এই মুহূর্তে পৃথিবীর দূষিত শহরগুলির মধ্যে দিল্লি ‘ফার্স্ট বয়’। বিবিসি তো দিল্লিকে রীতিমতো ‘গ্যাস চেম্বার’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে! শুধুমাত্র হরিয়ানা আর পাঞ্জাবে কৃষকদের চাষের পর খেতের মধ্যে পড়ে থাকা বিঘের পর বিঘে উচ্ছিষ্ট ফসল পোড়ানো বা ‘স্টাবল বার্নিং’-ই দায়ী নয়, এটা মানুষের বেপরোয়া বাজি ফাটানো ও পোড়ানোর ফল। প্রতি বছরই ১ থেকে ১৫ নভেম্বর দূষণের একটা প্রকোপ দিল্লিতে ভয়ংকরভাবে মাথাচাড়া দেয়। তবে এবার যা অবস্থা তাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি ১৯৫২ সালে লন্ডনের কুখ্যাত স্মগ, যাতে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, তার চেয়েও খারাপ! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
‘গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন’ থেকে যেদিন দিল্লিতে ফিরলাম, সেদিন বিমানবন্দর থেকে বেরতেই মনে হল, চোখটা জ্বলছে! গ্লাসগোয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে দূষণের বিরুদ্ধে নানা প্রতিশ্রুতি, নানা হুংকার শুনেছি, সাতদিন ধরে বৈজ্ঞানিকদের কচকচি, পরিবেশবিদদের সতর্কবার্তা- এসব শুনতে শুনতে বেশ এমন একটা ভাব মনের মধ্যে জাগছিল যে, আশায় তাহলে বুক বাঁধা যায়! আমরা সবাই মিলে চাইলে আবার এই কলুষিত পরিবেশকে কলুষমুক্ত করতে পারি।
প্রধানমন্ত্রীর পঞ্চমামৃত নিয়ে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে। পরিবেশ-জলবায়ু নিয়ে রাজনীতিও কম হল না। কিন্তু দিল্লিতে এসে দেখলাম, আকাশটা যেন অন্ধকার! বিবিসি বলছে: দিল্লি তো এখন গ্যাস চেম্বার! পৃথিবীর সমস্ত দূষিত শহরের মধ্যে নাকি এখন দিল্লি হল ‘ফার্স্ট বয়’!
দুঃখ, লজ্জা, একটা অদ্ভুত গ্লানি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে এসে টিভি চালালাম। দেখছি যে দীপাবলিতে এত আতশবাজি ফেটেছে এবং দূষণ-সৃষ্টিকারী নানা ফায়ার ক্র্যাকারের দৌরাত্ম্য এতটাই হয়েছে যে তাতে রাজধানী ভয়ংকরভাবে দূষণে আক্রান্ত। এর জন্য শুধুমাত্র হরিয়ানা আর পাঞ্জাবে কৃষকদের চাষের পর খেতের মধ্যে পড়ে থাকা বিঘের পর বিঘে উচ্ছিষ্ট ফসল পোড়ানো বা ‘স্টাবল বার্নিং’ দায়ী নয়, এটা মানুষের বেপরোয়া বাজি ফাটানো ও পোড়ানোর পরিণামও। এখন এমন অবস্থা দাঁড়াল, সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে কেজরিওয়াল সরকারকে নড়ে বসতে হল। যখন পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন জায়গায় স্কুল খোলার নির্দেশ দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার, তখন দিল্লিতে বাচ্চাদের দূষণ থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য স্কুল বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
এটার জন্য কি আমাদের কোনও লজ্জা হচ্ছে না? আত্মগ্লানি আসছে না? দিল্লিতে বাজি ফাটানোর সংস্কৃতির মধ্যে একটা অদ্ভুত, অশ্লীল পেশিপ্রদর্শন আছে। ৩৫ বছর ধরে রাজধানীতে বসবাস করে এটা আমি ভালই বুঝেছি। দিল্লিতে আমাদের পাড়ায় একটা সময় প্রায় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত লম্বা সাপের মতো সুদীর্ঘ লঙ্কাপটকার পরিক্রমা রচনা করা হত। একটা দিক থেকে সেটা ফাটানো শুরু হত প্রবল শব্দে। অনেকে বলেন যে, দিল্লিতে যেহেতু পার ক্যাপিটা ইনকাম আর কালো টাকার দাপট বেশি, সেই টাকাগুলোকে পোড়ানোর দৌড়েও বোধহয় দিল্লি অনেক বেশি এগিয়ে।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট জানাচ্ছে, প্রত্যেক বছরই পয়লা নভেম্বর থেকে ১৫ নভেম্বর দূষণের একটা প্রকোপ দিল্লিতে ভয়ংকরভাবে মাথাচাড়া দেয়। এবারও কেজরিওয়ালের সরকার জলকামান ব্যবহার করে বাতাসের দূষণ কমানোর চেষ্টা করেছে। তাতে দূষিত পদার্থগুলো আরও উপরে উঠে যায়। আপাতভাবে শান্তি আসে বটে, কিন্তু সেটা আদতে কোনও সমাধানই নয়। রাজধানীতে দূষণের পরিমাণ শতকরা ৪৮ ভাগ বেড়ে গিয়েছে। যমুনা কালো থকথকে হয়ে গিয়েছে, জল নেই। কেজরিওয়াল ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যমুনাকে তিনি এমন দূষণমুক্ত করে দেবেন যে সেখানে জল থাকবে, কুলকুল করে বয়ে যাবে নদীধারা, যমুনার তীরে আবার শিশুরা খেলা করবে! কোথায়? জগৎ পারাবারের তীরে শিশুরা যে কতটা খেলা করছে সেটা তো এখন আমরা চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছি। জলবায়ু সম্মেলনের সবথেকে বড় ব্যঙ্গাত্মক পরিণতি এখন দিল্লির।
ভয়াবহ দূষণের নেপথ্যে কিন্তু গাড়ির সংখ্যাও একটা মস্ত বড় ফ্যাক্টর। আমি যখন প্রথম দিল্লি আসি, আমার পাশের বাড়ির ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ থ্রি কারস অ্যান্ড ওয়ান মারুতি’। সেই ধনী ব্যক্তির কাছে মারুতিটা ‘গাড়ি’ বলেই মনে হত না। ওটা রাখা হয়েছিল দুধ আনতে যাওয়া অথবা চাকরবাকরদের মুদিখানা থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসা- এসব কাজের জন্য। পরে পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারি, ভারতের সবথেকে বেশি গাড়ির সংখ্যা যে-মেট্রোপলিটন শহরে তা হল এই দিল্লি। গাড়ির সংখ্যা মানেই পেট্রোল, পেট্রোল মানেই দূষণ। একটা সময় গাড়ির সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে কেজরিওয়াল প্রশাসনকে অল্টারনেটিভ সংখ্যার গাড়ি চালানোর ফরমান জারি করতে হয়েছিল। অর্থাৎ, আজ যদি ইভেন নম্বর-এর গাড়ি রাস্তায় বেরয় তো কালকে রাস্তায় চলবে অড নম্বর-এর গাড়ি। বাধ্যতামূলক করা যায়নি অবশ্য। আদালতের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল বিষয়টা। শেষ পর্যন্ত সে-প্রথা উঠেও গিয়েছে।
এখন লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে। সেটা করোনার জন্য। কেউ কেউ বলছেন যে, লকডাউন হলে গাড়ির দূষণও কমবে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিকতম ফরমানে কেন্দ্রীয় সরকার, কেজরিওয়াল সরকারে উচ্চ পর্যায়ের ঘন ঘন বৈঠক হচ্ছে। ভাল কথা। চোর পালালে চিরকালই আমাদের বুদ্ধি বাড়ে! কিন্তু এখানে, এমনকী, চোর পালানোর পরেও কি আমাদের বুদ্ধি বেড়েছে? দিল্লির মাথাপিছু আয় দেশের গড় মাথাপিছু আয়ের চেয়ে অনেক গুণ। এই রক্তটা দিল্লিতে জমাট বেঁধে যাওয়ায় এখন দিল্লি হয়ে গেল মস্ত বড় ভিক্টিম। দিল্লি এখন নিজেরই আগেকার সব দূষণের রেকর্ড ভাঙার অপেক্ষায় এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি ১৯৫২ সালে লন্ডনের কুখ্যাত স্মগ, যাতে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, তার চেয়েও খারাপ!
দিল্লিতে বায়ুদূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায় অতিক্রম করায় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে স্থানীয় বাসিন্দারা দূষণবিরোধী নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। দিল্লিতে বায়ুদূষণের ভয়াবহতা গত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ বায়ুদূষণের যে-মাত্রাকে গ্রহণযোগ্য নিরাপদ সীমা বলে মনে করে, গত ডিসেম্বরে দিল্লির অনেক এলাকায় দূষণের মাত্রা ছিল তার ৩০ গুণ। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে শহরকে বাঁচাতেই দূষণবিরোধী বিক্ষোভ, র্যালি, প্রতিবাদ কর্মসূচি-সহ নানা ধরনের কার্যক্রম উপস্থাপিত করছেন দিল্লির বাসিন্দারা।
সামগ্রিক ঘটনার প্রেক্ষিতে একটাই কথা বলতে পারি যে, আমাদের সকলের এই মুহূর্তে অনন্ত এই পদক্ষেপের জন্য কুর্নিশ জানানোর প্রয়োজন সুপ্রিম কোর্ট-কে। ভারতের সংবিধান রচয়িতারা এই যে শাসন ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করেছিলেন তা এখনও আমাদের কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ রাখে। চারদিকে যখন গণতন্ত্রের উপর কুঠারাঘাত আসছে, এমনকী, সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা নিয়েও হরেক রকম প্রশ্ন উঠছে, তখন দূষণ রোধে শীর্ষ আদালতের কঠোরতম অবস্থানকে সেলাম জানাই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.