এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেলেন হান কাং। ডেবোরা স্মিথের অনুবাদে, ২০১৫ সালে, তাঁর ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ পাঠক সমাজের নজর কেড়েছিল। গার্হস্থ্য হিংসার কাহিনি নিরলসভাবে বিধৃত করে চলেছেন তিনি। আখ্যানের মূল চরিত্ররাও প্রধানত নারী। এখানেই স্বরায়ন ঘটেছে। লিখছেন ভাস্কর মজুমদার।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার হাতেগোনা অ-ইউরোপীয় সাহিত্যিক পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর ইজরায়েলের শ্মুয়েল জোসেফ অ্যাগনন (১৯৬৬), জাপানের য়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৯৬৮) এবং কেনজিবুরো ও (১৯৯৪), মিশরের নাগিব মাহফুজ (১৯৮৮), চিনের গাও ঝিঙজিয়ান (২০০০) ও মো য়ান (২০১২), তুরস্কের (যদিও এ-দেশ ইউরোপের আংশিক অন্তর্ভুক্ত) ওরহান পামুক (২০০৬) আর এই বছর পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার হান কাং।
হান কাং (জন্ম ১৯৭০) নামটি গত দশ-বারো বছর আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি পাচ্ছিল। দক্ষিণ কোরীয় যে কোনও জিনিসেই এখন তথাকথিত আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া। ও-দেশের গানের দল ‘বিটিএস’ হোক, বা সিনেমা– বহির্বিশ্বের এখন নতুন মনোযোগ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি ধাবিত। এতে দক্ষিণ কোরিয়া দেশটিরও ভালরকম সহযোগিতা রয়েছে। সাহিত্যের কথাই যদি ধরা যায়, তবে উল্লেখ্য, দক্ষিণ কোরিয়া তাদের দেশে ‘কোরিয়ান লিটারেচার ট্রান্সলেশন ইনস্টিটিউট’ খোলে ১৯৯৬ সালে। আপন দেশের তো বটেই, বিদেশের শক্তিশালী অনুবাদকদেরও বিশেষ আর্থিক সহায়তা দেয়। বার্ষিক একটি সাহিত্য সম্মেলন সে-দেশে অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আন্তর্জাতিক সাহিত্যিকদের ভিড় থাকে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রকাশকরা তাঁদের সাহিত্য বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। বিদেশি ভাষার বিভিন্ন প্রকাশকদের সঙ্গে একযোগে কাজ করেন প্রতিনিয়ত।
হান কাংয়ের হালে যে আন্তর্জাতিক পরিচিতি, এর শুরু তাঁর ইন্টারন্যাশনাল ‘বুকার’ পুরস্কারপ্রাপ্তির পরপরই। ব্রিটিশ অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ নিজে প্রায় আট-দশ বছর কোরীয় ভাষার শিক্ষা নিয়েছেন। ২০১৫ সালে ডেবোরা স্মিথের ইংরেজি অনুবাদে যখন হান কাংয়ের ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়, সেই অনুবাদের চলন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, সেটাই যে ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারের পথ প্রশস্ত করেছিল, তা নিয়ে সন্দেহ থাকেনি। হান কাংয়ের সাহিত্য এখনও অবধি ১৪-১৫টি ভাষায় অনূদিত।
কবিতা দিয়ে তাঁর সাহিত্য-যাত্রা শুরু হলেও গদ্যকে বেছে নিয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে। এখনও পর্যন্ত একটি কাব্যগ্রন্থ, দু’টি প্রবন্ধের সংকলন, পাঁচটি উপন্যাসিকা এবং আটটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যের জন্য হান কাং বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। ১৯৯৮ সালে আইওয়া রাইটার্স রেসিডেন্সিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে কথালাপ করতে পারেন। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে যে নিজস্ব কণ্ঠস্বর তৈরি করেছেন, তা বেশ আলাদা– কারণ, তিনি নিরলসভাবে গার্হস্থ্য হিংসার কাহিনি তাঁর গল্পে, উপন্যাসে বিধৃত করে চলেছেন। গার্হস্থ্য হিংসার কথা বলতে আমরা বিব্রত বোধ করি।
মা-বাবার অত্যাচারের কথা বলতে সন্তানের দ্বিধা হয়। সঙ্গীর মানসিক পীড়নের বিরুদ্ধে আমরা মুখ খুলি না। বাড়ির কাজের লোকের প্রতিহিংসার কথা কেউ লিপিবদ্ধ করে না। কিন্তু হান কাং সেই চাপা পড়ে থাকা কথাগুলোই বলেন। তাঁর গল্প-উপন্যাসিকা-উপন্যাসের মূলচরিত্ররা অধিকাংশ নারী এবং সেসব যন্ত্রণার কাহিনি লেখা না-হলে ইতিহাসের প্রতি অন্যায় হয়। তাঁর সব সাহিত্যকর্ম এখনও অনূদিত হয়নি, কিন্তু যতটুকু হয়েছে, অন্তত ইংরেজির অনুবাদটুকু, আমাদের তাঁর সাহিত্যকে, সাহিত্যের ভাষা ও ভাবনার স্বকীয়তাকে সুস্পষ্টরূপে চিনতে শিখিয়েছে।
তিনি সাহিত্যে শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। তাঁর সাহিত্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবন উঠে আসে। শহরের মধ্যবিত্ত মানুষ তাঁর লেখায় ভিড় করে। গদ্যে কবিতার মতো দু’-চারটি আঁচড়ে বৃহৎ ছবি আঁকতে পারেন। যুদ্ধের কথা যখন বলেন, তখন তাঁর ন্যারেটিভে সেই ঘটনার বৃহৎ ক্যানভাসের পরিবর্তে সেই বিশেষ দিনে ছোট-ছোট জীবনে কী হয়েছিল, তা লেখার দিকে তাঁর মনোযোগ থাকে বেশি। হান কাংয়ের সাহিত্য ভীষণভাবে ব্যক্তিমানুষের কাহিনি। দূরে বসে লক্ষ করেন না জীবনের চলমানতা; সাহিত্য-সাহিত্যিক, জীবন-কাহিনি মিলেমিশে তখন একীভূত হয়ে যায়। সাধে নোবেল কমিটি হান কাংয়ের প্রশস্তিবাচনে বলেছে যে, ‘তাঁর তীব্র কাব্যিক গদ্য ঐতিহাসিক নানা ক্ষতের মুখোমুখি করায় আর প্রকট করে মানবজীবনের ভঙ্গুরতা’!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.