Advertisement
Advertisement

Breaking News

BJP Karnataka

সম্পাদকীয়: মোদি চাঁদ, রাহুল চাঁদমালা! পার্থক্য এতটাই?

চাঁদ আর চাঁদমালার ফারাকটাই ইউএসপি রাহুলের।

Editorial: BJP's plans on Karnataka has a Rahul Gandhi turn | Sangbad Pratidin
Published by: Subhajit Mandal
  • Posted:April 5, 2023 3:53 pm
  • Updated:April 5, 2023 3:53 pm  

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: কংগ্রেসের মোকাবিলা বিজেপি কীভাবে করতে চাইছে তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শংকরের সাম্প্রতিক কয়েকটা মন্তব্যে পরিষ্কার। দিন কয়েক আগে এক জনসভায় মোদি (Narendra Modi) বলেন, ওরা প্রতিদিন বলছে মোদি মরে যাক। কিন্তু দেশের গরিব মানুষ ও মা-বোনেরা চাইছে মোদি বেঁচে থাকুক। এরাই আমার ঢাল, আমার শক্তি।

মানুষই যে তাঁর ঢাল, সেই কথা বলে সংসদেও তিনি বিরোধীদের কটাক্ষ করেছিলেন। এই সেদিন তিনি আবার নতুন এক কথা শোনালেন। বললেন, দেশ-বিদেশের কেউ কেউ আমাকে মারার জন্য ‘সুপারি’ দিয়েছে। সে জন্য অযথা আমার বদনাম করা হচ্ছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, রাহুলের মতো মোদিও ‘ভিকটিম কার্ড’ খেলছেন। প্রধানমন্ত্রীর সুরে বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর ও যখন পশ্চিমী দুনিয়ার কড়া সমালোচনা করে বলেন, ভারত সম্পর্কে উঠতে-বসতে মন্তব্য করা, ফুট-কাটা পশ্চিমি দুনিয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না শাসককুল ঠিক কী করতে চাইছে। জয়শংকর পশ্চিমী দুনিয়াকে ঠেস দেওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন রাহুল-উবাচকেও। বলেছেন, দেশের কেউ কেউ তাদের ওইসব মন্তব্য করতে উসকানি দেন। অতএব, দোষ অর্ধেকটা তাদের, অর্ধেকটা আমাদের লোকজনের।

Advertisement

[আরও পড়ুন: প্যান-আধার সংযোগ না করলেও হবে? কাদের জন্য প্রয়োজ্য, জেনে নিন খুঁটিনাটি]

দেশীয় রাজনীতির এই আখ্যান বা ‘ন্যারেটিভ’ তৈরিতে খুব ঠান্ডা কয়েকটা মাথা নিরন্তর কাজ করে চলেছে। তাদের বিরামহীন মগজধোলাই প্রতিষ্ঠা করেছে, মোদি-বিরোধিতার অর্থ দেশ-বিরোধিতা। সেই ষড়যন্ত্রী বিরোধীদের অংশ কারা তা ভণিতাহীনভাবে জলবৎ তরলং বুঝিয়ে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু (Kiren Rijiju)। বিচার বিভাগকেও তিনি রেয়াত করেননি। আজকের বিজেপির (BJP) বিশেষত্ব এটাই। একেবারে উপরতলা যা বলবে, তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সবার কাছে সেটাই ধ্রুব সত্য। একটা সময় প্রবল অনুশাসিত কমিউনিস্ট পার্টি এমন ছিল। এখন ‘নতুন ভারত’-এর নতুন বিজেপিতে সেই নিয়ম জেঁকে বসেছে। সানাইয়ের পোঁয়ে সুর মেলানো অলিখিত নিয়ম। সামান্যতম বিচ্যুতিরও অবকাশ নেই। বিজেপিতে ‘তারকাটা’ বা বেসুরোকে খুঁজে পাওয়া, খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতোই অসম্ভব।

দেশ ও বিদেশের ‘হাতে-হাত মেলানো চক্রান্তকারী’ কারা, কর্ণাটক ভোটের আগে তা আর কারও বুঝতে বাকি নেই। শাসকের প্রচারের শুরু ও শেষজুড়ে তাই শুধুই কংগ্রেস। তারাই আক্রমণের মূল লক্ষ্য। লড়াইটা উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ ও শ্রীবৃদ্ধির বদলে ‘দেশপ্রেম বনাম দেশদ্রোহ’ করে তুললে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বর জ্বালা, ধর্মীয় ও সামাজিক ভেদাভেদ, আইনের শাসনের অপব্যবহার এবং সর্বোপরি দুর্নীতি ও আদানি-কাণ্ড থেকে খুব সহজে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। কর্নাটকে বিজেপি সেটা করছে চতুরভাবে এবং জবরদস্তি। সেই সঙ্গে অবশ্যই বিছিয়ে দিয়েছে ধর্মীয় মেরুকরণের চাদর। দল কত ঠাসবুনট এই আচরণই তার প্রমাণ। এর জন্যই তারা লড়াইটা ‘বিজেপি বনাম বিরোধী’ না করে ‘মোদি বনাম রাহুল’-এ পরিণত করতে চাইছে।
এই আগ্রহের কারণ একাধিক। প্রধান কারণ, মোদি-রাহুলের ভাবমূর্তিতে আসমান-জমিন ফারাক। মোদি চাঁদ হলে রাহুল চাঁদমালা। পশ্চিমী দুনিয়ার উপর ক্ষিপ্ত মোদি সরকারের মন ফুরফুরে করে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর ‘মর্নিং কনসাল্ট’ গোষ্ঠীর সাম্প্রতিক সমীক্ষা। সেখানে দেখানো হয়েছে, হিন্ডেনবার্গ ও যাবতীয় বিরোধী প্রচার মোদির উঁচু মাথা হেঁট করতে পারেনি। এখনও তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। মোদির ৭৬ শতাংশ জনপ্রিয়তার পাশে ম্লান যুক্তরাষ্ট্রর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden) (৪১ শতাংশ), কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো (৩৯ শতাংশ), ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক (৩৪ শতাংশ), ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরোঁ (২২ শতাংশ) সবাই। রাজনৈতিক লড়াইকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে দিতে পারলে বিজেপি জানে তাদের ধরাছোঁয়া কতটা কঠিন। সেটাই তারা করতে চাইছে।
সেজন্যই দরকার রাহুল গান্ধীর (Rahul Gandhi)। খারিজ হয়ে গিয়েছে তাঁর সাংসদ পদ। ‘ছেড়ে দিয়েও তেড়ে ধরা’-র নমুনা রেখে যেভাবে তারা রাহুলের বিরুদ্ধে মামলাটির নিষ্পত্তি ঘটিয়েছে, কংগ্রেসিদের বয়ানে তা উসেইন বোল্ট-এর গতিকেও লজ্জায় ফেলেছে। রাহুল বলেছেন ‘বুলেট ট্রেন’। এই ঘটনা বিচার বিভাগের ‘গেরুয়াকরণ’ বিতর্ক (বিশেষ করে নিম্ন আদালতে) নতুনভাবে উসকে দিয়েছে। রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ বিজেপির ‘রাজনৈতিক ভুল’, না কি ‘মোদি-রাহুল আখ্যান’ মেলে ধরে আখের গোছানোর ছক, সেই বিতর্কের প্রাথমিক অবসান ঘটবে ১৩মে, কর্ণাটক বিধানসভার ভোটের ফল প্রকাশের পর।

[আরও পড়ুন: অনুব্রতহীন বীরভূমে নজর নেত্রীর, কালীঘাটে আজ জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক]

তবে, এটা ঠিক, ওই সিদ্ধান্তই হয়ে উঠেছে বিরোধী ঐক্যের আঠা। রাহুল পুব দিকে তাকালে যারা পশ্চিমে দৃষ্টি মেলতেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল (Arvind Kejriwal) এখন যেন কংগ্রেসের ঠিকানা-লেখা খামের ডাকটিকিট। তাঁদের সঙ্গে অখিলেশ যাদব ও চন্দ্রশেখর রাও-ও দাঁড়িয়ে পড়েছেন এক কাতারে। বিজেপির কপালের ভাঁজ এতে বাড়ারই কথা। এই যূথবদ্ধতা অবশ্যই তাদের অপছন্দের।
কেজরিওয়াল ও মমতার হঠাৎ এই নব-রুদ্র রূপের ব্যাখ্যা অনেক। বিশেষ করে কেজরিওয়ালের। বিজেপির একাংশের ব্যাখ্যা, রাহুলের ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক জীবন হঠাৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় তাঁরা অন্য বিরোধীদের কাছে টানতে নড়েচড়ে বসছেন। মনে করছেন, বিরোধীদের নেতৃত্ব-দানের প্রশ্নে যে শূন‌্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা তাঁর ভরাট করতে পারবেন। কারণ ও ব্যাখ্যা যা-ই হোক, বিজেপির কর্নাটকী দৃষ্টিতে তা কল্কে পাচ্ছে না। কারণ, দক্ষিণী এই রাজ্যে কংগ্রেস, জেডিএস ও বিজেপি ছাড়া আর কেউ নেই।

কর্ণাটকে বিজেপি নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। কিন্তু রাজ্যের পুরোনো মহীশূর (অধুনা মাইসুরু) এলাকার জনতা এখনও জেডিএস ও কংগ্রেস ছাড়া অন্যদের কাছে টানতে অনাগ্রহী। ভোক্কালিগা সমৃদ্ধ এই এলাকার নয়নের মণি দেবগৌড়া-কুমারস্বামী পরিবার। ডিকে শিবকুমারের চওড়া কাঁধে ভর দিয়ে কংগ্রেসও সেখানে প্রাসঙ্গিক। বিজেপি পায়ের তলায় জমি খুঁজতে ভোক্কালিগা সম্প্রদায় থেকে তুলে এনে ২০১১-’১২ সালে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল সদানন্দ গৌড়াকে। উপমুখ্যমন্ত্রী করেছিল আর অশোক ও সি. এন. অশ্বত্থ নারায়ণকে। কিন্তু কেউ-ই ভোক্কালিগাদের মন জিততে পারেননি। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধিপতি প্রবাদপ্রতিম কেম্পে গৌড়ার ১০৮ ফুট মূর্তিও তৈরি করেছে বিজেপি। কিন্তু পুরনো মহীশুরে কল্কে পায়নি। এবার আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছে উরি গৌড়া ও নানজে গৌড়াকে, বিজেপির প্রচারে যারা ‘টিপু সুলতানের বীর হত্যাকারী’। তাঁদের নিয়ে সিনেমা তৈরিতে আগ্রহী।
পুরনো মহীশুর ও কর্ণাটকের দক্ষিণাঞ্চল বাদ দিলে অন্যত্র বিজেপির লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে। ইয়েদুরাপ্পাকে অবসরে পাঠানো বিজেপি রাজ্যে মুখহীন। ভোটের মুখ একজনই– নরেন্দ্র মোদি। তুলনায় কংগ্রেসের ত্রিমূর্তি ধারে-ভারে-প্রভাবে বেশি। দলিত মল্লিকার্জুন খাড়গে, অনগ্রসর সিদ্দারামাইয়া ও ভোক্কালিগা শিবকুমারের রসায়ন দলকে আশাবাদী করে তুলেছে। সংশয় একটাই, ত্রিমূর্তির রসায়ন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অটুট থাকবে তো?

কর্ণাটক, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, গুজরাটে রাজনীতির এক নতুন ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে। বিধানসভার ভোটে অন্যদের বাছলেও লোকসভা নির্বাচনে মানুষ নরেন্দ্র মোদি ছাড়া অন্য কারও দিকে তাকাতে চাইছে না। সেই ট্রেন্ড অপরিবর্তিত রাখতে ‘মোদি বনাম রাহুল’ আখ্যান জিইয়ে রাখা জরুরি। বিজেপি সেটাই পরিকল্পিতভাবে করে চলেছে। একটা দিনও বাদ যাচ্ছে না, যেদিন রাহুলকে কোনও না কোনও বিষয়ে তারা তুলোধোনা করছে। তুলোধোনা হচ্ছেন মোদিও। আদানি প্রশ্নে মৌন থেকে তিনি অনেক কিছু গোপন রাখতে চান, এটা স্পষ্ট। ব্যক্তিগতভাবে মোদি অসৎ, বিরোধীরা এই পুরনো অভিযোগে নতুন করে শান দিয়েছে আদানিকে টেনে এনে। নৈতিক অসততার প্রমাণে টেনে এনেছে তাঁর কলেজ-ইউনিভার্সিটি ডিগ্রির বিষয়টি। ২০১৯ সালে দেশের মানুষ কিন্তু চৌকিদারকে চোর মানেনি। পাঁচ বছর পর সেই একই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটলে আশিস নন্দীর মতো রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ববিদরা কী ব্যাখ্যা দেবেন, জানার আগ্রহ বাড়বে। আপাতত নজরে কর্ণাটক।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement