে অবধি। তারপর শুয়ে পড়ব। সকালে মেসে ফিরে যাব।’ ‘না, আপনি মেসে যাবেন না। সোজা আমার বাড়ি চলে আসবেন। আমার সঙ্গে চা খাবেন।’
পরদিন সকালে সন্তোষকুমার ঘোষের বাড়ি যেতেই বললেন, ‘অ্যাপ্লিকেশন এনেছেন?’ শুনে অবাক চণ্ডীবাবু। উনি বললেন, ‘আরে, আপনার চাকরি হবে আনন্দবাজারে। আমি গতকালই অশোকবাবুর (অশোককুমার সরকার) সঙ্গে কথা বলেছি।’ ‘তা, আপনি কত টাকা বেতন আশা করেন?’ প্রশ্ন করলেন সন্তোষকুমার ঘোষ। এক সময় ১৮ টাকা বেতনে কেরিয়ার শুরু করা শিল্পীর ১০ বছরে তখন বতনে ২৬ টাকায় পৌঁছেছে। এমন শিল্পী আর কত বেতন আশা করতে পারেন? অনেক ভেবেচিন্তে নিজের মেস ভাড়া, খাওয়া খরচ সব মিলিয়ে ১৩০-এর মধ্যে কিছু একটা বললেন। শুনে গম্ভীর মুখে সন্তোষবাবু বলেছিলেন, ‘তাহলে তো আপনাকে চাকরিটা দেওয়া গেল না।’ চণ্ডীবাবু অবাক হয়ে তাকাতে তিনি হেসে বললেন, ‘আমাদের এখানে পাঁচশো টাকার কমে কোনও চাকরি হয় না। যাকগে, ওটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। মাইনেপত্র আমরা ঠিক করে নেব।’
সেই থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় কাজ করেছেন। পকেট কার্টুনের ছোট্ট পরিসরে পত্রিকার প্রথম পাতার বাঁদিকে ছাপা তীক্ষ্ণ তিরের মতো মজাদার ব্যঙ্গচিত্র জনপ্রিয়তার শীর্ষে এনে দিয়েছিল তাঁকে। দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক সমসাময়িক ঘটনার প্রেক্ষিতে তাঁর নিজস্ব স্টাইলের অসামান্য ব্যঙ্গচিত্রগুলি বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছিল বলা যায়।
বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ’-র পরেই ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল। সে-সময় চণ্ডী লাহিড়ী আঁকলেন, পরম তৃপ্ত মুখে ভারিক্কি চেহারার ইন্দিরা গান্ধী একটি বেড়ালছানার মতো ব্যাঘ্রশাবককে কোলে করে ফিডিং বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছেন! আর বেড়ালটা ভীতু চোখে বোঝার চেষ্টা করছে– ইনি আসলে কী চান! রাজনৈতিক কার্টুনে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। অনেকে তাঁকে ‘বাংলার আর. কে. লক্ষ্মণ’ আখ্যাও দিয়েছিলেন। তাঁর ‘তির্যক’ সিরিজের কার্টুনে বারবার ফুটে উঠেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক কটাক্ষ। একবার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রবুদ্ধ সেন কার্টুন দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে গোপনে নির্দেশ দিয়ে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধই করে দিয়েছিলেন। কার্যত ঈশ্বরদত্ত আঁকার হাত ছিল চণ্ডীবাবুর। একদম পরিষ্কার নির্দিষ্ট স্ট্রোক পড়ত কাগজে, যেন অবয়বটা সাদা কাগজে আগে থেকেই আঁকা আছে। ছিল অনবদ্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, যা কার্টুনিস্ট হতে গেলে মাস্ট। নিমিষে ধরতে পারতেন শারীরিক গঠন, অঙ্গভঙ্গি… তাই অল্প স্ট্রোকেই ফুটে উঠত ইন্দিরা গান্ধী থেকে জ্যোতি বসু। জুলফির মিল খুঁজে পেতেন সঞ্জয় গান্ধী আর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের!
১৯৩১ সালের ১৩ মার্চ বুড়োশিবতলায় মামার বাড়িতে জন্ম চণ্ডী লাহিড়ীর। বাবা মোহিনীমোহন লাহিড়ী ছিলেন বর্ধমান চণ্ডীপুরের বাসিন্দা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন, চাকরির খোঁজ শুরু হয় কলাকাতায়। তত দিনে হাতে তুলে নিয়েছেন রং-তুলি। ‘সব্যসাচী’ চণ্ডীবাবুর হাত বিষয়ে কথা উঠলে সহর্ষে বলতেন, তলোয়ারের একটি দিকেই ধার থাকে। এই প্রসঙ্গে কার্টুনিস্ট কুট্টি এক সাংবাদিককে মজা করে বলেছিলেন, ‘চণ্ডী ব্রিলিয়ান্ট। সে এক হাতে কী কাজ করে! ওর দুটো হাত থাকলে আমার আর আনন্দবাজারে চাকরি করা হত না।’ মনে করতেন, “A Cartoonist’s job is to poke his nose to other’s affairs.” চণ্ডীবাবুর জীবনের প্রথম ১০ বছর মাটিয়ারি গ্রামেই কেটেছে। শৈশবের এই গ্রাম-জীবনের স্মৃতি নিয়ে বৃদ্ধ বয়সে তা নিয়ে লিখেছেন রম্য গদ্যের বই ‘বাহারী শৈশব’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় ওঁর প্রথম প্রকাশিত কার্টুন সংকলন ‘ভিজিট ইন্ডিয়া উইথ চণ্ডী’। অধুনালুপ্ত এই বইটি গত বছর পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘বিষয় কার্টুন’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা রূপে।
আঁকা ও অ্যানিমেশন ফিল্ম তৈরির পাশাপাশি ‘লেখক’ হিসাবেও তাঁর অবদান কম নয়। ‘যষ্টিমধু’ পত্রিকায় লিখতেন ‘চণ্ডী ঠাকুর’ ছদ্মনামে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় ‘বিদেশিদের চোখে বাংলা’। পরে বিপুল পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে লিখেছিলেন ‘কার্টুনের ইতিবৃত্ত’, ‘গগনেন্দ্রনাথের কার্টুন ও স্কেচ’, ‘বাঙালির রঙ্গব্যঙ্গ চর্চা’, ‘কথায় কথায়’, ‘চলমান প্রসঙ্গ’ ইত্যাদি একাধিক বই। পাশাপাশি ছোটদের জন্য লেখা বেশ কিছু বই সেজে উঠেছে তাঁর আঁকায়– ‘চচ্চড়ি’, ‘বকম বকম’, ‘এই তো সময়’, ‘মিচকে’, ‘নেংটি’ আর ইংরেজিতে ‘Toddle Trouble’। পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা মূলক কার্টুনে সাজানো ‘ছিঁটেফোঁটা’ বইটি। এছাড়া ‘Since Freedom’ ও ‘Chandi Looks Around’ তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি কার্টুন সংকলন। মেয়ে তৃণা লাহিড়ীর সঙ্গে একত্রে লেখা কালচারাল অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে ‘মানুষ কী করে মানুষ হল’ বইটি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংদাস পুরস্কার পেয়েছিল। ২০২২ সালে চণ্ডীবাবুর ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ওঁর আঁকা কার্টুন, বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ, সুদৃশ্য নামাঙ্কন, বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে অলংকরণ, বিজ্ঞাপন ও সিনেমার নামলিপি, তৎসহ পোস্টার দিয়ে সাজানো একটি বাংলা নববর্ষ ক্যালেন্ডারও।
কার্টুনিস্ট রূপেও তিনি যে ‘কৃতকৃতার্থ’, এ-কথা বাঙালিকে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রচ্ছদ অলংকরণ করেছেন একাধিক বইয়ের। তবে তাঁর কাজ শুধু কার্টুন সংকলন আর পকেট কার্টুনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। টিভির পর্দায় ‘চণ্ডীপাঠ’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য-র বিখ্যাত কবিতা ‘একটি মোরগের কাহিনী’-র সঙ্গে ওঁর আঁকা ছবি দিয়ে প্রকাশিত হয় মিনি বুক হিসাবেও। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের জন্য করেছেন একাধিক রঙিন কার্টুন। একসময় একাধিক বাংলা সিনেমার টাইটেল কার্ডও এঁকেছেন চণ্ডী লাহিড়ী– ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘চারমূর্তি’, ‘পাকা দেখা’, ‘মৌচাক’ ও ‘ফুলু ঠাকুমা’। ‘হংসরাজ’ ছবির গানের সঙ্গেও ছিল তাঁর অনবদ্য কিছু কার্টুন। ‘ছায়া স্টোর্স’, ‘বিনোদ বিহারী দত্ত’, ‘এন কে ডি এ’ ও ‘গাঙ্গুরাম’-এর বিজ্ঞাপনে দেখা মিলেছে চণ্ডীবাবুর আঁকার। লোগো ডিজাইন করেন এম. পি. জুয়েলার্সের। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর টেলি সিরিয়াল ‘অবিরত চেনামুখ’ ও মেঘনাদ ভট্টাচার্যের নাটক ‘বধূতন্ত্র’-য় ওঁর আঁকা ব্যবহৃত হয়েছে। করেছেন বিয়ের কার্ডের ডিজাইনও!
২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আর. জি. কর হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে প্রয়াত হন। এখনও শিয়ালদহ অঞ্চলের একটি মিষ্টি দোকান তাদের সন্দেশের বাক্সে ব্যবহার করে চণ্ডী লাহিড়ীর আঁকা। হয়তো এটাই উদ্যাপন– সৃষ্টির, স্রষ্টার। মধুরেণ সমাপয়েৎ।
তথ্যঋণ ‘বিষয় কার্টুন’ ও
বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
agnivac20@gmail.com
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.