দিঘায় উন্নয়নের হিড়িক। কিন্তু ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস রুখতে প্রয়োজনীয় ঘন ঝাউবন কেটে সাফ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। উপকূলবর্তী জনপদগুলি কেমন আছে? লিখলেন আবীর গুপ্ত।
তালগাছের উচ্চতাকে হার মানিয়ে সমুদ্রের ঢেউ তালগাছ টপকে যদি আছড়ে পড়ে কোথাও, তাহলে সেই অঞ্চলের কী অবস্থা হবে? ২০২১ সালের ২৬ মে কয়েকজন নির্ভীক রিপোর্টার এবং ফোটোগ্রাফারদের সৌজন্যে পৃথিবীর মানুষ দেখেছিল সেই দৃশ্য– দিঘা (Digha) ও বকখালির উপকূলবর্তী অঞ্চলে।
পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে বহু সাইক্লোন গোত্রের ঝড় আছড়ে পড়েছে। তার মধ্যে শেষ উল্লেখযোগ্য– ২০১৯ সালের মে মাসে আছড়ে পড়া ‘এক্সট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোন’ ‘ফণী’, যার তাণ্ডব চলে ১১ দিন ধরে। এরপর করোনার সময় দক্ষিণবঙ্গ-জুড়ে ২০২০ সালের ২১ মে ‘আমফান’-এর তাণ্ডব ও ক্ষয়ক্ষতির কথা মনে হয় না মানুষ ভুলতে পারবে। এই ভয়ংকর ঝড়ের জন্য সরকার এবং মানুষ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। কলকাতাও সেই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মানুষ ঠেকে শেখে, তাই ২০২১ সালের ২৬ মে যখন ‘সুপার সাইক্লোন’ ‘ইয়াস’ আছড়ে পড়ে ওড়িশা উপকূলে, তার দিন কয়েক আগে থেকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে মৃত্যুকে অনেকটাই ঠেকানো গিয়েছিল। এই ইয়াসের সময়েই সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস উপকূলবর্তী শহরগুলিকে তছনছ করে দেয়। সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতা উঁচু তালগাছের মাথাকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল। সমুদ্রের ভাঙন রোখার জন্য ওল্ড দিঘার কংক্রিটের বঁাধনের নিচে যে বিশাল বড় বড় পাথর রাখা আছে, সেগুলোকেও তুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল দূরে।
সুপার সাইক্লোনের সময় হাওয়ার গতিবেগ, আর সেই সঙ্গে তৈরি হওয়া সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস কতটা ভয়ংকর হতে পারে– তার কয়েকটা নমুনা দেওয়া যাক। ১৯৯১ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনারা উপকূলে ঝড়ের তাণ্ডবে সৃষ্ট ভূ-প্রকৃতি ‘স্টাডি’ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ১৯৯০ সালের ৪ মে ‘বব-০১’ যখন অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে আছড়ে পড়ে তখন প্রায় হাজার খানেক মানুষ প্রাণ হারায়, ক্ষয়ক্ষতিও পরিমাণও ছিল বিস্তর।
১৯৭৬-’৭৯ সালের মধ্যে হওয়া ঝড়ের মধ্যে সুপার সাইক্লোন ‘০৬ বি’ এতটাই ভয়াবহ আকার নিয়েছিল যে, সরকারি হিসাবে ১০,০০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ঝড়ের দাপটে একটি ব্রিটিশ জাহাজ উড়ে এসে পড়েছিল শক্ত জমিতে। পাথরের গঠন বোঝার জন্য নদী, হ্রদ বা সমুদ্রের পাড়ে কীভাবে বালির গঠন ভিন্ন হয়, তা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। এই গবেষণার মাধ্যমেই লক্ষ-কোটি বছর আগে তৈরি হওয়া পাথর কীভাবে তৈরি হয়েছে, তা জানা যায়। একইভাবে কয়লা তৈরি হওয়ার সময়ও ভাঙা গাছের গুড়ি, কাণ্ড, পাতা এসব এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে জমা হওয়া দরকার।
অধিকাংশই একমত যে, ‘সুপার সাইক্লোন’, ‘হারিকেন’ জাতীয় ভয়ংকর ঝড় গাছপালা উপড়ে ফেলে আর সেগুলোকে নদী, হ্রদ বা সমুদ্রের ঢেউ টেনে নিয়ে গিয়ে আরেক জায়গায় জড়ো করে। এই পদ্ধতি চলতেই থাকে এবং পরে লক্ষ লক্ষ বছর বাদে প্রচণ্ড চাপে আর তাপে তা পরিণত হয় ‘পিট’ কয়লায়। পরবর্তীতে পিট থেকে বিটুমেন জাতীয় কয়লায়। ১ ফুট পুরু কয়লার স্তরের জন্য ১২ ফুট পুরু পিট দরকার (ফ্রান্সিস, ১৯৬১)। এই ১২ ফুট পুরু পিট তৈরি হতে সময় লাগে হাজার হাজার বছর। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় ৫০ ফুটেরও বেশি পুরু কয়লার স্তর পাওয়া যায়। যার জন্য প্রয়োজন ৬০০ ফুট পুরু পিট। এত পুরু পিট কয়লার আস্তরণ তৈরি হতেই কয়েক কোটি বছর লেগে যাওয়ার কথা। তাই অনুমান করা হয় অন্য কোনও উপায়ে অতি দ্রুত এই পুরু পিটের স্তর তৈরি হয়েছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, এটা একমাত্র তখনই সম্ভব যদি কোনও অতি ভয়ংকর সাইক্লোন জাতীয় ঝড়ে কোনও ঘন জঙ্গলের অধিকাংশ গাছ উপড়ে পড়ে এবং সমুদ্র বা নদীর প্রভাবে অন্য কোথাও একত্র হয়। এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, একটা ঝড় কতখানি ভয়ংকর হতে পারে বা উপকূলবর্তী অঞ্চলে তার কী প্রভাব পড়তে পারে তা বোঝানো।
গত সাত-আট বছরে দিঘা-সহ উপকূলবর্তী অঞ্চলে যা উন্নয়ন হয়েছে, তা অকল্পনীয়। কিন্তু উন্নয়নের সময় প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নজর দেওয়া হয়েছে তো? যথেচ্ছভাবে তৈরি হয়েছে হোটেল বা অন্যান্য বিল্ডিং যা দিঘা-সহ অন্যান্য শহরকে ঠেলে দিয়েছে বিপদের মুখে। এই বিপদের পূর্বাভাস কিন্তু বহু বছর আগেই বিজ্ঞানীরা দিয়েছিলেন। ১৯৮৪-’৮৮ সালে ‘জিএসআই’-এর একজন বিজ্ঞানী আসন্ন বিপদ এবং তার প্রতিকারের উপায় বাতলান। ১৯৯৬-’৯৭, ১৯৯৭-’৯৯ সালে ড. এ. আচার্য ও ড. দাস এবং ড. এ. আচার্য এবং ড. প্রবীর দত্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশেষ অনুরোধে জিএসআইয়ের তরফ থেকে দিঘাতে কাজ করেন। তঁারা যে রিপোর্ট জমা করেছিলেন তার কপি পাঠানো হয় রাজ্য সরকারের কাছে।
সমুদ্র যেখানে শেষ হয়, তারপর শুরু হয় ‘টাইটেল জোন’ এবং সি-বিচ। এরপর থাকে ডিউন জোন, বালির বড়-বড় ডিউন, যাকে বালিয়াড়ি বলা হয়। এরপর ঘন ঝাউবন। কোনও ঝড় যখন ধেয়ে আসে, জলোচ্ছ্বাস হয়, তখন প্রথমে তা অল্প হলেও কিছুটা সামাল দেয় বড় বড় বালির ডিউন। তারপর ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসকে রীতিমতো রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে ঘন ঝাউবন যা দিঘাতে উন্নয়নের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ।
বিজ্ঞানীদের অন্যতম পরামর্শ ছিল– ১) সমুদ্রতীর থেকে ৫০০ মিটার অবধি অঞ্চল বনদপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া। ২) মার্চ-এপ্রিল মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুর প্রভাবে ডিউন ফিল্ডের বালু সরে গিয়ে প্রথম আঘাতটি রক্ষার ক্ষমতা হারায়। তাই, ওই সময়ে ফেন্সিং বানিয়ে হাওয়াকে রুখে দেওয়া। ৩) ঝাউবন কাটা বন্ধ করা, কৃত্রিমভাবে ঝাউগাছ বসিয়ে ঝাউবন তৈরি করা, যা একমাত্র বনদপ্তরের পক্ষেই সম্ভব। দেখা গিয়েছে, প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসে সুপার সাইক্লোন বঙ্গোপসাগর উপকূলে আছড়ে পড়ে, যার ভয়াবহতা আগে থেকে ঠাহর করা সম্ভব নয়। হোটেল মালিকরা যে রোজগার করছেন, সেই টাকা তারা পরিবার-সহ ভোগ করতে পারবেন তো? প্রতি বছর সমুদ্রের জলস্তর ৩-৪ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে ইয়াসের থেকেও ভয়ঙ্কর একটি ঝড় দিুঘা-সহ বাকি উপকূলবর্তী শহরগুলোকে জলের তলায় পাঠিয়ে দেবে না তো?
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.