সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় খবর কী কী? অনেকের মনে অনেকরকম উত্তর আসবে। যেমন, কোভিডের (Coronavirus) দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝাপটা কমলেও তৃতীয় তরঙ্গের সম্ভাব্য আগমন নিয়ে শঙ্কা। অধিকাংশ বঙ্গবাসীর ধারণায়, বঙ্গভঙ্গের ধুয়ো তুলে সদ্য-নির্বাচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখার ‘কেন্দ্রীয় চক্রান্ত’ গুরুত্বপূর্ণ খবর হতে পারে। কারও বা মনে হতে পারে, ২১ জুন থেকে শুরু হওয়া সারা দেশে বিনামূল্যে গণটিকাকরণই বড় খবর। অনেকেই আবার তাকিয়ে প্রশান্ত কিশোরের নবতম উদ্যোগের দিকে। কারও নজরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার আসন্ন রদবদল।
কেউ কেউ এসবের ধার ধারেন না। তাঁরা মজে আছেন ইউরো, কোপা আমেরিকা অথবা বিলেতের ক্রিকেট মহারণে। আবার কেউ বলবেন, কাল বৃহস্পতিবার, জম্মু-কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলের নেতাদের দিল্লি বৈঠক ‘মোস্ট ইন্টারেস্টিং নিউজ’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) আরও একটা মাস্টারস্ট্রোক।আমার কাছে প্রতিটি খবরই বড় ও গুরুত্বপূর্ণ।
কাশ্মীরি নেতাদের দিল্লি ডেকে পাঠানোর সিদ্ধান্তটি তো বেশ চমকের এবং অবশ্যই অ-মোদিসুলভ! প্রধানমন্ত্রী কোনও বিষয়ে আলোচনার জন্য সর্বদলীয় বৈঠক ডাকছেন, এমন উদাহরণ এতদিন দেখা যায়নি। কাশ্মীর নিয়ে তো এই প্রথম। এর মধ্য দিয়ে মোদি একাধিক লক্ষ্য হাসিল করতে চাইছেন। অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর সুযোগ তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে দেখাতে পারবেন, ভারতের গণতান্ত্রিকতার চিত্র। বোঝাবেন, তিনি গণতন্ত্রী বলেই জম্মু-কাশ্মীরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করতে উদ্যোগী। জেলা উন্নয়ন পর্ষদের ভোটের পরের ধাপ বিধানসভা-লোকসভা নির্বাচন। তবে তার আগে হবে ‘ডিলিমিটেশন’। একই সঙ্গে বোঝাবেন, মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও ভারত সমান মনোযোগী।
এটা না-করে মোদির উপায়ও নেই। ট্রাম্প-জমানায় কাশ্মীর নিয়ে তিনি যতটা নিশ্চিন্ত ছিলেন, বাইডেন-যুগে ততটাই চিন্তিত। পালাবদলের পর ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটন তিন-তিনবার নয়াদিল্লিকে কাশ্মীর পরিস্থিতি ও মানবাধিকার নিয়ে সতর্ক করেছে। কিছু একটা মোদিকে করতেই হবে। কেননা, ভারত যত আমেরিকার কোলে ঝুঁকছে, ততই দূরে সরে গিয়ে রাশিয়া ঘনিষ্ঠ হচ্ছে চিনের। চিন-পাকিস্তান-রাশিয়ার এই অক্ষ ভারতের পক্ষে মোটেই দৃষ্টিনন্দন ও সৃষ্টিসুখের নয়।
এসব ছাপিয়ে আমার নজর কাড়ছে একের পর এক রাজ্যে শাসক বিজেপির তীব্র অভ্যন্তরীণ কলহ। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, কর্ণাটক, গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ– কোন্দলে কেউ কারও কম নয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এমন খোলামেলা অবজ্ঞার দৃশ্যও এতদিন দেখা যায়নি। কোনও রাজ্যেই মোদি-শাহ (Amit Shah) জুটির নির্দেশ বেদবাক্যের মতো মেনে যুযুধান কোনও পক্ষ নির্জীব হচ্ছে না। বরং কলহ দিন-দিন প্রকাশ্য ও প্রকটতর হচ্ছে।
যেমন উত্তরপ্রদেশ। মোদি-যোগী (Yogi Adityanath) আকচাআকচি আদৌ আর গোপনীয়তা দাবি করে না। হরিদ্বারের গঙ্গার জলের মতোই আজ তা স্বচ্ছ। আমলার চাকরি ছাড়িয়ে মোদি যাকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী করতে লখনউ পাঠিয়েছিলেন, সেই অরবিন্দ শর্মাকে শেষ পর্যন্ত দলের সহ-সভাপতি করে প্রধানমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো! আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরাতে মোদি শুধু ব্যর্থই নন, ভোটের আগে তাঁকে উপেক্ষা করার সাহসও দেখাতে পারছেন না। পারলে শর্মা সহ-সভাপতি নন, উপ-মুখ্যমন্ত্রীই হতেন। মোদি-যোগী দ্বৈরথের মাহাত্ম্য এমনই।
উত্তরপ্রদেশ-লাগোয়া উত্তরাখণ্ডের কাজিয়াও চমকপ্রদ। এই রাজ্যের ভোটও সামনের বছরের গোড়ায়। তিনমাস আগে এই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদলেছেন মোদি। অথচ প্রাক্তন ও বর্তমানের ঝগড়া এখন খুল্লমখুল্লা। মুখ্যমন্ত্রী তীরথ সিং রাওয়াত ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতকে সামলাতে দিল্লি হিমশিম খাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঝগড়া কুম্ভমেলার সময় কোভিডের ভুয়া পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে, যেখানে লক্ষাধিক পুণ্যার্থীকে জাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। বিপাকে পড়া মুখ্যমন্ত্রী যেই বলেছেন, এসব ঘটনা তাঁর পূর্বসূরির আমলের, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর তৎক্ষণাৎ দাবি, মুখ্যমন্ত্রী বরং বিচারবিভাগীয় তদন্ত করান। দুই রাওয়াতের এই তুমুল ঝগড়ায় কংগ্রেসের হরিশ রাওয়াত ঘর গোছাতে পারবেন কি না, তা পৃথক প্রশ্ন। আসল বিষয় হল, মোদি-শাহর শক্ত মুঠো শিথিল হওয়া। তীরথ সিং রাওয়াত মুখ্যমন্ত্রী হলেও আইনসভার সদস্য নন। ছ’মাসের মধ্যে তাঁর নির্বাচিত হওয়ার কথা। অথচ বিধানসভার মেয়াদ আর মাত্র সাত-আটমাস। এক বছরের কম মেয়াদে আবার উপনির্বাচন হয় না। তাহলে? দ্বিতীয় ফ্যাকড়া, ভোট হলেও অন্তর্কলহে যদি তিনি হেরে যান? কোথায় মুখ লুকোবে বিজেপি?
মোদি-শাহ জুটির গলায় কর্ণাটক খচখচ করছে। তাঁদের ইচ্ছামতো রাজ্য চালাতে নারাজ মুখ্যমন্ত্রী বি. এস. ইয়েদুরাপ্পা। কুড়ি বছর বয়স থেকে সংঘের সঙ্গে নাড়া বাঁধলেও কর্নাটকের রাজনীতিতে ইয়েদুরাপ্পার মূল পরিচয় অবিসংবাদী লিঙ্গায়েত নেতা হিসাবে। দলীয় অনুশাসন উপেক্ষা করে নিজের শর্তে সরকার চালিয়ে অভ্যস্ত ইয়েদুরাপ্পা বহিষ্কৃত হয়েও ফিরে এসে দলকে ক্ষমতাসীন করেছেন। দিল্লির চাহিদামতো রাজ্য শাসনের ধাত তাঁর নেই। বিরোধীদেরও কল্কে দেন না। রাজস্থানে যেমন বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, উত্তরপ্রদেশে যেমন যোগী আদিত্যনাথ, কর্ণাটকেও তেমন ইয়েদুরাপ্পাই বিজেপির সংকট ও সমাধান। এ. এইচ. বিশ্বনাথের মতো বিক্ষুব্ধ নেতারা তাঁকে সরানোর দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হয়ে এখন প্রকাশ্যে জানতে চাইছেন, কেন্দ্রীয় নেতারা ইয়েদুরাপ্পার লুটের ভাগীদার কি না। এ সত্ত্বেও মোদি-শাহ মৌন! সাহসী হতে পারছেন না।
রাজস্থানে বসুন্ধরাই সর্বেসর্বা। তিনিই শেষকথা। মধ্যপ্রদেশের মতো কংগ্রেসকে ভাঙিয়ে রাজস্থানে সরকার গড়তে মোদি-শাহ কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেই উত্তর সবার জানা। বসুন্ধরা চাননি অশোক গেহলটের পতন ঘটিয়ে ওম মাথুর বা অন্য কাউকে মোদি-শাহ মুখ্যমন্ত্রী করুন। বরাবরই রাজস্থানে তিনি চলেন তাঁর মতো। দিল্লিকে উপেক্ষা করেই। এখনও তার ব্যতিক্রম নেই। একই হাল মধ্যপ্রদেশে। শিবরাজ সিং চৌহানই সেখানে দলের শেষকথা। কৈলাস বিজয়বর্গীয় ও নরোত্তম মিশ্ররা দিল্লির আশীর্বাদ নিয়েও নিতান্তই দর্শক। ওদিকে অক্সিজেনের অভাবে ২৬ জন কোভিড রোগীর মৃত্যুর জন্য গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সাওয়ান্তকে হেনস্তা করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিশ্বজিৎ রানে। সাঁড়াশি আক্রমণ শানিয়েছেন বিদ্যুৎমন্ত্রী নীলেশ কাবরালও। গোয়া বা ত্রিপুরার মতো ছোট রাজ্যের অন্তর্কলহ মেটাতেও মোদি-শাহ নীরব দর্শক। দূতেরা ফিরছেন বিফল হয়ে। ক্ষোভ বাড়ছে ফেনার মতো।
ক্ষোভ প্রশমনে সম্ভাব্য সমাধান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ। কিন্তু তাই বা সুষ্ঠুভাবে দ্রুত করা যাচ্ছে কই? পনেরো মাস অপেক্ষায় রয়েছেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। তাঁরই মতো আশাবাদী বিহারের সুশীল মোদি, অসমের সর্বানন্দ সোনোয়াল, ওড়িশার বৈজয়ন্ত পান্ডা, উত্তরপ্রদেশের শরিক আপনা দলের অনুপ্রিয়া প্যাটেল। বাড়তি বিড়ম্বনা নীতীশ কুমারের গুরুত্বপূর্ণ দুই মন্ত্রকের দাবি। কিন্তু ওজনদার কোনও মন্ত্রকই যে বিজেপি ছাড়তে নারাজ! অতঃপর উপায়?
মোদি-শাহ জুটির মুঠো আলগা হচ্ছে। কারণ অনেক। কোভিডের তীব্র অসন্তোষ, অর্থনীতির নিম্নগামিতা, প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ফিকে করেছে। প্রচারের ঢক্কানিনাদ ঔজ্জ্বল্য ফেরাতে ব্যর্থ। জাতীয় স্তরে এখনও তাঁর মাথা উঁচু, যেহেতু বিপ্রতীপে উঁচু মাথা নেই। কিন্তু রাজ্যস্তরে তিনি যে তুরুপের তাস নন, হরিয়ানা, দিল্লি, ঝাড়খণ্ডের পর পশ্চিমবঙ্গও তা বুঝিয়ে দিল। রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত নেতারা তাই চেনা রাজনীতিতে খেলতে শুরু করেছেন দিল্লির হুকুমের দাস না হয়ে। একবছর আগেও মোদির বিজেপি এমন ছিল না। আটমাস পরে হাল কী দাঁড়াবে? উত্তর আসবে উত্তরপ্রদেশ থেকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.