কলকাতার বাতাসের গুণমান ‘ন্যাশনাল অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড’-এর বেঁধে দেওয়া নিরাপদ সীমার বাইরেই থাকে বছরের ১০৩ দিন। দিল্লিতে সংখ্যাটি ১৩৯ দিনে গিয়ে পৌঁছয়। কলকাতায় শীত যেভাবে ক্ষণস্থায়ী হচ্ছে– ভয় লাগে। কলমে মধুরিমা পট্টনায়ক
কলকাতায় শীতের দেখা মেলে না বিগত কয়েক বছর ধরে। গত বছরের গ্রীষ্মকালে যখন তাপমাত্রা অসহনীয়ভাবে বেড়েছিল, যখন গুনে-গেঁথে একটি বা দু’টিবার কালবৈশাখীর দেখা পেয়েছিলাম আমরা, আর বর্ষাকাল চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে কেটেছিল- তখন অনেকেই আবহাওয়ার এহেন খামখেয়ালিপনায় বিস্মিত হয়েছিল। কিন্তু এর ‘কারণ’ যে বিশেষ অজানা, তা-ও নয়।
‘বোস ইনস্টিটিউট’-এর সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, কলকাতা-সহ বঙ্গে দূষণের মাত্রা ৮ শতাংশ বাড়তে চলেছে। সে-দূষণের মূল কারণ হিসাবে দায়ী করা হয়েছে ‘পার্টিকুলেট ম্যাটার’- অর্থাৎ খুব ক্ষুদ্র কণাসমূহকে- বাতাসে যা ভেসে বেড়ায়। এখন প্রশ্ন- এই পার্টিকুলেট ম্যাটারের সিংহভাগ কোথা থেকে আসে? যানবাহন ধোঁয়ায় মোড়া যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে উগরে দেয়, তা-ই এই দূষণের উৎস।
গণ-পরিবহণের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ালে এবং ব্যক্তিগত বাহনের উপর নির্ভরশীলতা কমালে হয়তো কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনের পরিমাণ বাতাসে বেশ খানিক কমবে। কলকাতা শহরে সাইকেল ব্যবহারের পরিসর নেই। কিন্তু গণ-পরিবহণ ব্যবস্থা অনুন্নত- সেটি বলা চলে না। ২০১৩-’২১ সালের মধ্যে কলকাতায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। আর, চার চাকা ও দু’চাকা গাড়ির ব্যবহার বেড়েছে যথাক্রমে ৩ এবং ৭ গুণ। যেটুকু রাস্তা অনায়াসে গণ-পরিবহণের সাহায্যে যাওয়া যেত, সেখানে এখন ওলা, উবার কিংবা হলুদ ট্যাক্সির দাপট।
কলকাতায় এই মুহূর্তে সবুজের পরিমাণ ১.৮ বর্গ কিলোমিটার। সমগ্র মহানগরীর আয়তনের ১ শতাংশেরও কম। অসহনীয় এক-একটা গ্রীষ্মকাল পেরনোর পরেও কথায়-কথায় শহরে গাছ কাটা পড়ে। যে-গাছগুলির বেড়ে উঠতেই সময় লেগেছিল ১৫-২০ বছর, রাস্তা চওড়া করা, ফুটব্রিজ বা বাস স্টপ বানানোর জন্য তাদের কেটে ফেলা হয় নির্দ্বিধায়। ঝড়ে উপড়ে যায় বহু বনস্পতি। এই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন শহরে গত কয়েক বছরেই কী পরিমাণ বহুতল বৃক্ষনিধন করে মাথাচাড়া দিয়েছে, ভাবলে ভয় করে।
কয়েক বছরে বঙ্গে ১৪ হাজার হেক্টর গাছের আবরণ ধ্বংস হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া স্টেট অফ ফরেস্ট’ সূত্রে জানা যাচ্ছে, কলকাতা শহরে ৩০ শতাংশ গাছগাছালি কমেছে ১০ বছরের মধ্যে। অন্যদিকে, এ-রাজ্যে প্রাকৃতিক অরণ্যে ৫০ শতাংশের বেশি গাছের আবরণ কমেছে ২০১৩-’২১ সালের মধ্যে। ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’ সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত ৪ সপ্তাহে এই রাজ্য থেকেই ২,৬৮৮ বার অরণ্য ধ্বংসের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
বোস ইনস্টিটিউট আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে। যানবাহন তো বটেই, কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে কঠিন জ্বালানি বা ‘সলিড ফুয়েল’ এবং বর্জ্যপদার্থ দহনের ফলেও দূষণ বাড়ার সম্ভাবনা প্রভূত। কলকাতায় খোলা পরিবেশে আবর্জনার দহন বহু আগেই নিষিদ্ধ। তা-ও শহরের বিভিন্ন কোণে আবর্জনার স্তূপ জ্বালানো নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। বোস ইনস্টিটিউটের গবেষকরা সতর্ক করছেন, ২০২৩ সালে এ-রাজ্যে বায়ুদূষণের সিংহভাগ দায় বর্তাবে আবর্জনা দহনের জন্য। কয়লার মতো কঠিন জ্বালানি দহনের ঘটনা তো থাকছেই।
এই মুহূর্তে কলকাতার বাতাসের গুণমান ‘ন্যাশনাল অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড’-এর বেঁধে দেওয়া নিরাপদ সীমার বাইরেই থাকে বছরের ১০৩ দিন। দিল্লিতে যে-সংখ্যাটা ১৩৯ দিনে গিয়ে পৌঁছয়। পরিবেশবিদদের মতে, কলকাতার অবস্থা দিল্লির মতো হতে খুব বেশিদিন লাগবে না, যদি এভাবে চলতে থাকে। গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার বাতাসের গুণমানের সূচক অত্যন্ত খারাপ ছিল।
এসব জেনেও আমরা কেতাদুরস্ত জুট ব্যাগ কিনে ফ্যাশনচর্চায় মগ্ন হব। আর, বাজার-দোকান করার সময় পলিপ্যাকেই আস্থা রাখব। জলবায়ু পরিবর্তনকে এ-দেশে সংকটের নজরে দেখা হয় না এখনও। এর মূল্য আমাদেরই চোকাতে হবে। তৈরি তো প্রত্যেকে?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান-বিষয়ক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.