শেখা মাহরা। দুবাইয়ের রাজকুমারী। তিনি ইনস্টাগ্রামে স্বামীকে ‘তিন তালাক’ দিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। এভাবে ডিভোর্স কি দেওয়া যায়? কিছু প্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্ন। লিখছেন প্রহেলী ধর চৌধুরী।
প্রিয় স্বামী,
যেহেতু তুমি তোমার বান্ধবীদের নিয়ে ব্যস্ত,
এতদ্দ্বারা তাই আমি আমাদের বিচ্ছেদের ঘোষণা করলাম।
তালাক, তালাক এবং তালাক।
ভাল থেকো।
তোমার প্রাক্তন স্ত্রী।
সংক্ষিপ্ত, সুস্পষ্ট, আপাত সহজ এই ইনস্টাগ্রাম পোস্টের অন্তরে রয়েছে দ্রোহ। ১৬ জুলাই পোস্টটি করেছেন দুবাই রাজকুমারী শেখা মাহরা। দুবাইয়ের বর্তমান শাসক তথা সংযুক্ত আরব আমিরশাহির উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মহম্মদ বিন রসিদ ও তার ষষ্ঠতম (সম্ভবত) গ্রিক-বংশজাত স্ত্রী জো গ্রিগোরাকওসের কন্যার করা পোস্টটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে বিতর্ক।
ঠিক-ভুলের বাইনারিতে বিভক্ত আমজনতা প্রশ্ন তুলেছেন একের-পর-এক। ইসলামে কি মহিলারা ‘তালাক’ দিতে পারেন? ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে দেওয়া তালাক কি আদৌ ‘বৈধ’? পুরুষরাও যদি এভাবে তালাক দিতে শুরু করেন? তবে, সমর্থকরা অন্য কথা বলছেন। তাঁদের মতে, নিয়ম-শৃৃঙ্খলার নিগড়ে আবদ্ধ মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে ঘটে চলা দীর্ঘ নির্যাতনের প্রতিবাদ তো ঠিক এমনটাই হবে। সপাট, যুগান্তকারী। কারণ, নিয়মের আজ্ঞা মেনে তো আর নিয়মভাঙা যায় না, অদ্রে লদেঁ-র বাক্যটি তারই প্রমাণ– “The master’s tools will never dismantle the master’s house.” কাজেই বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ আলোচনার প্রয়োজন। কারণ, ইসলাম অন্যতম অপব্যাখ্যায়িত ধর্ম। সত্য-মিথ্যার আবছায়া কাটানো সেজন্য জরুরি।
শেখা মাহরা। পুরো নাম শেখা মাহরা বিন্ত মহম্মদ বিন রসিদ আল মাখতুম। গত বছর মে মাসে, আমিরশাহির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শেখ মানা-র সঙ্গে বিয়ে হয় তার। সুন্দরী এই রাজকুমারী তার স্বাধীনচেতা মনোভাব, কেতাদুরস্ত ফ্যাশন, ও মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতা-উন্নয়নের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বহু দিন ধরেই আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত নাম। শুধু ইনস্টাগ্রামেই তাঁর ‘ফলোয়ার’-সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। একাধারে শিক্ষিত ও সুন্দরী, জনপ্রিয় ও ব্যক্তিত্বময়ী এই রাজকন্যার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জনমানসে কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক।
মুশকিল হল, সেই কৌতূহল নিরসনের মতো যথেষ্ট তথ্য কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তার অবশ্য কারণও আছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির রাজ-পরিবারের নিয়মানুদেশ মাফিক, এই পরিবারের সদস্যদের, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা মানা। সংবাদমাধ্যমও চাইলে রাজ-পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যখন-তখন ‘খবর’ করতে পারে না। এই তথ্যাভাব বিষয়টি নিয়ে জল্পনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলা বাহুল্য। বিচ্ছেদ পদ্ধতিটির বৈধতার পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে, ব্যক্তিগত খবর না-প্রকাশের রাজাজ্ঞা পেরিয়ে রাজকুমারী তাঁর স্বামীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ইঙ্গিতবাহী উপর্যুপরি বিবাহবিচ্ছেদ ঘোষণার এই পোস্টটি করলেনই-বা কেন, আর তার ফলাফলই বা কী হল।
নিয়ম মতে দেখলে, পদ্ধতিটির বৈধতা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন ওঠারই কথা। এক) ইসলামে ‘তালাক’ দেওয়ার অধিকার রয়েছে কেবল পুরুষের। মহিলারাও বিচ্ছেদ চাইতে পারেন, তবে তা ‘তালাক’ এর মাধ্যমে নয়, অন্য পদ্ধতিতে। প্রথম পদ্ধতিটির নাম ‘তালাক-উল-তাফইজ’। বিয়ের সময় বিবাহ-চুক্তির দলিল বা ‘নিকাহনামা’-র মাধ্যমে কোনও স্বামী চাইলে স্ত্রীকে তালাকের অধিকার হস্তান্তরিত করতে পারেন, এবং তা ব্যবহার করে পরবর্তী কালে স্ত্রী চাইলে স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারেন। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হল ‘লিয়ান’। স্বামী তাঁর স্ত্রী-র বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনলে যদি তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে স্ত্রী ডিভোর্সের দাবি করতে পারেন। এছাড়া রয়েছে ‘খুলা’ ও ‘মুবারাত’– এই দু’টি পদ্ধতি। এগুলি ব্যবহার করেও কোনও মুসলিম স্ত্রী তাঁর স্বামীর থেকে বিচ্ছেদ চাইতে পারেন, যদিও তা ফলপ্রসূ হবে– স্বামী রাজি হলে তবেই।
অর্থাৎ শেষের এই দু’টি বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়ায়, বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়, কেবলমাত্র ‘পারস্পরিক বোঝাপড়া’ বা ‘মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং’-এর ভিত্তিতেই। দুবাই রাজকন্যা শেখা মাহরার নিকাহনামায় তাঁর স্বামী-কর্তৃক তাঁকে ইনস্টাগ্রাম পোস্টের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া আছে কি না জানা নেই। তবে তা থাকার সম্ভবনা কম। আর, মাহরা বাকি যে তিনটি পদ্ধতির কোনওটিই অনুসরণ করেননি, তা-ও স্পষ্ট। দুই) ওই ইনস্টাগ্রাম পোস্টে শেখা মাহরা যে ‘তিন তালাক’ পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন, তা সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-সহ বিশ্বের ২৩টি দেশে লিঙ্গ-নির্বিশেষে আইনত অবৈধ।
১৯২৯ সালে প্রথম মিশর থেকে শুরু করে এই ‘তিন তালাক’ প্রথা একে-একে ‘অবৈধ’ ঘোষিত হয়েছে সুদান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইরাক, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাস, জর্ডন, আলজেরিয়া, ইরান, ব্রুনেই, মরক্কো, কাতার-সহ সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ভারতে। তিন) মনে রাখতে হবে যে, ‘তিন তালাক’ কিন্তু ইসলামেরও একটি অসমাদৃত ও নিম্নমানের বিবাহবিচ্ছেদ পদ্ধতি। ইসলাম-মতে, কোনও স্বামী তাঁর স্ত্রী-কে যে-চারটি পদ্ধতিতে বিচ্ছেদ দিতে পারেন, যথা ‘তালাক-উল-সুন্নত’ (যা ‘তালাক-এ-আহাসান’ এবং ‘তালাক-এ-হাসান’ দুই পদ্ধতিতে বিভক্ত), ‘তালাক-উল-বিদ্দত’, ‘ইলা’ এবং ‘জিহর’। এর মধ্যে ‘তিন তালাক’ বা ‘তালাক-উল-বিদ্দত’ পদ্ধতিটি তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়িত হওয়ার অপগুণের সুবাদেই ইসলামে সবচেয়ে নিম্নমানের বিবাহবিচ্ছেদ পদ্ধতি বলে পরিগণিত হয়। বাকি পদ্ধতিতে যেহেতু বিচ্ছেদ পেতে ন্যূনতম ৯০ দিন সময় লাগে, অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার একটা সময় দেওয়া হয়, তাই সেগুলিকে ইসলামে উচ্চমার্গের পদ্ধতি বলে মানা হয়।
ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা করা যায় কি না, সেই বিতর্ক প্রসঙ্গে দু’-চারটি কথা বলা প্রয়োজন। ইসলামের ধ্রুপদী মতানুযায়ী, মৌখিক বা লিখিত– উভয় প্রক্রিয়াতেই তালাক দেওয়া সম্ভব। এখনকার দিনের নিত্য-ব্যবহৃত ইমেল, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, ভয়েস রেকর্ডিং ইত্যাদি যেহেতু হাতে লেখা বা মুখে বলার-ই আধুনিকতম মাধ্যম, তাই ধ্রুপদী মতের আধুনিক সংস্করণ হিসাবে ইসলাম তা ‘বৈধ’ বলেই ধরে নিয়েছে। ইসলামের শরিয়তি আইন জনসংযোগের এসব আধুনিক মাধ্যমকে পরিবর্তিত সময়ের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই শরিয়তি আইনের আওতাধীন তালাকের যে-যে পদ্ধতির কথা ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে ‘তালাক-উল-সুন্নত’ বা তার অন্তর্ভুক্ত ‘তালাক-এ-হাসান’ বা ‘তালাক-এ-আহসান’ পদ্ধতির বেলায় ইমেল, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা টেক্সট মেসেজ-কে বিচ্ছেদের ‘মাধ্যম’ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বহু দিন ধরেই।
‘তালাক-উল-বিদ্দত’-এর ক্ষেত্রেও এই ব্যবহার ‘বৈধ’ হবে, যদিও ‘তিন তালাক’-কে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছে বিশ্বের ২৩টি দেশ। রইল বাকি দুবাই রাজকন্যার বিবাহবিচ্ছেদের নির্দিষ্ট ঘটনাটি। এখানে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকে ‘অবৈধ’ বলেই ধরতে হচ্ছে– কেননা, প্রথমত তিনি মহিলা, এবং দ্বিতীয়ত তিনি সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ‘তিন তালাক’ পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন।
ইন্টারনেট ব্যবহারের বিস্ফার; প্রযুক্তিধন্য স্মার্টফোনের আধিক্য; হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যমের সূচনা ঘটেছে মানুষে-মানুষে দূরত্ব কমানোর লক্ষ্যে। কিন্তু তা যদি উল্টে হয়ে দঁাড়ায় বিচ্ছেদের সহজতর মাধ্যম, তাহলে আইনত সেটা সিদ্ধ হলেও, জীবনের প্রবাহে তা যে অভিসম্পাত, বলার অপেক্ষা রাখে না। আর রাজ-পরিবার, ক্ষমতা, আইন, সমাজ– সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে, সদ্য মা হওয়া যে-মেয়ে বেছে নিয়েছেন স্বনির্বাচিত বিপ্লবের পথ, তৈরি করেছেন ব্যক্তিগত নৈতিকতার প্যারামিটার এবং পৃথিবীর নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলেছেন ‘I Divorce You’– শেষ অধ্যায়ে তঁার জন্য এক কুর্নিশ। ঠিক-ভুল আর সাদা-কালোর ছক পেরিয়ে তঁার তেজকে যেন সম্মান জানিয়ে আমরা বলতে পারি– ‘সাবাশ রাজকন্যে’।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.