ফাইল ছবি।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দিয়েই বসতে চান মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে। তিনি ইস্তফা দিলে দিল্লিতে কি সহানুভূতির হাওয়া বইবে? হরিয়ানাতেও কি নির্বাচনের ফল যাবে আপের পক্ষে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক মহলে শোরগোল ফেলেছে। কেজরিওয়াল নিজে ঘোষণা করেছেন, তিনি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দিয়ে ফের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসতে চান। দিল্লিতে বিধানসভা ভোট আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু কেজরির দল ভোট তিনমাস এগিয়ে আনতে আগ্রহী। নভেম্বর মাসে মহারাষ্ট্রে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা আছে। কেজরি চাইছেন মহারাষ্ট্রের সঙ্গেই দিল্লিতে বিধানসভা ভোট সেরে ফেলতে। নির্বাচন কমিশন সম্মতি দিলে সেটা হওয়া সম্ভব। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে কেজরি হয়তো নভেম্বরের ভোটের দিকেই এগিয়ে যাবেন।
নভেম্বরে মহারাষ্ট্র ও দিল্লির বিধানসভা ভোটের আগে রয়েছে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরিয়ানার ভোট। এই হরিয়ানার ভোটেও সব ক’টি আসনে প্রার্থী দঁাড় করিয়েছে কেজরির দল ‘আপ’। কেজরির মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত কি হরিয়ানার ভোটে কোনওভাবে প্রভাব ফেলবে? রাজনৈতিক মহলে এখন এই প্রশ্নটিকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি চর্চা। সুপ্রিম কোর্টে কেজরি জামিন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য কংগ্রেস বলেছিল, হরিয়ানার ভোটে অাপ-কে ‘ভোট কাটুয়া’ হিসাবে ব্যবহার করতেই কেজরির জামিনের ব্যবস্থা হল। কেজরি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলে দিল্লিতে যে একটা সহানুভূতির হাওয়া দেখা দেবে, তা নিয়ে কোনওই সংশয় নেই। ওই সহানুভূতির হাওয়াকে পুঁজি করে কেজরি দিল্লির নির্বাচনে বাজিমাত করতে চাইবেন। কিন্তু কেজরির ইস্তফা কি হরিয়ানাতেও আপের পক্ষে সহানূভূতির হাওয়া তুলতে পারবে?
কেজরিওয়াল যে আদতে হিসারের কাছে অবস্থিত সিওয়ানির ছেলে, সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আপ ইতিমধ্যেই একটা সহানুভূতির হাওয়া তোলার চেষ্টা করছে। হরিয়ানার রাজনীতি কংগ্রেস ও বিজেপি, এই দুই মেরুতে বিভাজিত হয়ে রয়েছে বলে যঁারা দাবি করছেন, তঁারা কতটা সত্য প্রমাণিত হবেন, তা নিয়ে কিন্তু বিভিন্ন মহলে সংশয় রয়েছে। তিহার জেল থেকে কেজরির মুক্তি হরিয়ানায় তঁাদের নির্বাচনের পালে যথেষ্ট হাওয়া দিয়েছে বলে আপ নেতারা দাবি করতে শুরু করেছেন। কেজরি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে হরিয়ানার ভোট প্রচারে িগয়েও বলবেন, জনতার আদালতে বিচার চাইতে এসেছেন। বিনা কারণে বিজেপি তঁাকে গ্রেফতার করে রেখেছিল। ভারতীয় রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন সমাজ সংশোধনের কাজ করার জন্য। রাজনীতি থেকে পয়সা কামিয়েছেন: এ-কথা কেউ তঁার বিরুদ্ধে বলতে পারবে না। কেজরির এই প্রচার জনতার হৃদয়কে স্পর্শ করবে বলে আপ নেতৃত্বের ধারণা।
বিজেপি মুখে বলছে, কেজরি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেও তঁার প্রতি কোনও সহানুভূতির হাওয়া উঠবে না। কেজরির প্রতি যদি সহানুভূতির হাওয়া উঠত, তাহলে সেটা লোকসভা ভোটেই উঠতে পারত। কিন্তু লোকসভা ভোটে খোদ দিল্লিতেই সাতটি আসনে বিজেপি জিতেছে। বিজেপি মুখে এই কথা বললেও তারা চায় হরিয়ানার ভোটে কেজরির পক্ষে একটা সহানুভূতির হাওয়া উঠুক। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে হরিয়ানায় বিজেপি ৪৬.১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বিধানসভা ভোটে যে তাদের এই ভোট-শতাংশ অনেকটাই কমে যাবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বিজেপি হরিয়ানায় ৫৮.২ শতাংশ ভোট পায়। কিন্তু লোকসভা ভোটের পঁাচ মাস বাদে বিধানসভা ভোটে বিজেপির ভোট ৩৬.৫ শতাংশে নেমে যায়।
৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে বিজেপি জিততে পেরেছিল মাত্র ৪০টিতে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে হরিয়ানাতে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে ভোট আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিধানসভা ভোটে গিয়ে দেখা গেল ভোট কয়েকটি মেরুতে ভেঙে গিয়েছে। বিজেপির যে ২২ শতাংশ ভোট কমেছিল, তা পেয়ে গিয়েছিল ‘জননায়ক জনতা পার্টি’ ও ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদল’ নামে দু’টি আঞ্চলিক দল। এবারও বিধানসভা ভোটে একইভাবে দু’টি মেরুতে ভোট না বিভাজিত হয়ে একাধিক দলের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে তৃতীয় শক্তি হিসাবে আপের উত্থান ঘটতে পারে। ৯০টি আসনের মধ্যে আপ যদি বেশ কিছু আসনে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট কেটে নেয়, তাহলে তা কংগ্রেসের পক্ষে সমস্যার হতে পারে। এই প্রত্যাশা থেকেই বিজেপি তলে তলে চাইছে হরিয়ানার ভোটেও কেজরির পক্ষে একটা সহানূভূতির হাওয়া উঠুক।
হরিয়ানা ভোটের কারণেই কেজরির ইস্তফাকে প্রকাশ্যে কোনও গুরুত্ব িদতে চাইছে না কংগ্রেস। তারা বলছে, সুপ্রিম কোর্ট কেজরিকে দফতরে যেতে বারণ করেছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর পদে থেকে তঁার কোনও লাভ নেই। সে-কারণেই তিনি ইস্তফা দিচ্ছেন। কেজরির ইস্তফা সহানুভূতির হাওয়া তুললে কংগ্রেসের পক্ষে তা ক্ষতিকর হবে। হরিয়ানার বিধানসভা ভোট জিততে কংগ্রেস মরিয়া। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেস হরিয়ানায় ৪৫.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ২০১৯-এর বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৪.৪ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ লোকসভায় কংগ্রেসের ১১ শতাংশের বেশি ভোট বেড়েছে। লোকসভা ভোটে তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত আসনগুলিকে কংগ্রেস ৫১.৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বিজেপি এই সংরক্ষিত আসনগুলিতে ৪০ শতাংশ ভোট পায়। জাঠ ভোটব্যাঙ্ক ও সংরক্ষিত অাসনগুলিতে লোকসভা ভোটের সাফল্যকে পাথেয় করে হরিয়ানায় একটি চমকপ্রদ সাফল্য দেখাতে কংগ্রেস প্রবল আশাবাদী। এই অবস্থায় বিজেপির তুরুপের তাস হয়ে যেতে পারেন কেজরিওয়াল।
রাজনৈতিক মহলের একটি বড় অংশের মতে, লোকসভায় দিল্লিতে আপের ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাওয়া থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না যে, কেজরির প্রতি সাধারণ ভোটারদের কোনও সহানুভূতি নেই। আবগারি দুর্নীতিতে কেজরি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন বলে কেউই বিশ্বাস করেন না। সে-কারণে কেজরিকে অাবগারি দুর্নীতিতে জেলবন্দি করে রাখা হরিয়ানায় বিজেপির বিরুদ্ধে যেতেই পারে। ভূমিপুত্র কেজরির প্রতি হরিয়ানার ভোটে সহানুভূতির হাওয়া ওঠা অসম্ভব কোনও বিষয়ই নয়। দিল্লি লাগোয়া হরিয়ানাতে আপের সংগঠনও যথেষ্ট শক্তপোক্ত। বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস ও বামেদের একটা বড় অংশ হরিয়ানায় আপে যোগ দিয়েছে। আপের উপস্থিতি যদি হরিয়ানার ভোটে অঙ্কের গরমিল ঘটিয়ে দেয়, তাহলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কেজরির প্রাসঙ্গিকতা ফের ফিরে আসতে পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.