সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে বিপ্লবী গোষ্ঠীর সংযোগ ছিল ছাত্রাবস্থা থেকেই। গোপন প্রকৌশলের দিকে ঝোঁক সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক কার্যকলাপকে বরাবর প্রভাবিত করেছে, হয়ে উঠেছে চালিকাশক্তি। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তো অনুসরণ করতই, এমনকী কংগ্রেস নেতৃত্বও তাঁকে ‘ফলো’ করতে ছাড়েনি। জার্মানদের সঙ্গে সুভাষের যোগাযোগের খবর পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল গান্ধীর কাছে। বলা বাহুল্য, গান্ধী কোনও দিনই স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লববাদী গোপন পদ্ধতির সমর্থক ছিলেন না, মনে করতেন বরং এই ধরনের গোপনীয়তা সত্যাগ্রহের পরিপন্থী। লিখছেন চন্দ্রচূড় ঘোষ
সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে সর্বাধিক কম আলোচ্য দিকগুলির একটি হল, যে কোনও গোপন ক্রিয়াকলাপের প্রতি তাঁর তীব্র ঝোঁক ছিল বরাবর। আর-পাঁচটা বিষয়ের মতো এই বিষয়েও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সুভাষের মতানৈক্য ছিল প্রকট।
ছাত্রাবস্থা থেকেই বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সুভাষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই সুবাদে তিনি এসব গোষ্ঠীর গোপন অপারেশনের কৌশলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এই প্রবণতার পুনরাবৃত্তি তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক কর্মজীবনের অন্যতম চাবি-বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত ব্রিটিশ এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অফিসাররাই প্রথম সুভাষচন্দ্রর এই কম-আলোচিত দিকটিকে পর্যাপ্তভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যে সমস্ত গুপ্তচর তাঁকে নজরে রাখার কাজে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা তাঁকে যথাসম্ভব চোখে-চোখে রাখতেন। সুভাষচন্দ্র নিজেও সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তবে, এই ধারাবাহিক বিড়াল-ইঁদুর খেলায়, সুভাষ তাঁর সীমিত অবলম্বন নিয়েও শত্রুর চোখে ধুলো দিতে অসাধারণভাবে সফল হয়েছিলেন বহুবার।
সারাক্ষণ গুপ্তচরের ঘেরাটোপে থাকার ঝামেলা নেতাজিকে প্রথমবার পোহাতে হল ১৯২৪ সালে। কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে যখন তিনি নিযুক্ত হলেন, তখন রাজনীতির ময়দানে তিনি সবে নেমেছেন। তবু, সিক্রেট এজেন্টদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হল তাঁকে।
‘রাষ্ট্রপতি’ পদে নিযুক্ত হওয়ার পর তাঁর উপর নজরদারি একইরকম বহাল তো রইলই, উল্টে আরও জোরদার করা হল। কারও কারও মতে, তাঁর কার্যকলাপ সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য গোয়েন্দা সংস্থা হাজির করেছিল, যা আদপে গান্ধী ও কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্বের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রর লাগাতার বিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে, নজরদারি ও তার পরিণামে শুধুমাত্র ব্রিটিশরাই জড়িত ছিল না! খাস কংগ্রেসি ও তৎকালীন বম্বের মুখ্যমন্ত্রী কে. এম. মুনশি, যিনি ছিলেন গান্ধীর অহিংসবাদের একজন কট্টর অনুসারী, তিনিও এ বিষয়ে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন বিস্তর।
১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে ‘বম্বে সেন্টিনেল’-এ প্রকাশিত ‘ক্লিয়ার আপ নাৎসি কব-ওয়েব ইন ইন্ডিয়া’ ও ‘চ্যালেঞ্জ টু কাম আউট ইন দ্য ওপেন’ হেডলাইনের দু’টি খবরে সরকারি মহলে প্রভূত তোলপাড় সৃষ্টি করে। নিবন্ধে ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি’-র সদস্য ডক্টর অসওয়াল্ড উর্চ-কে বাণিজ্যিক কাজের অজুহাতে ভারতে গুপ্তচরবৃত্তি এবং প্রোপাগান্ডা চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হল। এই নিবন্ধ দু’টির ভিত্তিতে কংগ্রেসের সাংসদ মোহনলাল সাক্সেনা ও এস. সত্যমূর্তি ১৯৩৮ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সংসদীয় অধিবেশনে প্রশ্ন তুললেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলির উপর ভার পড়ল উর্চ ও তঁার সংস্থার কার্যকলাপের উপর নজরদারি রাখার। কিন্তু সরকার চেয়েছিল এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে যে, এই বিষয়ে তারা বিশেষ আগ্রহী নয়, পাছে তাতে ভারতের নাৎসি এজেন্টরা সতর্ক হয়ে ওঠে।
১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর, সুভাষচন্দ্র যে উর্চের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তা গোয়েন্দা সংস্থার নথিতে রয়েছে। প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলি, কলকাতায় নেতাজির এক বিপ্লবী সহযোগী ও বাংলার বিধানসভার সদস্য– তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে কীভাবে সুভাষচন্দ্র বম্বেতে জার্মান কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনে দেখা করতেন:
…১৯৩৮ সালে, কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন, বম্বেতে কিছুটা সময় নেতাজি কাটিয়েছিলেন। সেই সময় জার্মান কনসালের সঙ্গে তাঁর রীতিমতো যোগাযোগ ছিল। কনসালের সঙ্গে দেখা করার সময় নেতাজি অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন; যেমন, দুপুরে বন্ধুর বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার পর তিনি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতেন একান্তে। ফলে দুপুরের অতিথিরা আপনে আপ বিদায় নিত। তারপর তিনি পরিচয় গোপন করার জন্য যথাযথ ছদ্মবেশ ধারণ করে অন্য এক বন্ধুর বাড়িতে কনসালের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে যেতেন, পথে বদলে নিতেন ট্যাক্সি।
এই ধরনের গল্পে সত্যের উপাদান কিছু আছে বইকি, তবে স্পাই থ্রিলার নির্মাণের জন্য উপাদানই বেশি। এই ধরনের বিবরণগুলিতে স্পষ্টতই অনেক কল্পনার অলংকার রয়েছে, যা নেতাজিকে করে তুলেছে আরওই রহস্যময় এক ব্যক্তিত্ব। তবে পুরোটাই যে কল্পনাপ্রসূত নয়, তার প্রমাণ বম্বের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কে. এম. মুনশির পরবর্তীকালের কিছু লেখায় তা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে:
এমন অনেক গল্প রয়েছে যে, তিনি লোকজনের সঙ্গে দেখা করতেন ছদ্মবেশে, এমনকী ছদ্মবেশে বেরিয়েও পড়তেন যখন তখন। ভারত সরকার গান্ধীজি ও সর্দারের (বল্লভভাই প্যাটেল) সঙ্গে আমার সম্পর্ক সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়ার কারণে ভাবত, আমি গান্ধীজিকে গোপন বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম। সেই সুবাদে, আমাকে কিছু গোপন রিপোর্ট পাঠায় তারা। সেখানে উল্লেখ ছিল, নেতাজি কলকাতায় জার্মান কনসালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং এমন কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন, যা যুদ্ধের সময়ে জার্মানিকে তাঁর উপর অনেকখানি নির্ভরশীল করে তুলবে। আমি গান্ধীজির কানে খবরটি পৌঁছে দিতে তিনি যথারীতি খুবই অবাক হয়েছিলেন।
সম্ভবত এই ধরনের চোরাগোপ্তা কর্মকাণ্ড এবং জার্মান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসূত্রের বিষয় গান্ধীজিকে প্ররোচিত করেছিল। যার ফলে, সুভাষচন্দ্রর কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা হয়ে উঠেছিল ক্ষীণ। গান্ধীজি কোনও দিনই বিপ্লবী সমাজের চোরাগোপ্তা পদ্ধতির প্রশংসক যে ছিলেন না, ১৯৩৩ সালে তাঁর এক ব্যক্তিগত মতামতে তা প্রকাশ পায়। গোপন অভিযানের সম্বন্ধে তাঁর অভিমত ছিল- এই ধরনের গোপন অভিযানের মধ্যে সহজাতভাবে কোনও ভুল নেই। সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় গোপন প্রচার চালানোর উদ্দেশ্য যে মহৎ ও বিপ্লবীদের তীব্র বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পায়, তা আমি সর্বৈবভাবে মেনে নিচ্ছি। কিন্তু গোপনীয়তা সত্যাগ্রহের পরিপন্থী এবং তা অগ্রগতি ব্যাহত করে। এটি নিঃসন্দেহে জনগণের বর্তমান মনোবলহীনতার ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় অবদান রেখেছে। আমি জানি যে গোপনীয়তার উপর নিষেধাজ্ঞার ফলে এমন কিছু কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যাবে, যা কংগ্রেসকে জনসাধারণের নজরে রাখার ক্ষেত্রে জরুরি। কিন্তু এখানে উপকারের পাশাপাশি আশঙ্কার যুক্তিও রয়েছে বিস্তর, কারণ তা সত্যাগ্রহের চেতনা বহির্ভূত এবং আন্দোলনের ফলপ্রসূতাকে খর্ব করে।’
গান্ধীর যুক্তির বিপরীত দৃষ্টিকোণ সেই সময়ের বাঘা বিপ্লবী রাসবিহারী বসু কলমে উচ্চারিত হয়। ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে নেতাজিকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেন– পরাধীন একটা দেশে কোনও সাংবিধানিক ও আইনি সংস্থাই কখনও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে না… ব্রিটিশদের নজরে যারা অসাংবিধানিক বা অবৈধ সংগঠন, তারাই দেশকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কংগ্রেস একটি অসাংবিধানিক সংস্থায় পরিণত হওয়ার ফলেই তারা বিপুল প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।
এখানেই একদিকে গান্ধী ও অপর দিকে নেতাজি এবং অন্যান্য বিপ্লবী সমাজের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য। সরকার কর্তৃক গোপনে সরবরাহ করা গোয়েন্দা সংস্থাদের কাজে লাগানোর মধ্য দিয়ে গান্ধীজি তাঁর নীতি লঙ্ঘন করেছিলেন কি না তা তর্কসাপেক্ষ, তবে পরবর্তী বড় মাপের গণ-আন্দোলন– যেমন, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই সত্যকে উপেক্ষা করা কঠিন। কারণ, এর সুদূরপ্রসারী বিস্তারের এক অন্যতম কারণ: এই অন্দোলনও পরিচালিত হয়েছিল গোপনেই। গান্ধীজি পরবর্তীতে এই আন্দোলন প্রতাখ্যান করলেও, তঁার নেতৃত্বে থাকা দল এই আন্দোলনের কৃতিত্ব জাহির করতে পিছপা হয়নি।
তথ্যসূত্র
১. ফর দ্য মুনশি অ্যাফেয়ার, সুগত বসু,
হিজ ম্যাজেস্টি’স অপোনেন্ট, পৃষ্ঠা ১৫৪
২. ফাইল নম্বর ২২/৫২/৩৮-পলিটিক্যাল অ্যান্ড ২২/৫৭/৩৮-পলিটিক্যাল, হোম ডিপার্টমেন্ট, পলিটিক্যাল সেকশন, ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিউ দিল্লি
৩. এ. কে. মজুমদার, অ্যাডভেন্ট অফ ইন্ডিপেনডেন্স, পৃষ্ঠা ১৫৫
৪. মজুমদার,অ্যাডভেন্ট অফ ইন্ডিপেনডেন্স, পৃষ্ঠা ৪০৮-৪১২
৫. দ্য ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার ১৯৩৩, ভলিউম ২, পৃষ্ঠা ৩৩৩
৬. লেটার ফ্রম রাসবিহারী বোস, ২৫ জানুয়ারি ১৯৩৮, নেতাজি: কালেক্টেড ওয়ার্কস, ভলিউম ৯, এডিটেড বাই এস. কে. বোস অ্যান্ড এস. বোস, পৃষ্ঠা ২৫৪
লেখক বিশিষ্ট নেতাজি গবেষক, ‘মিশন নেতাজি’-র প্রতিষ্ঠাতা
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.