ফাইল চিত্র
এশিয়া তাঁর মতো ক্রিকেটার অল্পই পেয়েছে। এখন তাঁর ৭১। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ভরা। রাজনীতিক হিসাবে তাঁর ব্যর্থতা থাকতেই পারে। তবে সবের ঊর্ধ্বে বিরাজমান সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার রূপে ইমরান খানের ভাবমূর্তি– যিনি একক চেষ্টায় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতেন। লিখলেন বোরিয়া মজুমদার
নিখুঁত ও নিয়ন্ত্রিত সুইং বোলিং। বাঘের মতো অধিনায়কত্ব। ব্যাট হাতে মাঠে নামলে ড্রেসিং রুম নিশ্চিন্ত ও প্রতিপক্ষ চাপে। ইমরান খানকে যেসব প্রজন্ম খেলতে দেখেছে, তারা এই কথাগুলোর সঙ্গে একমত হবেই হবে। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ-বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক মানুষেরই বুকের ছাতি ফুলিয়ে দিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের (Pakistan) প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ থেকে ইমরান খানের (Imran Khan) অপসারণ, জেলযাত্রা এবং গোপন তথ্য ফঁাসের অভিযোগ যে-রূপরেখা তুলে ধরছে– তার ঢের আগেই কিন্তু ইমরান খানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতা জনচিত্তে ধরা পড়ছিল। ফলে ক্রিকেটকে যদি তঁার নির্ভেজাল ব্যক্তিত্বের পরিচয় বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে অন্যদিকে এ-কথাও বলতে হবে, রাজনীতি তঁার ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করেছে।
যদিও এই লেখা ‘রাজনীতিক’ ইমরান খানকে নিয়ে নয়। তঁার রাজনৈতিক চাতুর্য নিয়েও নয়। এ-লেখা ফিরে দেখতে চাইছে ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডারকে, যিনি একক চেষ্টায় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। অনেকে ‘স্যর’ গ্যারফিল্ড সোবার্সের পরেই ইমরানকে নির্দিষ্ট করেছেন শ্রেষ্ঠত্বের তালিকায়। অবশ্য তঁাকে যারা খেলতে দেখেনি, এই অভিধা হয়তো তঁাদের কল্পনার দৌড়কে সীমিত করবে।
পরিসংখ্যান কখনওই শেষকথা বলে না। তাও সামান্য পরিসংখ্যান তথ্যেই ফেরা যাক। যে ৮৮টি টেস্ট ম্যাচ তিনি খেলেছেন, তার ৪৮টিতে অধিনায়কত্ব করেন। সেই ম্যাচগুলির মধে্য– নির্দিষ্ট করে বললে– পঁাচটি শতরান-সহ অ্যাভারেজ রেখেছেন ৫২.৩৪। বলে হাতে আরও চমকপ্রদ পারফরম্যান্স। সংখ্যক ম্যাচে ১৮৭টি উইকেট নিয়েছেন, ২০.২৬ অ্যাভারেজ রেখে। রাজসিক বললে কম বলা হবে। বেন স্টোকস-কে দেখে হালে যঁারা আহ্লাদিত হন– নিশ্চয়ই তার কারণ আছে– তবে, ইমরানকে দেখলে তঁাদের খুশি আরও বঁাধনহারা হত– কারণ, তিনি সর্বার্থেই সেরা।
তঁার সমসাময়িক ভিভ রিচার্ডসের নাম স্মরণে রেখেই বলা যায়, ইমরানের মতো ক্যারিশমা-সম্পন্ন ক্রিকেটার বিরল। বহুশ্রুত যে, ইমরান ড্রেসিং রুমে ঢুকলে সব গুঞ্জন, সব সংলাপ নিমেষে থেমে যেত। কণ্ঠস্বরের গভীরতা ছিল টম জোন্সের মতো। জানতেন, যে-কথা তিনি বলছেন, তার তাৎপর্য ও ভেদনশক্তি। তঁার বলা কথার চারপাশে যে মানুষের মন বহ্নি ও পতঙ্গের উপমায় খেলা করবে, সে-বিষয়েও সম্যক উপলব্ধি ছিল। সমালোচকরা তঁাকে ‘ইম দ্য ডিম’ বলতেন। দেওয়া হয়েছিল আরও অনেক তিরিক্ষে ব্যঙ্গাত্মক নাম। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, ক্রিকেটের ইতিহাস যত প্রসারতা পেয়েছে, ইমরান খানের ব্যক্তিত্বের চৌম্বকক্ষেত্র শক্তিশালী হয়েছে ততই।
জাভেদ মিয়ঁাদাদের সঙ্গে তঁার বনিবনা কখনওই ছিল না। কী করেই বা তঁারা একপঙ্ক্তিতে বসবেন? জাভেদ অনেকটা করাচির ‘স্ট্রিট ফাইটার’ মনোভাবাপন্ন, আর ইমরান অক্সব্রিজের প্রতিনিধি। জল এবং আগুনের মতো বিপরীতধর্মী। কিন্তু এহেন মিয়ঁাদাদও কখনও পাকিস্তানের ক্রিকেটের উজ্জীবনে ইমরানের ভূমিকাকে খাটো করেননি, ব্যঙ্গ করেননি, অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন করেননি। উত্তর-প্রজন্মের যে সমস্ত পাকিস্তানি প্রতিভা ইমরানের সঙ্গে বা অধীনে খেলেছেন, তঁারাও সমান গুণমুগ্ধ। ওয়াসিম আক্রমের কথাই ধরুন। বছর চল্লিশের উপর হয়ে গেল, দু’জনে একসঙ্গে প্রথম খেলেন। অথচ এখনও ইমরান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আক্রমের গলায় শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম, ভালবাসা ফুরয় না।
‘নিরপেক্ষ আম্পায়ার’– আধুনিক ক্রিকেটে এই ধারণা প্রবর্তিত হওয়ার আগে ভারতের একটি পাকিস্তান টু্যরের কথা বলি। ১৯৮২-’৮৩ সালে, মহিন্দর অমরনাথ এবং সুনীল গাভাসকরের অতিমানবিক পারফরম্যান্স সত্ত্বেও ছয় টেস্টের সিরিজে ভারত প্রথম তিনটেয় পরাজিত হল। সেই টেস্ট সিরিজ গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের কেরিয়ার কার্যত শেষ করে দিয়েছিল। লাহোরে করেন এক, করাচি ও হায়দরাবাদে (সিন্ধ) দু’বার শূন্য– ইমরানের সামনে কোনও থই খুঁজে পাননি গতিনি। নতুন বলে ইনসুইং, আর পুরনো বলের মনোহর রিভার্স সুইংয়ে ইমরান ৪০টি উইকেট তুলেছিলেন। প্রয়াত রাজন বালা ছিলেন সেই টু্যরের অন্যতম সাংবাদিক। পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিং নিয়ে সেবার যে বিস্তর কথা হয়েছিল, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েও তিনি পরে বলেন– ‘কিন্তু, আম্পায়ারিং যতই খারাপ হোক, ইমরানের বোলিং-নৈপুণ্যকে লঘু করা যাবে না। এতই ভাল বল করেছিল ইমরান যে, হাতে কমলালেবু ধরিয়ে দিলেও একের পর এক উইকেট নিয়ে যেত।’
১৯৮৭-র বিশ্বকাপ সেমি ফাইনালের কথা নতুন করে সবিস্তার বলার দরকার নেই। শুধু খেই ধরানোর মতো সূত্র দেওয়া যাক, পাকিস্তানের স্বপ্ন সেবার শেষ হয়ে গিয়েছিল ক্রেগ ম্যাকডারম্যাটের বিধ্বংসী বোলিংয়ে। ৪৪ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন। ইডেনের দর্শক হতাশ হয়েছিল। ইমরান তখন ৩৫। সময় ইমরানকে খুঁজছিল। ইমরান বুঝতে পারছিলেন, অবসরের প্রতিধ্বনি। কথিত, সেই সময়বদ্ধ ঘরে শোনা ‘দ্য রোলিং স্টোন্স’-এর ‘ইউ ক্যান নট অলওয়েজ গেট হোয়াট ইউ ওয়ান্ট’ গানটি তঁাকে পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর আবার যখন তিনি আলোয় আত্মপ্রকাশ করলেন, এবং পাকিস্তানের হাল ধরলেন, খোদিত হল– ’৯২ সালের বিশ্বকাপ জয়ের স্বর্ণালি ইতিহাস।
‘রোলিং স্টোন্স’-এর মিক জ্যাগারের মতোই ইমরান আসলে জানতেন, কী করে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। যখন তঁার বলে কমে এল গতি, তখন অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সুইং করানোর শক্তিতে। যখন সেই বড় হিটগুলি– যা বলকে বাউন্ডারির ওপারে পাঠিয়ে দিত তুরীয় আনন্দে– আর ব্যাটে-বলে হচ্ছিল না– জোর দেন মিডল অর্ডারে ব্যাট করার টেকনিকের উপর। যাতে ইনজামাম-উল-হকের মতো তরুণ ব্যাটিং পর্যায়ের উপরের দিকে গিয়ে স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারেন।
এই কথায় অতিরঞ্জন নেই, এশিয়া ইমরানের মতো ক্রিকেটার অল্পই পেয়েছে। এখন তঁার ৭১। ভবিষ্যৎ ধূসর পাণ্ডুলিপির আয়োজন করছে। রাজনীতিক হিসাবে তঁার ব্যর্থতা থাকতেই পারে, কিন্তু মানতে তো হবে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সিস্টেম কখনওই গণতন্ত্রকে মূল্য দেয়নি। ফলে, রাজনৈতিক পরিসরে সবসময়ই বিশৃঙ্খলার ধূমকেতুরা উঁকিঝুঁকি মেরে গিয়েছে। ইমরানের দায় তঁাকেই বহন করতে হবে। তবে, দায় বা দোষ তঁার একার নয়। যখন তিনি পাকিস্তানের নিয়ামক-শক্তি সেনাতন্ত্রকে চটিয়ে দিয়েছিলেন, সেদিনই তঁার রাজনৈতিক কেরিয়ারের ভাগ্য লিখিত হয়ে গিয়েছিল।
পাকিস্তানের বাইরে যারা থাকে, তারা হয়তো ইমরান ও তঁার রাজনৈতিক কেরিয়ার সম্বন্ধে সেরকম ভাবিত নয়। বরং তাদের মনে অনেক বেশি গেঁথে আছে ক্রিকেটার ইমরানের ছবি– ছিপছিপে চেহারা, সাদা শার্ট কিছুটা বেরিয়ে এসেছে কোমর থেকে, দৃঢ় পদক্ষেপে বল হাতে ছুটে আসছেন মানুষটি। তারপর একটি সংহত লাফ ও হাত থেকে বল ছুটে যাচ্ছে স্টাম্প উপড়ে দিতে। এই স্মৃতি যাদের সঙ্গী, তারা আশা করে বইকি– এই ক্রিকেট আইকনের জন্য ভবিষ্যৎ একটু সুগম্য হোক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.