Advertisement
Advertisement

জয় ইউনেস্কোর জয়, বাংলায় যা পুজো হয়, দেশের কোথাও হয় না

দুনিয়া হাসছে। পৃথিবীর অসুখ সেরে গিয়েছে। এই আবহে বাংলায় দুর্গাপুজোর মেগা আয়োজন।

Durga Puja is worshiped in Bengal, does not happen anywhere in the country | Sangbad Pratidin
Published by: Krishanu Mazumder
  • Posted:August 24, 2022 1:46 pm
  • Updated:August 24, 2022 1:46 pm

কিংশুক প্রামাণিক: বাংলার দুর্গাপুজোর (Durga Puja) দিকে এবার গোটা বিশ্বের নজর। দু’-বছর করোনার করাল অধ্যায় পেরিয়ে পৃথিবীজুড়ে স্তব্ধ কার্নিভাল, উৎসবগুলি আবার শুরু হয়েছে। ভ্যাটিক্যানে ভিড় করছে মানুষ। টেমসের পারে বিগ বেনের ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে জনস্রোত। ইন্টারলেকেনের অপরূপ বরফচূড়া পর্যটকের চোখে উদ্‌ভাসিত। নিউ ইয়র্ক থেকে শিকাগো বাঁধনছাড়া উল্লাস। পাটায়া-ফুকেত-মরিশাস-সিডনির সৈকত আবার প্রেমের মৃগয়াক্ষেত্র। অতলান্তিক মহাসাগরে ভাসছে অসংখ্য প্রমোদ তরণী। ভারতের কেদারনাথ, অমরনাথ, কুম্ভ থেকে সাগরে লাখো-লাখো পুণ‌্যার্থীর ঢল।

দুনিয়া হাসছে। পৃথিবীর অসুখ সেরে গিয়েছে। মানুষ মুক্ত-স্বাধীনভাবে আবার পথে। ভাইরাসকে ভয় পাচ্ছে না কেউ। এই আবহে বাংলায় দুর্গাপুজোর মেগা আয়োজন। কলকাতার থিমের মণ্ডপে নতুন চমক দিতে প্রস্তুতি তুঙ্গে। কে কাকে টেক্কা দিতে পারে, তা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চরম লড়াই। কে কী ভেবেছেন একদম ভাঙছেন না। সবার বাজেট ঊর্ধ্বমুখী।

Advertisement

সোনিয়ার পছন্দের গেহলটই কংগ্রেসের পরবর্তী সভাপতি? বৈঠকের পর আরও জোরালো জল্পনা

মহামায়ার বাপের বাড়ি আগমনে এই বিপুল প্রস্তুতি মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত, দু’বছর ভাল করে কেউ পুজো করতে পারেনি। হাজারো বিধিনিষেধ। লকডাউনের ফেরে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও টান। অবস্থা সামলে উঠছে সবাই। তাই এবার যেন খিদে মেটানোর তাগিদ। মায়ের পুজোটা ‘ভাল করে’ করার বাঙালির চিরন্তন আবেগ।

দ্বিতীয় কারণটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার দুর্গাপুজোকে বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ বিশ্বের আবহমান ঐতিহ্যের (ইনট্যানজিব্‌ল কালচারাল হেরিটেজ) বন্ধনীতে স্থান দিয়েছে। নিঃসন্দেহে বিশাল স্বীকৃতি। এই সিদ্ধান্তে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গিয়েছে শারদোৎসবের কথা। এবারে কলকাতার পুজো দেখতে বিদেশিদেরও ঢল নামতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

স্বভাবতই এই বিশ্বজয়কে রাজ্যের স্বার্থে কাজে লাগাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় অগ্রণী। ‘ইউনেস্কো’-র সম্মাননাকে সামনে রেখে উৎসবকে বর্ণাঢ্য রূপ দিতে তিনি অভিভাবক। দুর্গতিনাশিনীর অাগমন
উপলক্ষে আলোর বেণুতে ভুবন মাতিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।

রাজ্যজুড়ে ৪০ হাজারের বেশি পুজো কমিটির সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন রাজসূয় আয়োজন। অনুদান বেড়ে হয়েছে ৬০ হাজার। বিদ্যুতের  বিলে ৬০ শতাংশ ছাড়। সঙ্গে আরও সুযোগ। একজন মুখ্যমন্ত্রী ৪০ হাজার পুজো কমিটির সঙ্গে মিটিং করছেন, প্রশাসনিক শীর্ষকর্তাদের পাশে নিয়ে উৎসবের দিনগুলিতে শৃঙ্খলারক্ষার দিক্‌নির্দেশ করছেন, সব ধর্মের মানুষকে শামিল করছেন, এই দৃশ্যে প্রমাণিত তঁার অবিসংবাদিত নেতৃত্ব।

১ সেপ্টেম্বর থেকেই বলা যেতে পারে পুজো শুরু। ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বর্ণাঢ্য মিছিল হবে কলকাতায়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে রানি রাসমণি রোড, মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। নানা রঙে, নানা সাজে, নানা আয়োজন নিয়ে সেই মিছিলে শামিল হবে প্রতে্যকটি পুজো কমিটি।
অর্থাৎ, রেড রোডে যে কার্নিভাল আমরা দেখি, তারই প্রথম পর্ব তিলোত্তমার রাজপথে। একই সময়ে একই ধরনের মিছিল হবে ব্লক থেকে জেলা স্তরেও।

রবীন্দ্রনাথের বাড়ি থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্রর মূর্তি। ভাবনাটা চমৎকার। ধর্মতলায় মিছিল শেষে সংবর্ধনা সভা। সম্মানিত করা হবে ‘ইউনেস্কো’-র প্রতিনিধিদের। থাকবেন শিল্প, সংস্কৃতি জগৎ-সহ সমাজের বিশিষ্টজনেরা। ১০ হাজার স্কুল ছাত্রছাত্রীদের কলতানে মাতবে মহানগরী।

এই কর্মসূচি কীভাবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রভাব ফেলেছে তার প্রমাণও মিলতে শুরু করেছে। মিছিলে যোগ দিতে আসছেন ইউনেস্কোর অন্যতম অধিকর্তা এরিক ফল্ট। নিজেই টুইট করে জানিয়েছেন, ‘আগামী সপ্তাহে আমাদের টিম কলকাতা যাবে। ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহে্য পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজো স্থান পেয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় সেই উদ্‌যাপনে আমরা অংশ নেব। বাংলার মানুষের কাছে বিরাট ঘটনা।’ এর পরও কি বিজেপি নেতৃত্ব দেশজুড়ে প্রচার করবে, বাংলায় দুর্গাপুজো হয় না?  

[আরও পড়ুন: প্রেমিকার সঙ্গে ধরা পড়ে স্ত্রীর হাতে জুতোপেটা, দল থেকে বহিষ্কৃত যোগীরাজ্যের বিজেপি নেতা]

প্রশ্নটা থেকেই যায় এই কারণে যে, গত কয়েক বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকার সম্পর্কে যতটা বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তা নজিরবিহীন। আমি এই কলামে আগে লিখেছি যে, পানাজিতে এক মহিলা সাংবাদিক আমায় প্রশ্ন করেছিল, ‘দিদির কি মুসলিম পরিবারে বিয়ে হয়েছিল?’ লখনউয়ে এক ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘বাংলায় কি সরকার পুরোটাই সিন্ডিকেটের হাতে? ওখানে না কি ভোট হয় না!’ মমতার ইমেজ খারাপ করার এই সুপরিকল্পিত প্রচারে যোগ করা হয় দুর্গাপুজো-ও।

আসলটা তাহলে কী? ঘটনাটি ছিল এরকম– একবার বিসর্জনের তিনদিনের মধে্য মহরম পড়ে। অর্থাৎ, একদিকে ঠাকুর নিয়ে শোভাযাত্রা হবে, অন্যদিকে লাঠি হাতে মহরমের মিছিল চলবে। প্রমাদ গোনেন মমতা। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। মহরমের দিন বিসর্জন বন্ধ করা হয়। তা যদি না করতেন, তাহলে একই সময়ে ধর্মীয় অাচারে নামতেন দুই সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ। কেউ সেই সুযোগে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ালে পরিণতি হত ভয়ংকর। দাঙ্গা বেধে যেতে পারত।

সঠিক প্রশাসকের মতোই মমতা ঝুঁকি নেননি। তাঁর সিদ্ধান্তে সম্প্রীতির জয় হয়েছিল। উৎসবমুখর বাঙালি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি এই ঘটনা মমতার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রচার করে। বলা হয়, বাংলায় নাকি দুর্গাপুজোয় বাধা দেয় সরকার। এই প্রচারে অন্য রাজে্যর কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হলেও বাংলায় প্রভাব পড়েনি। নির্বাচনের ফলেই সেটা প্রমাণিত।

দুর্গাপুজো বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বাংলার এমন কোনও গ্রাম নেই যেখানে পুজো নেই। হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ পুজো হলেও এই আয়োজনে ধর্মের চেয়ে সবসময় বড় হয়ে উঠেছে উৎসবের আবহ। তাতে শামিল হয় অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও। রাজ্যজুড়ে বহু পুজো কমিটিতে দেখা যায় মুসলিম, খ্রিস্টানদের। এই কারণে ইন্দোরে যে বৈঠকটি মুখ্যমন্ত্রী করলেন, তাতে হাজির ছিলেন মসজিদের ইমাম, গির্জার ফাদার, গুরুদ্বারের প্রতিনিধিরা।

সত্যি কথা বলতে, পুজোর উৎসবের আয়োজনে একটা রাজনৈতিক দিকও আছে। পাড়ায় পাড়ায় একতার প্রাচীর গড়া থেকে জনসংযোগ, সুযোগকে কাজে লাগান জনপ্রতিনিধিরা। সিপিএম পুজোর মধে্য সরাসরি জড়াত না। ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো ছিল শারদোৎসবের দিনগুলি। প্যান্ডেলের বাইরে বইয়ের স্টল দেওয়া হত। নেতারা পুজোর ধারে-কাছে যেতেন না। কালক্রমে পুজোর ব্যাপ্তি ঘটতে থাকে। আয়োজনের পুরো দখল নেয় অ-বাম শিবির। প্রথমে কংগ্রেস এবং এখন তৃণমূল নেতৃত্বের হাতেই চলে গিয়েছে পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজো কমিটিগুলি। সিংহভাগ পুজোর মাথা তৃণমূল নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক, জনপ্রতিনিধিরাই।

বিজেপি হিন্দুত্বর কথা বললেও পুজোর দখল নিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ। কলকাতায় কমিটিগুলিতে তারা প্রায় নিশ্চিহ্ন। জেলায় যেখানে জনপ্রতিনিধিরা আছে, সেখানে কিছুটা প্রভাব আছে। সর্বত্র বরং তৃণমূলই সব।

এই আবহে রাজ্যজুড়ে ৪০ হাজার পুজো কমিটির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান বৃদ্ধি, বিদ্যুতের বিলে ৬০ শতাংশ ছাড় উদ্যোক্তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। ভাঁড়ার শূন‌্য বলেও মমতার এই দানের পিছনে এক বড় উদ্দেশ্য আছে। এই প্রথম বাংলার পুজোর দিকে মন বহির্বিশ্বের। যা অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক। উৎসবে হাজার হাজার কোটি টাকা লগ্নি আগামী দিনে রাজ্যের পক্ষে শুভ হয়ে উঠতে পারে।

এই প্রেক্ষিতে গেরুয়া শিবিরকে অস্বস্তিতে ফেলেছে ‘ইউনাইটেড নেশন্‌স এডুকেশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন’ ওরফে ‘ইউনেস্কো’। প্যারিস থেকে তারা বার্তা দিয়ে বলেছেন, বাংলার দুর্গোৎসব এখন বিশ্বের আবহমান ঐতিহ্যের তালিকায়। আমরা তাতে শামিল হতে আসছি। এখানেই বিজেপিকে জবাব মমতার।

তিনি সহাস্যে এবার বলতে পারেন, ‘কারা যেন বলেছিল বাংলায় দুর্গাপুজো হয় না! আসুন দেখে যান। বাংলায় যা পুজো হয় দেশের কোথাও হয় না।’ জয় ইউনেস্কোর (UNESCO) জয়! 

[আরও পড়ুন: দলের আস্থা হারিয়েছেন, ত্রিপুরা তৃণমূলের রাজ্য সভাপতির পদ থেকে অপসারিত সুবল ভৌমিক]

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement