বড় নোট বাতিল নিঃসন্দেহে কালো টাকার রমরমা রুখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তে রাতারাতি সব কালো টাকা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই৷ হিসাব বহির্ভূত ২০০ কোটি টাকা প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে সাদা হয়ে যেতে পারে অবিশ্বাস্য এক কায়দায়৷ কী সেই ম্যাজিক, খোঁজ নিলেন দীপেন্দু পাল
Advertisement
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে টিভিতে ঘোষণা করলেন, যে অবিলম্বে ‘বাপু’র ছবি আঁটা পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে গেল৷ বাপু রাতারাতি হয়ে গেলেন ‘হানিকারক বাপু’৷ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা শেষ হতে না হতে শুরু হরিপদ কেরানিদের গুজগুজ-ফিসফাস! ‘বেশ হয়েছে! জব্দ হয়েছে ব্যাটা কালো টাকার কারবারিরা৷’ শাসক দলের পার্টি অফিসেও জোর গুঞ্জন, বিধানসভা ভোটের আগে অ-বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘টাইট’ দেওয়া গিয়েছে৷ গতকাল রাতে প্রাইম টাইমে এক জনপ্রিয় উপস্থাপকের শো দেখে এসে, সকালের ডাউন বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকালের কামরায় জোর তর্ক জমে উঠেছে৷ “উত্তরপ্রদেশে ভোটের জন্য যত কালো টাকা মজুত করে রাখা হয়েছিল, সেই সব এখন পুড়িয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই৷” “দেকছিস না, পতিদিন কত্ত টাকা পোড়ার খবর দেকাচ্চে টিভিতে৷” – জাতীয় কথা ভেসে আসছে কামরার এদিক-ওদিক থেকে৷
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এহেন সাহসী পদক্ষেপেও রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে কালো টাকা রাতারাতি উধাও হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই৷ হ্যাঁ, এ কথা সত্যি, যে মোদির এই সিদ্ধান্তে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ বোঝাই যাচ্ছে, নোট বাতিলের ঝড়ে তাঁদের কালো টাকার গদি খানিকটা টালমাটাল৷ সুযোগ পেলেই বাতিল নোট ফের ফিরিয়ে আনা হোক মার্কা দাবি তুলে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন তাঁরা৷ তবে নোট বাতিল হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলির কালো টাকার ভাণ্ডার শূন্য হয়ে যাবে না৷ খানিকটা আতান্তরে পড়লেও ‘জুগাড়’-এ ওস্তাদ কালো টাকার কারবারিরা টাকার গা থেকে কালো কালি ধুয়ে ফেলার সবরকম বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন৷ মোটামুটি তিনটি ধারণা সাধারণ মানুষের আলোচনায় বারবার উঠে আসছে৷
১. রাজনৈতিক দলগুলি চালাতে সবসময় প্রচুর টাকার দরকার৷
২. বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই ক্যাশ টাকায় লেনদেন করে৷
৩. আগামী ৬ সপ্তাহ কোনওভাবেই কালো টাকাকে সাদা করা যাবে না৷
এই ভুল ধারণাগুলি দূর করা দরকার৷ প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলিতে টাকার প্রয়োজন চাহিদাভিত্তিক৷ ধরা যাক, কেউ পার্টির টিকিট চান, কেউ নিজের সোশ্যাল স্টেটাস বাড়াতে চান৷ কালো টাকার উপর খাঁড়া নেমে এলেও এই চাহিদাগুলি কোনওদিনই মিটবে না৷
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলি এখন শুধুই নগদ টাকায় লেনদেন করে না৷ অনলাইনে লেনদেন এখন জলভাত৷ আর নগদ টাকা কোনও দলের সদর দফতরে জমানো থাকে না৷ বহু স্থান ও লোকের মধ্যে সেই টাকা বিলিয়ে দেওয়া হয়৷ অনেক সময়, দলকে এড়িয়ে লেনদেন হয় দু’পক্ষের মধ্যে৷ যিনি টাকা দিচ্ছেন, অর্থাৎ ফিন্যান্সার ও যিনি নিচ্ছেন, অর্থাৎ সুবিধাভোগী- এই দুই পক্ষের মধ্যে কোনওভাবেই রাজনৈতিক দলের নাম জড়ায় না৷ যদিও গোটা প্রক্রিয়াটাই পরিচালনা করে ওই রাজনৈতিক দলই৷ এই বিপুল নগদ টাকা এত রকমভাবে এতজনের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া অন্যতম কারণ, একজন আয়কর দফতরের জালে ধরা পড়লেও বাকিদের টিকিতে যেন টান না পড়ে৷
সবশেষে, আগামী ৬ সপ্তাহে কালো টাকাকে সাদা করা যাবে না, এটাও একটি মস্ত বড় ভুল ধারণা৷ এখনও বহু সরকারি স্কিম হয়েছে, যেখানে টাকা ঢাললে আয়কর দফতরের কেষ্ট-বিষ্টুরা একটুও ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন না৷ তাছাড়া, একটি রাজনৈতিক দলের ২০০ কোটি কালো টাকা সাদা করতে দরকার স্রেফ ৮ হাজার সদস্য-স্বেচ্ছাসেবী৷ প্রত্যেক সদস্য ব্যাঙ্কে গিয়ে আড়াই লক্ষ করে টাকা জমা দিলেই ২০০ কোটি টাকা প্রশাসনের নাকের তলা দিয়ে সাদা হয়ে যাবে৷
তাহলে এখন রাজনৈতিক দলগুলি কী করছে?
প্রথমত, নোট বাতিলের প্রাথমিক ধাক্কাটুকু কাটিয়ে উঠতে সামান্য সময় দরকার দলীয় নেতৃত্বের৷ আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এরকম বহু খাত তাঁরা খুঁজে বার করে ফেলবেন যেখানে টাকা ঢাললে ভবিষ্যতে ফেরত পাওয়া যাবে৷ উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও মুম্বইতে আগামী কয়েকদিন রাজনৈতিক নেতারা তাই খুব একটা তৎপরতা দেখাবেন না৷ সত্যি বলতে কী, হাতে গোনা একটি বা দুটি রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্য কোনও দলেরই শীর্ষ নেতারা নোট বাতিল ইস্যুতে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছেন না৷ বিজেপি তো নয়ই৷ কারণ, টাকার জোগানে ধাক্কা খেলেও এই সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ চাকুরিজীবী ও ছোট ব্যবসায়ীদের পাশে পাওয়া যাবে৷ ভুললে চলবে না, ২০০৯ থেকে বিজেপির তহবিলে এরাই সবচেয়ে বেশি টাকা ঢেলেছেন৷
তাছাড়া, এখনও বেশ কিছু জরুরি পরিষেবার ক্ষেত্রে পুরনো নোট ব্যবহার করা যাবে৷ রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা সেই সব খাতে পুরনো নোট ঢালছেন৷ এমনকী, প্রয়োজনে এখন টাকা ঢেলে তাঁরা চুপচাপ থাকছেন৷ ফায়দা পরে উসুল করে নেবেন৷
তৃতীয়ত, নতুন নোট বাজারে আসা ও ভোটের দিনক্ষণের মধ্যে এখনও বেশ কিছু দিন বাকি রয়ে গিয়েছে৷ ইতিমধ্যেই পাঞ্জাবের কয়েকটি রাজনৈতিক দল নতুন করে সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতে শুরু করে দিয়েছে৷ পুরোটাই নতুন নোটে৷ ডিসেম্বরের শেষের মধ্যে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করা যাবে বলেই আশা করা যাচ্ছে৷ অর্থাৎ, নোট বাতিল এমন কোনও দাবানল নয়, যাতে সমস্ত কালো টাকা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত যে দেশকে কালো টাকার কবল থেকে মুক্ত করার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ, সে কথা স্বীকার করছে সব পক্ষই৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.